সাত

হ্যালো, গৌতমদা আপনার সাথে জরুরি একটা বিষয়ে কনসাল্ট করার দরকার ছিল। ফোনে হবে না, আপনি কি কিছুটা সময় দিতে পারবেন?

অফ কোর্স। তুমি ঘন্টাখানেক পরে চলে এসো। ওদিকে কতটা প্রোগ্রেস হল?

সেই ব্যাপারেই কথা বলতে চাই। আপনার কিছু সাজেশনও লাগবে। আমি আসছি তখনই কথা হবে।

ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীর অফিস রুমে ঢুকে রক্তিম দেখল আর কেউ নেই। কিছুটা অবাক হল। গৌতম চ্যাটার্জী হাসি মুখে বললেন, এসো রক্তিম। বাকি সব কাজ মিটিয়ে তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি। তোমার ফোন ও অ্যাটিটিউড দেখেই বুঝেছিলাম সামথিং হ্যাজ হ্যাপেনড। মনে হয় তুমি কিছু একটা উদ্ধার করতে পেরেছ। অ্যাম আই রাইট?

রক্তিম হেসে বলল, এই জন্যেই লোকে বলে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। তবে এখনও কোনও বিষয়ে কনফার্ম হতে পারিনি। খুনি কে তাও জানতে পারিনি। সাফল্যর মধ্যে নেক্সট টার্গেট কে হতে পারে তার একটা আভাস পেয়েছি। আর সেই পথ ধরেই আমি খুনি পর্যন্ত পৌঁছোতে চাইছি। বলতে পারেন এটাই আমার শেষ রাস্তা।

কে এই টার্গেট?

নীলম মাথুর। ওরফে পায়েল মিত্র।

অভীক পাত্রের পিএ মেয়েটা?

হ্যাঁ। শুনলে অবাক হবেন, এরা সবাই একটা ডার্টি গেম-এর পার্ট। এতদিন গেম-টি একতরফা চলছিল। যার ফলে বাইরের দুনিয়ায় তার কোনও আলোড়ন দেখা যায়নি। কিন্তু কেউ বা কারা এই গেম-এ অখুশি হয়ে ওঠাতেই এই সব বিপত্তি। ডার্টি গেম পরিণত হয়েছে ডেডলি গেম-এ। সম্ভবত এই খেলারই অংশ সিরিয়াল কিলিং। মার্ডারের ক্যারেক্টার বলে দিচ্ছে এর পিছনে যে-মাস্টার মাইন্ড রয়েছে সে অত্যন্ত শার্প অ্যান্ড ডেডিকেটেড। ওকে থামানো অত সহজ কাজ নয়। আবার না থামাতে পারলে একের পর এক অনর্থ ঘটতেই থাকবে।

হুঁ চিন্তার বিষয়ই বটে। তোমার কোনও প্ল্যান আছে?

আছে। কিন্তু আমার প্ল্যানে রিস্ক ফ্যাক্টরও আছে। এখন সেটাকে এগজিকিউট করার পারমিশন দেবেন কিনা সেটা জানতেই মূলত আপনার কাছে আসা। অনেক ভাবেই ভেবে দেখেছি কিন্তু রিস্ক ফ্যাক্টর একেবারে এড়াতে পারিনি। আমার হিসেবে ঝুঁকি একটা নিতেই হবে।

তুমি তোমার প্ল্যান আমাকে খুলে বলো। তারপর দেখি কী করা যায়।

বলছি। নীলম মাথুর নেক্সট টার্গেট বলছি ঠিকই কিন্তু তার ওপর কবে, কীভাবে অ্যাটাক হবে আমরা কেউ জানি না। আবার হবেই তেমন গ্যারান্টিও নেই। কারণ পুলিশ যে অনেকটা অ্যালার্ট সে বুঝে গিয়েছে। তবুও আমার বিশ্বাস, সে অ্যাটাক করবেই, আজ হোক বা কাল হোক। সুতরাং আমার প্ল্যানের প্রথম পার্ট হল ধৈর্য ধরা। বাঘ শিকারের আগে যেমন হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনসেন্ট্রেশন ও ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে ঠিক তেমনি। সেকেন্ড পার্ট হল তদন্তের গতি একটু ঢিলে করে দেওয়া। যাতে সে স্বাধীন ভাবে কিছু করার কথা ভাবার অবকাশ পায়। কারণ তার অ্যাক্টিভিটি না থাকলে আমরা অ্যাক্টিভ হতে পারব না। এখানেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি রিস্ক ফ্যাক্টর। প্ল্যানের থার্ড পার্ট হল, কয়েকটি ফোন লাগাতার ট্যাপ করে যেতে হবে। সেই সাথে একটা টিমকে নির্দিষ্ট সময় ধরে তৈরি থাকতে হবে। কারণ কবে কখন কোনদিন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে তা তো জানা নেই। আর একটা কথা, আপনি যে অফিসিয়ালি গোয়েন্দা টিম গঠনের কথা বলেছিলেন তার কী খবর?

প্রোটোকলের গ্যাঁড়াকলে আপাতত সেটা স্থগিত হয়ে আছে। আবার কোনও অঘটন না ঘটা পর্যন্ত সে ফাইল এগোবে বলে মনে হয় না।

একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। একসাথে তদন্ত চললে হচপচ হয়ে যেত। আমার প্ল্যান কিছুটা শুনলেন, রিস্ক ফ্যাক্টর শুরু হবে সেকেন্ড স্টেজ থেকে। ভালো করে অবজার্ভ করলে দেখবেন, মার্ডারগুলো হয়েছে স্টেপ ওয়াইজ। প্রথমে লোকেশন সিলেক্ট করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ভিকটিমকে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে বধ্যভূমিতে। তৃতীয় ধাপে স্পটে গিয়ে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে ধীরে সুস্থে। সবগুলো ক্ষেত্রেই চয়েস করা হয়েছে দারুণ দুর্যোগের রাত। কারণ তাতে লোকজনের নজরে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকছে। আমার ধারণা পরের বারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে আমাদেরকেই। আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন তো গৌতমদা?

খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি ভাই। খুনিকে খুন করতে প্ররোচিত করা। কিন্তু নীলমের জীবন সংশয়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে?

রিস্কটা এখানেই নিতে হবে। একটা ভালো টিম সাথে থাকলে আমার মনে হয় না নীলমের কোনও ক্ষতি হবে।

কিন্তু তোমরা যদি কোনও ভাবে ফেইল করো এবং বড়ো কোনও অঘটন ঘটে যায় — তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ? মিডিয়া, সরকার, পাবলিক, পলিটিক্যাল পার্টি সব আমাকে চিবিয়ে খাবে।

বুঝতে পারছি দাদা। কিন্তু আমার কাছে কোনও বিকল্প অপশন নেই। আপনি পারমিশন না দিলে আমি কেস থেকে নিজেকে উইথড্র করে নেব। কারণ থেকে কোনও লাভ হবে না। গতানুগতিক ইনভেস্টিগেশন করে এই খুনিকে হাতে পাওয়া যাবে না। অন্তত আমার তাই ধারণা। আই অ্যাম সরি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবলেন গৌতম চ্যাটার্জী। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, রিস্ক নিতে আমি ভয় পাই না। তাছাড়া তোমার প্রতি আমার যথেষ্ট আস্থাও আছে। একটু ভাবতে দাও। তুমি টিম হিসাবে কাদের চাও?

আইসি প্রিয় প্রসাদ দেবের থানার টিমটা পেলেই চলবে। এই কদিনে ওদের সাথে একটা ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছে, তাছাড়া ওরা প্রথম থেকেই কেসটা ধরে ধরে সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করছে। আইসি দেব নিজেও ভীষণ কোঅপারেটিভ।

কিন্তু এই ধরনের রিস্ক নিতে ওরা রাজি হবেন তো? কিছুটা আঁচ ওদের গায়ে কিন্তু আসবে।

আপনি কথা বলে দেখুন। আমি একটু হিন্টস দিয়েছিলাম, মনে হয় ওরা অরাজি হবেন না।

গৌতম চ্যাটার্জী তক্ষুণি ফোন করলেন আইসি দেবকে। অনেকটা সময় ধরে কথা হল দুজনের মধ্যে। রক্তিম চুপচাপ শুনল। কথা শেষ হবার পর ফোন রেখে গৌতম চ্যাটার্জী হেসে বললেন, উনি তো তোমার প্রতি দারুন ইমপ্রেসড। কী করে করলে? একজন পুলিশের লোককে ইমপ্রেস করা অত সহজ কাজ নয়।

রক্তিমও হাসল, ওকে ইমপ্রেস করার জন্য আমি তো কিছুই করিনি। এখন ইমপ্রেস হয়ে থাকলে সে তো আমার ভাগ্য। আমি অতি সাধারণ এক গোয়েন্দা।

কামিং টু দ্যা পয়েন্ট। আমি ওন রেসপনসিবিলিটিতে তোমাদের পারমিশন দিচ্ছি রক্তিম। পুরোটাই কিন্তু তোমার ওপর আস্থা রেখে। বুঝতেই পারছ কীরকম চাপে থাকব আমি।

রক্তিম আশ্বাস দিয়ে বলল, চাপ আমারও কিছু কম থাকবে না। আমাকে হয়তো কোনও কৈফিয়ত দিতে হবে না কাউকে কিন্তু ব্যর্থ হলে আমার কেরিয়ারের ব্যাপক ক্ষতি হবে। রেপুটেশন খারাপ হয়ে গেলে কে কেস দেবে? তবুও রিস্ক নিচ্ছি কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমি সফল হবই।

শ্রাবণ মাসের অর্ধেক পার হতেই আবার শুরু হল দুর্যোগ। আবহাওয়া দফতর পরিষ্কার জানিয়ে দিল, তিন চার দিনের আগে এই প্রবল নিম্নচাপ কমার কোনও চান্স নেই। রক্তিমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। এই সুযোগ কাজে লাগাবার চেষ্টা সে অবশ্যই করবে।

দুর্যোগের দ্বিতীয় রাতেই বেজে উঠল সেই প্রত্যাশার ফোন। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। রক্তিম থানাতেই বসে। এমন সময় এসআই বিকাশ ব্যস্ত ভাবে বলল, স্যার নীলমের ফোনে সাসপেক্টের কল এসেছে।

যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। এই রাতটার জন্য টিমের সবাইকে নিয়ে রীতিমতো ট্রেনিং ক্লাস নিয়েছে রক্তিম। প্রত্যেকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে ধরে ধরে। কে কতটা রেসপন্স করছে সেটা যাচাই করার জন্য বারে বারে টেস্ট নিয়েছে।

রক্তিম বলল, এবারের লোকেশন কোথায়? বলেছে কিছু?

বিকাশ বলল, হ্যাঁ, নাগের বাজার…।

রক্তিম মনে মনে হিসাব করে বলল, নীলম থাকে লেনিন সরণিতে। ওখান থেকে স্পটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে পঁচিশ-ত্রিশ মিনিট লাগবে। আপনার টিম নিয়ে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ুন মিঃ দেব। নীলম যেন কোনও ভাবেই ওখানে আগে পৌঁছোতে না পারে। হারি আপ। আমি আমার টিম নিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি। কোনও সমস্যা হলেই ফোন করবেন। কাইন্ডলি আমার ইন্সট্রাকশনের বাইরে কিচ্ছু করতে যাবেন না।

টিম বিভাজন থেকে শুরু করে যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় আগে থেকেই ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল রক্তিম। দুর্যোগ শুরু হওয়ার পর থেকেই, রাত দশটা এগারোটা অবধি থানাতেই অপেক্ষা করেছে সবার সাথে। রক্তিম ভাবতে পারেনি ফোনটা এত তাড়াতাড়ি আসবে।

জিপে বসে রক্তিম বলল, অবিনাশের টাওয়ার লোকেশন ওটাই দেখাচ্ছে তো বিকাশ, যেটা আমি বলেছিলাম?

বিকাশ হেসে বলল, একদম। ইউ আর গ্রেট! কী করে বুঝলেন ওখান থেকেই ফোনগুলো করা হয়েছে বা করা হতো?

কিছুটা অনুমান আর কিছুটা বিজ্ঞান। শান্তার এবং মুকেশের রেকর্ড করা কলগুলো ঘেঁটে আমি একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছিলাম বিকাশ। তোমরাও শুনেছ কিন্তু বুঝতে পারোনি। একটা অদ্ভুত আওয়াজ। প্রথমে আমিও বুঝিনি। সন্দেহ বশে বারবার শুনি। একসময় রহস্য বোধগম্য হয়। বুঝতে পারি ওটা কোনও অ্যান্টিক পেন্ডুলামওয়ালা ঘড়ির বিশেষ ধরনের ঘন্টাধ্বনি, যেটা আধঘন্টা অন্তর অন্তর সময় জানান দেয়। শান্তা ও মুকেশের কথা বলার সময়গুলো আন্দাজ করে মিলিয়ে দেখেছি, প্রায় মিলে গিয়েছে। আমার ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন, ওই বাড়িতে যেদিন যাই সেদিন সময়টা ছিল ঠিক ঘন্টা বাজার সময়। শুনেই যেমন চমকে উঠেছিলাম তেমনি খুলে গিয়েছিল জ্ঞানচক্ষু। উনিই বলেছিলেন ওই রকম অ্যান্টিক ঘড়ি কলকাতা শহরে একটাই আছে। তখন কি উনি অতশত ভেবে বলেছিলেন? যাইহোক যেটুকু সংশয় ছিল আজ দূর হয়ে গেল। সঠিক পথেই চলেছি আমরা।

পলাশ মিত্র বললেন, ওই বাড়িতেই তাহলে অবিনাশ রুদ্র থাকেন?

অবিনাশ রুদ্র না অবিনাশ রুদ্রের ভূত, তা আমি জানি না। একটু পরেই দেখতে পারবেন আশা করছি।

আপনি জানেন ওই ভূতটি কে?

না। তবে অনুমানে একটা নাম আছে। কিন্তু শুধু অনুমানের উপর ভিত্তি করে কারও নাম বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। একটু বাদে দেখার সুযোগ আসবে, ধৈর্য‌্য ধরুন। তবে আবারও কথাটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যে তিনটে খুন করেছে, তার আরও দু-একটা খুন করতে কিন্তু হাত কাঁপবে না। তাই শেষের এই পর্বটা আমাদের কাছে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। সামান্য ভুলের জন্য অনেক বড়ো মাশুল গুনতে হবে সবাইকে। রিমেমবার ইট।

রক্তিমদের জিপ এসে দাঁড়াল মেইন রোডের ধারে। ওর নির্দেশ মতো জিপ থেকে নেমে সবাই পায়ে হাঁটা শুরু করল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কিছুটা জলও জমতে শুরু করেছে রাস্তায়। বিকাশ, পলাশ মিত্র ছাড়াও দুজন বন্দুকধারী পুলিশ রয়েছে টিমে। আইসি দেবকে ফোন করে ওদের অবস্থান জেনে নিল রক্তিম। অপারেশনের টাইম অ্যাডজাস্টমেন্ট ভীষণ ভাইটাল। তালমিল ঘেঁটে গেলে বড়ো বিপদ হয়ে যেতে পারে। নীলম মাথুরকে নিয়ে কী করতে হবে তার প্রয়োজনীয় নির্দেশ আগেই দেওয়া আছে, তবু আর একবার মনে করিয়ে দিল।

আইসি দেব বললেন, নীলম বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ওর মোবাইল লোকেশন দেখাচ্ছে স্পটের দিকেই এগোচ্ছে।

গুড, আমার সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত ওকে ইন্টারাপ্ট করবেন না। এদিকে আমরা আমাদের স্পটে এসে পড়েছি। একটু বাদেই শুরু হবে অ্যাকশন। আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন, নীলম যেন কোনও ভাবেই পয়জন পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছোতে না পারে।

দুজন বন্দুকধারীকে সদর দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে রক্তিম, বিকাশ ও পলাশ মিত্রকে নিয়ে বারান্দায় উঠে এল, কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দরজা খুললেন দেবলীনার মা। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললেন, আপনি আবার এসেছেন? আপনার কি কোনও টাইম জ্ঞান নেই? এই মুহূর্তে আমি আপনার সাথে কোনও কথা বলতে পারব না। আপনারা কাল সকালে আসবেন।

রক্তিম বলল, সরি ম্যাডাম, আমরা ভেতরে সার্চ করব। আমরা জানি ভেতরে এই মূহুর্তে আরও একজন আছেন, মূলত তার সন্ধানেই আমরা এসেছি। আপনার সাথেও কথা আছে, তবে সেটা পরে হবে। লিগাল পারমিশন নিয়ে আমরা এসেছি। পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি করলে অহেতুক বিপদে পড়বেন।

ভদ্রমহিলাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রক্তিমরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরের ঘরে। ফোনে ব্যস্ত ভাবে কথা বলছিলেন একজন, ওদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। ফোনে তখনও ভেসে আসছে একটা মহিলা কন্ঠ, হ্যালো অবিনাশবাবু আপনি শুনতে পাচ্ছেন? আমি এই মুহূর্তে রয়েছি…

রক্তিম ফোনটা তুলে বলল, হ্যালো নীলম, আমি রক্তিম বিশ্বাস বলছি, চিনতে পারলেন তো? ওকে, শুনুন… আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। একটু পরেই পুলিশ আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। ওরা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সরি… এই মুহূর্তে ডিটেলসে বলার সময় নেই, পরে সব জানতে পারবেন।

ফোন কেটে রক্তিম সামনের ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার খেলা শেষ অভীকবাবু। অবিনাশ রুদ্রের নাম দিয়ে ভালোই খেলা দেখালেন। অথচ মানুষটা তো খুব ভালো ছিলেন। সৎ, আদর্শবান, নীতিপরায়ণ খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আপনার মাস্টারমশাই ছিলেন। ওঁর আদর্শকে আপনি এভাবে শেষ করে দিলেন? কেন?

অভীক পাত্র ধপ করে সামনের সোফায় বসে পড়লেন। চোখে অসহায় চাহনি।

এই সব খুনের পিছনে আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল? এভাবে বিবাহিত ভালো ঘরের মেয়েদের হত্যা করে কী হাসিল করার ইচ্ছে ছিল আপনার?

কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন অভীক পাত্র, রাগত স্বরে বললেন, আপনি বোধহয় ভুল করছেন মিঃ ডিটেকটিভ। প্লিজ, আপনি এগুলোকে নিছক হত্যা বলে চালাবেন না। এটা ট্রিটমেন্ট। এক ধরনের থেরাপি। একটা সুন্দর বাগান যখন আগাছায় ভরে যায় তখন সেই অপ্রয়োজনীয় গাছগুলোকে কেটে ফেলতে হয়। নইলে বাগানটাই একদিন শেষ হয়ে যায়। আমি সেই কাজটাই করেছি।

আগাছা কি শুধু মেয়েরাই, ছেলেদের কোনও দোষ নেই?

অবশ্যই আছে। আমি সবাইকেই শাস্তি দিতাম। আপনি সব গোলমাল করে দিলেন।

দেবলীনা আপনার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি মানলাম কিন্তু শান্তা, তিয়াসা ওদের আপনি মারলেন কেন?

ওদের আমি বারবার বলেছিলাম তোমাদের স্বামীদের শোধরাও। কিন্তু শোনেনি আমার কথা। চরিত্রহীন স্বামীদের পক্ষ নিয়ে আমাকেই বিপদে ফেলে দিয়েছিল। অদ্ভুত! কতকগুলো চরিত্রহীন মানুষের জন্য ওদের আদিখ্যেতা মার্কা ভালোবাসা দেখে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। মনে হয়েছে, এদের জন্যই ওদের এত সাহস। সুতরাং এদেরই আগে মরা উচিত। বিষবৃক্ষ কাটার আগে তার শিকড় কাটা দরকার।

আর নীলম?

প্রথমে মনে হয়েছিল ও খুব ভালো, সেনসেটিভ মেয়ে, পরে দেখলাম সি ইজ আ স্মার্ট প্রস্টিটিউট। স্বামী, সংসার, পরিবার এসব ও বোঝে না। বোঝে শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর নোংরামো। ওরও শাস্তি প্রাপ্য ছিল কিন্তু দিতে পারলাম না।

রক্তিম মৃদু হেসে বলল, পৃথিবীতে অনেক অনাচার হয় অভীকবাবু। আমিও মানি সেটা। কিন্তু সেসব দেখার জন্য আইন আছে, প্রসাশন আছে, আমরা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিলে বাস্তবিক অনাসৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমি নিশ্চিত আপনার আদর্শবাদী শিক্ষকমশাই বেঁচে থাকলে তিনিও এর বিরোধিতা করতেন। এবার আপনারা আমাদের সাথে থানায় চলুন। বাকি কথা ওখানেই হবে।

দেবলীনার মা এক কোণায় দাঁড়িয়েছিলেন, ওখান থেকেই বললেন, আমি কেন যাব? আমি কী করেছি?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি অনেক কিছু করেছেন। খুন করছে জেনেও একজন খুনিকে সাপোর্ট করেছেন। এটা কি কম অপরাধ? দেবলীনা যে খারাপ কিছু করে আপনি সব জানতেন। কিন্তু কিছুই বলেননি, কারণ আপনার কাছে দেবলীনা ছিল সোনার ডিমওয়ালা হাঁস। সেই মেয়ে যখন টাকা দিতে অস্বীকার করল, জামাইকে তার বিরুদ্ধে উসকে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেননি। এমনকী খুন করার প্রোরোচনাও দিয়েছেন হয়তো। আবার খুন হয়ে যাবার পর সুযোগ বুঝে জামাইকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন। সেই লেনদেনের প্রমাণ আছে আমার কাছে। কিন্তু এই কাহিনির মধ্যে বড়ো একটা টুইস্ট আছে। আমি অনেক পরে তার সন্ধান পেয়েছি। হয়তো অভীকবাবুও সেটা জানেন না।

দেবলীনার মা বাকরুদ্ধ, পাথরের মতো শক্ত।

রক্তিম বিষন্ন মুখে বলল, ভীষণ খটকা লেগেছিল আমার। মেয়ে যত খারাপই হোক, একজন মা কী করে এমন করতে পারেন? পাগলের মতো ছুটেছি কয়েক দিন। তারপর দেবলীনার বাবার এক বন্ধুর কাছ থেকে পেয়ে যাই কাঙ্খিত সত্য।

ঘরের মধ্যে পিন ড্রপ সাইলেন্স। কাপড়ের আঁচলে মুখ ঢেকেছেন দেবলীনার মা। বাকি সবার চোখেই অসম্ভব কৌতূহল। এমনকী অভীক পাত্রও হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন এসব শুনে!

বিকাশ জিজ্ঞেস করল, কী সেই সত্য?

আসলে দেবলীনা ওঁর নিজের মেয়ে নয়। দেবলীনা আসলে অনাথ মেয়ে যার বাবা-মা এক ভয়ংকর বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান, তখন ওর বয়স মাত্র এক বা দুই। ওকে বাড়িতে নিয়ে আসেন ওঁর দয়ালু স্বামী। না চাইলেও হয়তো মানতে হয়েছিল ওঁকে। কিন্তু মন থেকে যে মানতে পারেননি সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। দেবলীনা ছিল ওঁর কাছে টাকা রোজগারের মেশিন মাত্র। মরেও সে টাকা দিয়ে গিয়েছে।

ফেরার পথে জিপে বসে রক্তিম বলল, এই সাফল্যের জন্য আমাদের টিম ওয়ার্কই মেইন ফ্যাক্টর। সবাই দারুণ কাজ করেছেন। তবে এর পরেও একজনকে আমি স্পেশাল কৃতজ্ঞতা জানাব। নামটা শুনলে আপনারা কিন্তু অবাক হবেন।

বিকাশ বলল, কে?

সুজয় ঘোষ। দেবদূত ঘোষের ভাই।

বিকাশ ও পলাশ মিত্র সত্যি সত্যি অবাক চোখে তাকালেন।

বিকাশ হেসে বলল, সুজয়! এই কেসের সাথে ওর সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। খুব সামান্য একটা কানেকশন। ও তোমাকে কীভাবে হেল্প করল। যার জন্য একেবারে স্পেশাল কৃতজ্ঞতা জানাবে?

আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই সামান্য। ছোট্ট একটা ইনফরমেশন দিয়েছিল সুজয়। কিন্তু সেটাই পরে বিশাল টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো মিত্রবাবু আপনিও ব্যাপারটা শুনেছেন কিন্তু তখন গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। কারণ আমি জানি, আপনি ওর সাথে দুবার কথা বলেছেন।

পলাশ মিত্র অবাক হয়ে বললেন, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। একটু খুলে বলবেন?

অবশ্যই। যে-রাতে শান্তা খুন হয়েছিল, সেই রাতে সুজয় তার দাদা দেবদূতকে নেওয়ার জন্য ওই বাড়িতে এসেছিল মনে আছে তো?

হ্যাঁ মনে আছে।

ও কিন্তু অনেকটা পরে ঢুকেছিল। ঢোকার সময় ও দেখেছিল একজন লোক অন্যমনস্ক ভাবে পায়চারি করছে বাড়ির সামনে বৃষ্টির মধ্যেই। রেইনকোট পরা থাকলেও ভিজে যাচ্ছিল। লোকটার সাথে ঠোকাঠুকিও হয়ে যায় সুজয়ের। সুজয় ভেবেছিল আশেপাশের কোনও বাড়ির লোক হবে হয়তো, কৌতূহলবশত দেখতে এসেছে। তবে চেহারাটা মনে রেখেছিল। ওর বর্ণনা শুনে আমার সন্দেহ হয়। কিছুটা কৌতূহলবশেই অভীক পাত্রের ছবি দেখাই সুজয়কে। সুজয় কিন্তু এক দেখাতেই আইডেন্টিফাই করে ফেলে। আমি কনফার্ম হওয়ার জন্য কয়েকদিন কন্টিনিউ ফলো করি অভীক পাত্রকে। দেবলীনার মায়ের ব্যাপারটাও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যায়।

কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও অভীক পাত্র ওখানে কী করছিলেন?

আমার মনে হয় রক্তমাখা গ্লাভসটা উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। মনে হয় ওটা নিয়ে ওর মনে টেনশন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। থানাতে পৌঁছে ওর মুখেই সব শোনা যাবে। ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আর একটা গাড়ি ও এক্সট্রা ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছেন স্বযং ডিসিপি। উনি যে আজ কতটা চাপমুক্ত হয়েছেন তা ঈশ্বর জানেন। আমিও আজ একটু মনের শান্তিতে ঘুমোতে পারব। আপনাদেরও খুব ধকল গেছে। সব মিলিয়ে আমরা কিন্তু পারলাম।

বিকাশ হেসে বলল, তোমার সাথে কাজ করে আমরাও খুব আনন্দ পেয়েছি।

রক্তিম জানালার ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাচ ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে একটা স্বস্তির প্রশ্বাস ছাড়ল। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অবিরাম…। যেন আকাশ ভেঙে পড়বে।

                             সমাপ্ত

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...