সম্প্রতি আমাদের দেশের বিজ্ঞানী ড. পলাশ সেনের নাম প্রতিদিনই খবরের কাগজে বেরোচ্ছে। জানা গেছে তাঁর একটি আবিষ্কার, যেটি এখনও গোপন আছে, সেটির ঘোষণা তিনি করতে চলেছেন খুব শীঘ্রই। তবে সেটি সারা বিশ্বের কাছে এক অভতপূর্ব আবিষ্কার হবে বলে সকলের ধারণা।

তাজা খবর কাগজের সম্পাদক, সৌমিত্রবাবু এ সুযোগ আর ছাড়তে চাইলেন না। তিনি ফোন করলেন বিজ্ঞানী ড. পলাশ সেন-কে এবং অনেক অনুরোধ করে বললেন, দেখুন আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। মাত্র আধঘণ্টা সময় আপনার থেকে চাই।

অনেক ভেবে-চিন্তে সেনবাবু বললেন, ঠিক আছে আজ সন্ধে সাতটায় আসুন। তবে ব্যাপারটা যেন খুব গোপন থাকে। না হলে মিডিয়ার লোকেরাও আমাকে ছেঁকে ধরবে।

কথামতো সৌমিত্র ভট্টাচার্য অফিসের সব কাজ সহ-সম্পাদক-কে বুঝিয়ে দিয়ে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বেশ উত্তেজিত বোধ করছিলেন। এরকম একজন বিজ্ঞানীর সাথে দেখা হবে ভেবেই খুব খুশি হচ্ছিলেন। যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলেন বিজ্ঞানী ড. সেনের গবেষণাগারে। ড. সেনের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সৌমিত্রবাবুকে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা এবার বলুন আপনি আমার থেকে কী জানতে চান?

—আচ্ছা, একটা উড়ো খবর শুনছি, আপনি নাকি টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছেন এবং সেটির ঘোষণা আগামীকাল সাংবাদিক সম্মেলনে করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবেন! কথাটা কি ঠিক?

—ঠিকই শুনেছেন। আচ্ছা, আপনি কি টাইম মেশিনের কথায় বিশ্বাস করেন?

—স্যার, আজকাল অনেক শুনছি, তবে ব্যাপারটা যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কীভাবে এটা সম্ভব! এ নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব রয়েছে মনের মধ্যে।

—চলুন পাশের ঘরটায় যাওয়া যাক। ওটাই আমার স্পেস শিপ।

একথা বলেই দুজনে গিয়ে পাশের ঘরটায় বসলেন। দেখলেন নানা রকমের লাল, নীল আলো জ্বলছে। কোনওটা থেকে বিপ বিপ আওয়াজ আসছে। বিজ্ঞানী বললেন, ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নেই। আপনি হলেন ভারতবর্ষের প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি এটা দেখাতে চলেছি। আগামীকাল সারা বিশ্ব এটা জানবে। কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। তাঁর চোখ মাথার ওপর সিলিংয়ে দিকে। গভীর ভাবনায় ডুবে গেলেন তিনি।

সৌমিত্রবাবু ভাবছেন, অফিসে অনেক কাজ জমে আছে। এখানে বেশি দেরি হয়ে গেলে খুব মুশকিল হতে পারে অফিস পৌঁছোতে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের বুদ্ধিকে একটু কাজে লাগালেন। হঠাৎ হাত থেকে পেনটা মেঝেতে ফেলে দিলেন। পেনটা মেঝেতে পড়ে যেতেই তত্ক্ষণাৎ একটা জোরে বিপ সাউন্ড হল। আর ড. সেন  সংবিৎ ফিরে পেলেন।

ড. সেন বললেন, আচ্ছা, আপনার সাথে এমন কখনও হয়েছে যে, আপনি অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন আর নিমেষেই অফিসে পৌঁছে গেলেন, অর্থাৎ গন্তব্যস্থানে! কীভাবে পৌঁছোলেন, কোন রাস্তা ধরে গেলেন তার কোনও কিছুই আর হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না।

আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে সৌমিত্রবাবু বললেন, না, স্যার আমার তেমন কখনও হয়নি। এরকমও কি হয়! আপনি তাহলে বলুন, আমি শুনছি।

আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন, বললেন, গত সপ্তাহের সকালে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে আমি আমার ড্রইং রুম-এ সকাল ৮টায় টিভি খুলে একটা ভালো সাক্ষাত্কার দেখছিলাম। দেখতে দেখতে একটা কাজে এই ঘরটাতে এসে কাজটা শেষ করতে থাকি এবং এই ঘরের টিভিটা চালাই। হঠাৎ দেখি টিভিতে ওই চ্যানেলে তখন খবর পড়া চলছে। ভালো করে দেখে বুঝলাম তারিখটা ৩ জানুয়ারি সকাল ৮টা দেখাচ্ছে। ভাবলাম নিজের মাথাটা হয়তো ঠিক কাজ করছে না। কিন্তু বাইরে গিয়ে ওই টিভি-তে দেখলাম আগের সাক্ষাত্কারটাই চলছে। তখন একটু নড়েচড়ে বসলাম। বুঝলাম আমার গবেষণা সার্থক রূপ নিতে চলেছে। ৩ জানুয়ারি বাইরের ঘর থেকে ওই সময়ে ওই চ্যানেল খুলে দেখলাম আমার এই ঘর থেকে দেখা খবর পড়া অনুষ্ঠানটাই দেখানো হচ্ছে। সাধারণত এমন হওয়ার কথা নয়। তখন বুঝলাম আমার স্পেস শিপ-টা কাজ করছে।

এসব শুনতে শুনতে সৌমিত্রবাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তা কী করে সম্ভব, যদি না…

ড. সেন বললেন, ঠিক ধরেছেন। যদি না আমি কোনও স্পেস শিপে গতিশীল থাকি। তাই না? আমার এই ঘরটা কোনও স্পেস শিপ নয়। তবে স্পেস শিপের মতোই। আমাদের ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরা পারে না কি বলতে পারেন? আমরা যে-সব রকেট পাঠাচ্ছি তা অনেক কম খরচে। চাঁদে যে-রকেট পাঠানো হয়েছিল তার জন্য যে অনেক কম খরচ হয়েছিল, তা তো আপনারা সবাই এখন জেনে গেছেন।

শুধু তাই নয়, ২৭ মে বাইরের ঘরে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে পেনটা নিতে এই ঘরে ঢুকেছিলাম। পেনটা নিয়ে যখন বাইরের ঘরে ফিরে গেলাম, দেখলাম রামু আমার টেবিলে ২৮ ও ২৯ মে-র খবরের কাগজটা রেখে গেছে। এই ২৮ তারিখটা আমার জীবন থেকে কোথায় হারিয়ে গেল বুঝলাম না। আমার ড্রাইভার, চাকরবাকর, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে আমার সহকর্মীদের কেউই ২৮ মে আমাকে দেখতে পায়নি।

সৌমিত্রবাবুর গলাটা তখন যেন কেমন শুকিয়ে কাঠ হওয়ার জোগাড়। ভাবতে লাগলেন, এ তো দেখা যাচ্ছে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের থিযোরি অফ রিলেটিভিটিকেও ডাইভার্ট করছে এই ঘটনা। এমন ঘটনা, যার কোনও ব্যাখ্যা নেই!

—আপনার তো ভুল হতে পারে। আপনি হয়তো আসলে ২৯ মে-তেই এ ঘরে এসেছিলেন। বেশ শুকনো গলায় সৌমিত্রবাবু কথাগুলো বললেন।

আবার উদাস হয়ে গেলেন ড. পলাশ সেন। তারপর হঠাৎ বললেন, আপনি কটায় আমার বাড়িতে এসেছিলেন সৌমিত্রবাবু?

—ঠিক সাতটায়। সৌমিত্রবাবুর ঠিক মনে আছে কারণ কলিংবেলটা টেপার সময় মোবাইল-এ সময়টা দেখেছিলেন। হ্যাঁ, সাতটাই বেজেছিল তখন।

—এর মধ্যে কতক্ষণ হল আপনার সাথে আমি কথা বলছি? প্রায় আধঘণ্টা তাই না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—তাহলে তো এখন সাড়ে সাতটা বাজার কথা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কিন্তু ঘড়িটা দেখুন তো।

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন সৌমিত্রবাবু। কিন্তু এ কি করে সম্ভব! ঘড়িতে সাড়ে দশটা দেখাচ্ছে। সৌমিত্রবাবু ভাবলেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এ ঘড়িটা হয় খারাপ, নয়তো ইলিউশন। তিনি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলেন, তাতেও সাড়ে দশটা দেখাচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব! ভাবতে থাকেন অবাক হয়ে।

—ভাবছেন আমি বিজ্ঞানের কোনও এক্সপেরিমেন্ট করছি? হেসে জিজ্ঞেস করলেন বিজ্ঞানী সেন। বলতে বলতে নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন বিজ্ঞানী।

—আমি তাহলে এবার চলি। অনেক রাত হল, বলেই সৌমিত্রবাবু বেরিয়ে গেলেন। ফেরার জন্য গাড়িতে চড়ে আবার মোবাইলটা দেখলেন। তখনও দেখাচ্ছে রাত ১০টা ৪০ মিনিট। ভাবলেন কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। আজ আর অফিসে ফিরবেন না, সোজা বাড়ি ফিরে যাবেন। অফিসে ফোন করে বলে দিলেন খবরটা সহ-সম্পাদককে দিয়ে দিতে।

সৌমিত্রবাবু গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলেন, একটু আগে ঘড়িতে এবং মোবাইল-এ যখন সাড়ে দশটা দেখলেন সেটা কোনও ভ্রম বা ম্যাজিক নয়তো? ড. সেনের ঘরটা কোনও ম্যাজিক ঘর নয়তো? বিজ্ঞানীর সমস্যার সমাধান হয়তো করা যাবে, একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। এরকম নানা উদ্ভট কল্পনা করতে করতে বাড়ি এসে পৌঁছোলেন। বাড়িতে ফোন করবেন ভাবলেন কিন্তু ফোনে চার্জ শেষ হয়ে গেছে। এরকম তো হয় না সাধারণত। আজ সকালেই পুরো চার্জ দেওয়া হয়েছিল। নতুন মোবাইল, তাই প্রায় দুদিন অনায়াসেই চলে যায়। কিন্তু এরকম হল কেন! আজ সবই যেন কেমন ওলটপালট লাগছে। এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে বাড়িতে এসে পৌঁছোলেন সৌমিত্রবাবু।

বাড়িতে ঢুকতেই তাঁর ছোটো মেয়ে রিঙ্কি ছুটে এলো। চেঁচিয়ে বলতে লাগল মা, দাদা, দেখে যাও বাবা এসেছে!

অমনি সবাই হুড়মুড় করে ড্রইংরুমে এসে ঢুকল।

—কী হয়েছে? তোমরা এত হইচই করছ কেন? বিরক্তির সুরে জানতে চাইলেন তিনি।

স্ত্রী সুমনাদেবী বলে উঠলেন, হইচই মানে!  শুনলাম কাল বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে। তারপর থেকে তোমার আর কোনও খোঁজ নেই। আর তুমি বলছ আমরা হইচই করছি। কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন সুমনা। আমাদেরকে মানুষ বলেই মনে হয় না তোমার না!

তার কান্না সৌমিত্রকে আচ্ছন্ন করল বটে কিন্তু তাঁর জীবন থেকে যে একটা দিন হারিয়ে গেল সেই অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারলেন না!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...