ওয়ার্ক ফ্রম হোম কিছুটা অবসর যাপনের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে মহিলাদের জন্য। বহু শতাব্দী ধরে মহিলারা পুরুষের কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে খাবার সংগ্রহ করেছেন এমনকী বন্যপ্রাণীও শিকার করেছেন। তবে শিকারী হিসাবে পরিচিত মানুষরা আধুনিক সভ্যতার আগেও কিন্তু সৎ ছিলেন।
কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতির পর থেকে কৃষকরাও গম এবং অন্যান্য দোফসলি চাষবাসে সাফল্য পেতে শুরু করল। সেইসঙ্গে ধর্মও নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হল, অর্থাৎ গ্রাম থেকে শহরে সর্বত্র বাড়িতে থেকে সন্তানের দেখাশোনার জন্য মহিলাদের উত্সাহ জোগান হল দিগুন ভাবে। এক্ষেত্রে পরম্পরা বজায় থাকল। সন্তানের জন্ম দেওয়া, খাওয়ানো-পরানো, যত্ন নেওয়া যেন নারী-জীবনের অন্যতম ব্রত হয়ে দাঁড়াল। বাকি সব দাযিত্ব এবং অধিকার পুরুষরা নিজেদের করে রাখল এবং এভাবেই ধর্মের জয়গান গাওয়া চলতে থাকল।
এমন কোনও পুরুষ নেই যিনি চান না তার স্ত্রী তার অধীনে থাকুক। সব পুরুষই চান, যখন চাইব স্ত্রীকে বিছানায় পাব, যখন চাইব খাবার সামনে পাব। সেইসঙ্গে স্ত্রী ঘরসংসারও ঠিকমতো সামলাবে, এও চান সব পুরুষরা। আর যারা কিছুটা মহানুভবতা দেখাতে চান, সেইসব পুরুষরাও এমন ভাবে কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন, যাতে মহিলাদের গুরুত্ব কম থাকে।
আর নারী-পুরুষের বিয়ে বিষয়টি তো পুরুষের অধিকার বলবৎ করার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে সমাজকে এই বার্তা দেওয়া হয় যে, আমি যাকে বিয়ে করেছি, সে শুধু আমার সম্পত্তি, অন্য কারওর অধিকার নেই তার উপর। কিন্তু অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অধিকার পুরুষের আছে।
ইতিহাস ভরা মহিলাদের দাসত্ব এবং বেশ্যাবৃত্তিতে। যে সভ্যতা যত ধার্মিক, সেই সভ্যতায় ততই ঘটেছে অত্যাচারের ঘটনা। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমি দেশগুলিতে যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করানোর জন্য মহিলাদের বাড়ির বাইরে আনা হয়েছিল কিংবা বলা যায়, তারা বাড়ির বাইরে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। আসলে যে-দেশ কিংবা সমাজ যত গোঁড়ামি করবে, সেই দেশ তথা সমাজ ততই পিছিয়ে পড়বে। কারণ, কট্টরদের এই বোধ থাকে না যে, নারীর শ্রমদানকে কীভাবে সার্থক করে তোলা যায়।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর যখন প্রচলন ছিল না, তখন মহিলারা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হতেন শুধু সন্তান এবং সংসার সামলানোর জন্য। অথচ, মানবিকতা সেটাই যা সংসারের দায়দাযিত্ব নারী-পুরুষ সমান ভাবে ভাগ করে নেবে। পুরুষদের বক্তব্য, তারাই মহান কাজ করেন, কারণ তারা পরিবারের সবার অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন। আর এই মহান বক্তব্য তুলে ধরে, স্ত্রীকে তার দাসত্ব করতে বাধ্য করেন।
এখন কিন্তু সব ধ্যানধারণা বদলে দিয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাড়িতে থেকে সবকিছু সামলেও যে-অর্থ উপার্জন করা যায়, তা আজ মহিলারা ওয়ার্ক ফ্রম হোম-কে মাধ্যম করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, ঘরে-বাইরে সমান পারদর্শী তারা এবং এক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে তারা এগিয়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর মাধ্যমে মহিলারা এখন সংসার এবং অফিসের কাজ সামলান নিজের ইচ্ছেমতো। এই স্বাধীনতা তারা পাচ্ছেন ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর সুবিধের জন্য।
পুরুষরা যেমন শরীরচর্চা করতে করতে কিংবা খাবার খেতে খেতে ল্যাপটপ কিংবা মোবাইলকে মাধ্যম করে অফিস সামলাচ্ছেন, মহিলারাও তেমনই রান্না খাওয়ার বন্দোবস্ত কিংবা বাচ্চার যত্ন নিতে নিতেই অফিসের কাজ সামলাচ্ছেন দক্ষতার সঙ্গে।
করোনা ভাইরাস শরীরের ক্ষতি করলেও সুবিধে দিয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর এবং ঠিক এই কারণে নারীকে আটকে রাখার ধর্মীয় অনুশাসন এখন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই ধর্মের দোকানদাররা ছাড়া, আর বাকি মানুষের মধ্যে অনেকেই করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার পথ বের করে নিচ্ছেন প্রতিদিন। আর এই বাঁচার রাস্তাগুলির মধ্যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম অন্যতম।
কোনও বিনোদন কিংবা খেলার জগতে নয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২৪ ঘন্টা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে চিকিত্সা পরিষেবা দিয়ে চলেছেন মেয়েরা এবং করোনার হাত থেকে বাঁচানোর উদ্যোগও নিয়ে চলেছেন আন্তরিক ভাবে।
তবে মনে রাখতে হবে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এ আরও কিছু সুবিধে পাওয়া যায়। থাকতে হয় না পুরুষের অধীনে, তাই যৌন নির্যাতনের ভয়ও থাকে না। বাড়ি থেকে তাই আজ অফিস কিংবা ব্যাবসা সবই চালানো যায় কম্পিউটার এবং মোবাইলকে মাধ্যম করে। তাই এও একপ্রকার নারী স্বাধীনতা বলা যায়।
ইতিহাস সাক্ষী যে, অনেক লড়াইয়ে পর আজ মেয়েরা অনেকটা স্বাধীনতা পেয়েছেন। কিন্তু আজও অনেকে মহিলাদের চায়ের ভাঁড়ের মতো মনে করেন এবং ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলেন।
আসলে, আজও ধর্মান্ধ লোকেদের কুমতলব, পেশি প্রদর্শন বন্ধ হয়নি। আজও তারা সংখ্যায় অনেক। তাই গ্রাম থেকে শহরে তাদের দৌরাত্ম্য এখনও কমেনি। সেই তুলনায় মহিলা নেত্রীর সংখ্যা নগণ্য। মহিলাদের সাহায্যে পরামর্শ কিংবা রক্ষাকারীও হাতে গোনা। তাই ভক্ষকের কাছেই মাথা নত করে বাঁচানোর জন্য মিনতি করতে হয়। কিন্তু অনেক ক্ষতি করলেও, একটা-দুটো ভালো পথও দেখিয়েছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর মাধ্যমে, উপার্জনের সুন্দর এক দরজা খুলে দিয়েছে। তাই মহিলাদের উচিত সেবাদাসীর মতো পুরুষের অধীনস্ত থেকে গৃহবন্দি জীবন না কাটিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। অর্থাৎ, পরনির্ভরশীলতার সীমাবদ্ধতা থেকে মনকে মুক্ত করে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর মাধ্যমে উপার্জন করে মাথা উঁচু করে বাঁচুন।