সন্ধে ছুঁই-ছুঁই। রাস্তার ধারে বাতিস্তম্ভের আলোগুলি জ্বলে উঠছে ক্রমশ। ঘোলাটে আলো  ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। যানবাহন আর লোকজনের কোলাহলকে সঙ্গী করে ঋক হেঁটে চলেছে ফুটপাত ধরে। বৈঠকখানা বাজার অঞ্চলের ভিড় ঠেলে বেশ জোরে-জোরে হাঁটার চেষ্টা করছে ঋক।

‘নবদিগন্ত নাট্যসংস্থা’-র অফিসঘরের দরজার সামনে ঋক যখন পৌঁছোলো,এক অদ্ভূত উদ্বেগে ততক্ষণে ঘেমে গেছে সে।

কলিংবেল টিপল ঋক। দরজা খুললেন বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ও নির্দেশক প্রাণেশ  মুখোপাধ্যায়। ঋককে দেখে কিছুটা চমকে গেলেন তিনি।  ‘কী ব্যাপার, রিহর্সাল রুম-এ না গিয়ে তুমি হঠাৎ এই অফিসঘরে? ‘

‘স্যার, খুব বিপদে পড়ে এলাম এখানে । ট্রেন-এর মান্থলি টিকিটটা হারিয়ে ফেলছে আমার বন্ধু। টিটি ধরেছে। ১২০০ টাকা ফাইন করেছে তর্ক-বিতর্ক হওয়ার কারণে। এখনই না দিলে অ্যারেস্ট করে কোর্টে চালান করে দেবে বলেছে। আমাকে ফোন করে সাহায্য চাইল। কিন্তু, গাড়ি ভাড়া বাদ দিলে, আমার কাছে মাত্র ২০০ টাকা আছে। স্যার,প্লিজ আমাকে ১০০০ টাকা দিন, কাল এসে ফেরৎ দিয়ে যাব।’—-কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে ব্যক্ত করল ঋক।

‘আরে শান্ত হও। তুমি তো ঘেমে গেছো পুরো! দাঁড়াও, দিচ্ছি টাকা।’

মানিব্যাগ বের করে প্রাণেশ এবং সুমিতাভ মুখোপাধ্যায় দু’জনে ৫০০ করে মোট ১০০০ টাকা  ঋকের হাতে তুলে দিলেন। প্রাণেশ বললেন, ‘ফাইনটা দিয়ে তুমি রিহার্সাল রুম-এ চলে এসো।’

আধা ঘন্টা পরে ছকু খানসামা লেন-এর মহড়াকক্ষে ঋক গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মহড়ায় যোগ দেয়নি। অন্য এক শিক্ষার্থীর হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল, ‘শোনো সায়ন, আজ রিহার্সাল করতে পারছি না, এই চিঠিটা দুই স্যার-এর মধ্যে কোনও একজনের হাতে দিয়ে দিও প্লিজ।’

সায়ন আশ্বস্ত করার পর, মহড়াকক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে  হস্টেল-এর উদ্দেশে রওনা দেয় ঋক।

শিয়ালদহ থেকে বাসে নেতাজি নগর পৌঁছোতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগল ঋকের। বাসে থাকাকালীন একটা বিষয় ভেবে,বারবার হাসি পাচ্ছিল তার কিন্তু একা-একা হাসলে লোকে পাগল ভাবতে পারে, অতএব, মুখে হাত ঢাকা দিয়ে খুব কষ্ট করে হাসি চেপে রেখেছিল সে। তাই, হস্টেল-এ নিজের ঘরে ঢুকে, জুতো, জামাপ্যান্ট না ছেড়ে, বিছানায় শরীরটাকে অর্ধেক এলিয়ে দিয়ে হেসেই চলেছে ঋক।

হাসিটা আসলে অভিনয় সাফল্যের। কোনও মঞ্চে কিংবা রুপোলি পর্দায় ভালো অভিনয় করে প্রশংসা কিংবা পুরস্কার পেয়ে নয়। কিন্তু ঋক আজ এমন এক অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছে, যার সাফল্যে সে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ায় মতো আনন্দ উপভোগ করছে।

এরই মাঝে ঋকের মোবাইলটা বেজে উঠল।

সায়নের ফোন।

হাসি চেপে রেখে ঋক বলল, হ্যাঁ, সায়ন বলো—-কী ব্যাপার—–

…….গুরু, চিঠিতে কী লিখেছো ! প্রাণেশ স্যার পড়ার পর,সুমিতাভ স্যারকে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পাক্কা শয়তান ছেলে।’

হাসতে হাসতে ঋক জিগ্যেস করল সায়নকে, ‘আর সুমিতাভ স্যার চিঠি পড়ে কী বললেন?’

‘কিছু বললেন না, সিগারেট আর দেশলাইটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।’

সায়নের ফোনটা ছাড়ার পর ঋকের হাসি দ্বিগুণ হল। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিজের হাতে লেখা সেই চিঠির বয়ান…….

মহাশয়দ্বয়,

মহড়ার খরচবাবদ প্রথম মাসে ৫০০ টাকা আমার থেকে নিয়েছিলেন আপনারা। চলতি মাসেও ৫০০ টাকা চেয়েছিলেন। টিউশন-এর টাকা পেলে দিতামও হয়তো। কিন্তু, প্রায় দেড় মাস ধরে দেখলাম, খবরের কাগজে প্রতি সপ্তাহে ‘অভিনেতা চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে শুধু টাকা কামাচ্ছেন,নাটক মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্য যে নেই, এটা বেশ বুঝতে পারলাম। কিন্তু এ তো এক রকম প্রতারণা ! তাই, এ মাসে আর ৫০০ টাকা খোয়াতে চাইলাম না। পরিবর্তে, যা দিয়েছিলাম আর  আমার যাতায়াতের খরচ বাবদ আরও ৫০০ টাকা, অর্থাৎ মোট ১০০০ টাকা আজ আদায় করে নিয়ে এলাম।

আসলে কী জানেন স্যার, অন্যায় যে একেবারেই সহ্য করতে পারি না, তা আজ শৈল্পিক দক্ষতায় প্রমাণ করে এলাম।

আশাকরি, মনে রাখবেন আমাকে।

——–

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...