তিরিশ বছর পর সেই সেন্টেনারি বিল্ডিংয়ে সিঁড়িতেই বসে পড়লাম আমি। রাই আজই এই কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে প্রথম ক্লাসে এল। আমি বাংলা পড়েছি বলে নয়, রাই ওর নিজের পছন্দেই বাংলা পড়ছে। আমি একপ্রকার জোর করেই ওর সঙ্গী হয়েছি। বলেছি, চল না, তোকে ইউনিভার্সিটির গেটে এগিয়ে দিয়ে আমি অফিস যাব ’খন। আমার আজ অত তাড়া নেই। রাই বলেছে, তুমি চাপ নিচ্ছ কেন আমি কি কচি খুকি নাকি?
আসলে আমি এসেছি এক অমোঘ টানে। তিরিশ বছর আগে আমিও যে বাংলা পড়তে এসেছিলাম এখানে। এই আশুতোষ বিল্ডিংয়ে আমাদের ক্লাস ছিল। সবই প্রায় একইরকম আছে। শুধু শাড়িতে সজ্জিত দীপারা হারিয়ে গেছে। এ যুগের দীপারা স্কিন টাইট জিন্সে আর টাইট টপে, লেগিংস আর কুর্তিতে বেশি স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। ওদের ভিড়ে সালোয়ারে শোভিত দীপাও আছে কয়েকজন। আমার মেয়ে রাই-ও তাদের দলে।
রাইকে আমার ছাত্রাবস্থার সব গল্পই বলেছি। তবে দীপার কথা রাই জানে না। রাইয়ের মা কেয়াকেও বলিনি। বলব কী? সে বড়ো ব্যথার অধ্যায়। আমার জীবনের সেই করুণ কাহিনি শুনিয়ে মেয়ের করুণা কুড়োতে চাইনি আমি।
বললে কেয়া, দীপার কথা তুলে উঠতে বসতে খোঁচা দিতে ছাড়ত না। সে আমার বুকের অতলে ঘুমিয়ে থাকা গভীর গোপন ইতিবৃত্ত। সত্যি বলতে কী, তিরিশ বছর আগের এই বাংলা ডিপার্টমেন্টের সেই অপরূপা দীপাই আজ আমাকে এখানে টেনে এনে বসিয়ে দিল। রাই হাত নেড়ে আশুতোষ বিল্ডিংয়ে ঢুকে উঠে গেল। আর আমি এক মর্মান্তিক স্মৃতির ভারে বসে পড়লাম সেন্টেনারি বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে।
দুই হাঁটুতে দুই কনুই ঠেকিয়ে দুই হাতের বেষ্টনিতে মাথা নত করে কপালের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজলাম। কী আশ্চর্য! চোখ বুজতেই আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দৃশ্যমান হল তিরিশ বছর আগের এক রোববারের দুপুর। সেই আউট্রাম ঘাটে। একেবারে চলচ্চিত্রের মতো ঘটনা পরম্পরা! আমার হৃৎপিণ্ড কাঁপিয়ে দিয়ে দীপা বলল, চল নৌকো চড়ি। দীপা উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির পাটে খানিক আঙুল চালিয়ে নিয়ে ফের বলল, নে ওঠ।
নৌকো চড়বি কী রে? প্রশান্ত আসবে না? সত্যিই যেন ব্যাপারটা আমার অবাক লাগল। আসলে এর চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে? না ঠিক সুখ বলা যায় কি? একটা খুশির হাওয়ায় ভেতরটা দুলে উঠেছিল নৌকো চড়ার কথা শোনামাত্র। সস্তার সুখ আমি চাইনে। বড়ো কথা যখন জানিই দীপার প্রেমিক আছে।
দুপুর দুপুর ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আউট্রামের জলপুলিশ অফিসের কাছাকাছি গঙ্গামুখী কাঠের বেঞ্চিতে বসে আছি, আমি আর দীপা। প্রশান্ত এল না। তার জন্যে দীপার খুব একটা এল-গেল বলে মনে হল না। কেন কে জানে? কথা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের দু-দুটো ঘন্টা পরেও ওর প্রেমিক এল না। তা নিয়ে দীপার উদ্বেগ তো ছাড়, সামান্য ভাবনা হল বলেও বোঝা যায়নি। তার ওপর নৌকো চড়তে চায় শুনে সত্যিই অবাক লাগল আমার!
কথার ফাঁকে আমিই বলেছি, কী হল তোর প্রশান্তর? এটুকু নেহাতই সৌজন্য। যার অনারে আসা সে-ই এল না। এ নিয়ে আমার যেন বড়ো আফশোশ হচ্ছিল। বুকে হাত দিয়ে বলতে গেলেই তো সত্যিটা ফাঁস হয়ে যাবে। পারব সত্যিটাকে ঢেকে দিতে? আসলে প্রশান্ত না আসুক, মনেপ্রাণে আমি সেটাই যে চাই, দীপাকে কি তা বুঝতে দেওয়া যায়?
দীপার সঙ্গে আজকে এই মুহূর্তগুলোর পুরোপুরি আনকোরা স্বাদ আমার। এর আগে কি কোনওদিন ভাবতে পেরেছি যে, এমন একটা দিনও আসতে পারে? দীপা আমার এত কাছাকাছি ঘন্টা দুয়েক বসার পরেও একান্ত নিভৃতে নৌকোতেও না জানি আরও কতক্ষণ থাকবে। তবে? বোকার মতো আমি এটা কী করে চাই যে প্রশান্ত এসে এই অনন্য মুহূর্তগুলো কেড়ে নিক? আর আমি বাঁয়ে চলে যাই।
দীপা না জানলেও এটা তো ঠিক যে, দীপার কাছে থাকলে আমি সব ভুলে যাই স্মৃতি বিস্মৃতির পরোয়া করি না। তাছাড়া কোন পুরুষই বা না চায় দীপার মতো ষোলোকলা পূর্ণ নারীর সঙ্গে দিনের চার-পাঁচ ঘন্টার আপস সান্নিধ্য? উপরি পাওনার মোহ যখন মানুষের সহজাত, তখন তো কোনও প্রশ্নই আসে না। অনেকে আদর্শের কথা বললেও আমি অত আদর্শবান হতে পারিনে।
সমরের মুখে শুনেছিলাম কথাটা প্রথম। বিশ্বাস হয়নি। তারপর এর-ওর মুখে গোপন মূল্যবান খবরের মতো ছড়াতে দেখে সেদিন দুপুরের দিকে সোজা চলে গেলুম বুবুনদিদের বাড়ি।
বুবুনদির বাবা নেই। তবে পৈতৃক ভিটেবাড়ি অর্থাৎ ঠাকুরদার আমলের মোটা মোটা থাম্বা দেওয়া অদ্ভুত বাড়িতে অনেকগুলি ঘর। এখন সব ভাড়া দেওয়া আছে। তবু বুবুনদির নিজস্ব একটা আলাদা ঘর আছে। সে ঘরে সচরাচর কেউ আসে না। বুবুনদির ছোটো ভাই বা বোনেরা, মাসিমা, কেউই।
মোমের আদলে ছিপছিপে গড়নের বুবুনদি। বিলুদার সঙ্গে বুবুনদির সম্পর্কের কথা কারুরই যেমন অজানা ছিল না, তেমনি কারুরই জানতে বাকি নেই, সেই সম্পর্ক ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কেন? জানতে চেয়েছি। বুবুনদি বলেনি কিছুই। তবে সমরের মুখে যা শুনেছি, তার সত্যি-মিথ্যে আমাকে জানতে হবে। গিয়ে দেখি বুবুনদি বাড়ি নেই। খানিক আগেই বেরিয়েছে কোথায়। মাসিমা বললেন জানি না।
কথা না বাড়িয়ে গিয়ে বুবুনদির ঘরে টান টান হয়ে শুয়ে থাকলাম। বুবুনদির ঘরের সব আসবাবে, বিছানায় একটা বহু ব্যবহারের ছাপ। সারা সংসারেই একটা অস্বচ্ছলতার অনাবিল ছবি ফুটে ওঠে। বুবুনদির বাবা বেঁচে থাকতে তাদেরই এই চত্বরের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন বলে মনে হয়েছে। একটা বিদেশি ফার্মের স্টেনো ছিলেন বুবুনদির বাবা। আমি ইংরেজি নিয়ে আসতাম এ বাড়ি।
কেউ জানত না, তখন আমার মনে হয়েছে বুবুনদির মধ্যে একটা অলক্ষ্য মাতৃত্ব আছে। বুবুনদির কাছে নিরাপদ মনে হয়েছে, সে যা-ই ঘটুক না কেন। সেই আমারই মধ্যে কখন যে ধীরে ধীরে কামনার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল! বুঝলাম সেদিন, যেদিন অনাবশ্যক ভাবে বুবুনদিকে জড়িয়ে ধরে গলার কণ্ঠায় চুমু খেয়ে বসলাম। কিছু বলেনি সেদিন বুবুনদি আমায়। আর তার জন্যেই আমার বাড় বেড়ে গেল। একটা পাপবোধ ভেতরে ভেতরে দানা বেঁধে উঠতে লাগল।
বুবুনদির কাছে গেলেই সেই একই ভাবনায় কেঁপে উঠত বুকের ভেতরটা। সেরকম একদিন আরও। হুট করে জড়িয়ে ধরে বুবুনদির বুকের রেখায় অনবরত চুমু খেতে লাগলাম। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বুবুনদি বলেছিল, অসভ্য কোথাকার! এভাবে কেউ দিদিকে আদর করে? লজ্জায় অপমানে বিপন্ন ফেরারির মতো পালিয়ে এসেছি সেদিন।
ছোটো বোন শিলুকে দিয়ে খবর পাঠালেও বুবুনদির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি। প্রাণ খুলে সেই থেকে বুবুনদি বলে আর ডাকতে পারিনি। ভাবলে নিজের ওপর ঘৃণায় গা শিরশির করে ওঠে। কলজে চুঁইয়ে অনবরত ঘৃণার ঘাম নেমে আসে। সেই বুবুনদিকে নিয়ে এমন একটা ভযংকর কথা এ-মুখ সে-মুখ হচ্ছে। বুবুনদির কাছেই তার সত্যিটুকু জেনে নিতে হবে। বুবুনদির বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্নের মতো ঘুম এসে যাচ্ছিল।
সন্ধের পর বুবুনদি এল। আলোর সুইচ চেপে দিয়ে আমাকে দেখে বলল, কখন এসেছিস? আমি সে কথাকে পাশ কাটিয়ে গেলাম।
—সরাসরি বললাম, তোমাকে নিয়ে কীসব কথা চালাচালি হচ্ছে খবর রাখো?
ভাবলেশহীন বুবুনদি বলল, আমি জানি। যা শুনেছিস সব সত্যি।
—তার মানে? সহসা আর কোনও কথা বেরোল না আমার মুখ থেকে।
বুবুনদিই বলল, আবার তুই জানতে চেয়েছিলি না, তোর বিলুদা কেন আসে না? এজন্যই আসে না। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, ইডিওলজি ধুয়ে জল খাই আর এত বড়ো সংসারটা ডুবে যাক।
—তাই বলে তুমি ছবি আঁকিয়েদের সামনে ওভাবে…
—চুপ কর, হালকা ধমকে উঠেছিল বুবুনদি। দেহ ভাঙতে রাস্তায় বেরোলে খুশি হতিস?
বাঁচার জন্য বুবুনদি কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। তাকে নিরাবরণ দাঁড়াতে হয় ছবি আঁকিয়েদের সামনে। দীপার সামনে এলেও আমি ওই সব ছেঁদো আদর্শের তোয়াক্কা করি না। করি না বলেই অন্যের প্রেমিকা জেনেও নিছক আদর্শের জন্য দীপার সঙ্গে একই মন নিয়ে মেলামেশাতে পিছপা হই না। হওয়ার সাধ্যিও নেই আমার। কেবল দীপার চোখ দুটো যেন এক অমোঘ শাসনে বেঁধে রাখে আমার সম্পূর্ণ সত্তাকে। কেন? তা জানিনে।
—কী হল ওঠ! নৌকায় চড়ার জন্য এবারে তাড়া দেখিয়ে আমার হাতে হেঁচকা টান দিয়ে আমায় দাঁড় করাল দীপা।
—আমি বললাম, হঠাৎ ক্ষেপে গেলি কেন নৌকোয় চড়ার জন্য?
—তুই আয় তো বলেই, দীপা খেয়াঘাটের দিকে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। আমিও পিছু নিলাম। আবারও বললাম, তোর প্রশান্ত তাহলে এলই না।
—ধুর, ছাড় তো ওর কথা। নিজের প্রেমিক সম্পর্কে এত নিস্পৃহতা, উদাসীনতা কারও থাকতে পারে? দীপাকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না আমার।
দীপার পেছন পেছন আমি খেয়াঘাটের সিঁড়ি ভাঙছিলাম। পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দীপা জিজ্ঞেস করল, এর আগে নৌকো চড়েছিস কোনওদিন?
আমি বললাম, না।
—কেন চড়িসনি!
—বা রে! আমরা তো নর্থ বেঙ্গলেই ছিলাম বেশি।
সিঁড়ি শেষ হতেই প্যাচপ্যাচে কাদার ওপর জোড়া জোড়া ইট পাতা, এক হাত মতো ফারাকে ফারাকে।
—দীপা বলল, আমার হাতটা একটু ধর। আমি চট করে ধরে ফেললাম হাতটা। সাবধানে পায়ে পায়ে এগোতে থাকলাম।
দীপাকে আজ আমি যেন নতুন করে চিনছি। আবিষ্কার করছি। মাঝে মাঝেই দীপা আমার শূন্যবুক ভরে দিয়ে তাকিয়েছে। দীপা এত অদ্ভুত তাকাতে পারে? ছেলেমানুষের মতো আমার মনে হয়েছে দীপাকে যদি আমি নিজের করে পাই, আর ও যদি আমার দিকে এভাবে তাকায়, তাহলে সাতজন্ম আমার ক্ষিদেই পাবে না!
এখনও পর্যন্ত খুব একটা হইচই কথার ফুলঝুরি উড়িয়েছে, তা না। অল্পস্বল্প যে দু-চার কথা বলেছে আর ছেলেমানুষি হেসেছে, তাতে আমার মনে হয়েছে, দীপাকে এখন আমি অনেক শক্ত কথাও অবলীলায় বলে দিয়ে স্টেডি থাকতে পারব, মুখ থুবড়ে পড়ার ভয় নেই কোনও। শক্ত কথা বলতে তো ওই একটাই কথা আমার মনে ঘুরপাক খায়। তা হল, দীপা আমার মধ্যেই প্রশান্তকে খুঁজে নিক না।
—এসব ভাবা খুবই অন্যায়। বুঝি সেটা। দীপা ঘুণাক্ষরেও টের পেলে কেলোর একশেষ হবে। বলবে, তলে তলে তুই এতটা উত্তীয়!
—এতটার কী আছে? তোকে ভালো লাগে, তোকে ভালোবাসি, ব্যস। মোদ্দা কথা, তোকে ছাড়া আমি সিনেমার হেমামালিনীকেও কল্পনা করতে পারব না।
—কল্পনা করতে পারব না, আবদার আর কি! কুমির তোমার জলকে নেমেছি, ছেলেখেলা যেন।
—কোনও কিছুই ছেলেখেলা নয়। বস্তুত, দীপার প্রেমিক আছে, ভেবে নিজেকে সচেতন করে গুটিয়ে নেওয়ার আগেই তো ভরাডুবি হয়ে গেছে। ছেলেখেলা তো দীপাই করেছে গোড়া থেকে। নইলে প্রথম দিন করিডোরে অপরিচিতের দিকে ওভাবে কেউ তাকায়? প্রাণান্ত ইশারা করে কেউ হাসে ওভাবে? অন্তত নিজের একজন প্রেমিক যখন আছে! আমার বুকে কার্তিকের হিম জমাট বেঁধে আছে সেই থেকে। দীপার জন্যই তো। দীপা ছাড়া অন্য কারুর তোপে কি সে হিম ছাড়বে বুক থেকে?
মেয়েদের মধ্যে সুমিতার সঙ্গেই প্রথম আলাপ হয়েছিল। সুমিতাই দীপাকে ডেকে পরিচয় করিয়েছিল আমার সঙ্গে। দু’চার কথা বিনিময় হয়েছে সবে, তখুনি অসীম এসে সুমিতাকে ডেকে নিল। সুমিতা চলে গেলেও দীপা যাওয়ার কোনও লক্ষণই দেখাল না যখন, তখন আমিই বা কী করে হুট করে চলে আসি? দীপার মতো মেয়ে সামনে দাঁড়ালে অনেক আচ্ছা আচ্ছা কলিজাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। তবু সৌজন্যের খাতিরে কিছু একটা বলে তো আমাকে রেহাই পেতে হবে।
সহসা ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলতে গেলাম, আপনাকে আগেই দেখেছি। কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই সে হাসি বিপন্ন ম্লান হয়ে ঠোঁটের আগায় ঝুলে পড়ল। দীপা দমকে হঠাৎ এমন ভাবে হেসে উঠল, মনে হল কাচের জার মেঝেয় পড়ে ভেঙে চৌচির হল। আমার অস্বাভাবিক ভেতরটা কি ও বুঝতে পারল? এভাবে হেসে উঠল যে!
দীপার ফর্সা দুপাটি দাঁত এক হতেই সে বলল, আমাকে আপনি কেন? সংকোচের কাঁটা সরে গেল অনেকটা।
—সহসা বললাম, এখানে সবাই তুই-তুকারি করে। আমি চট করে কাউকে তুই বলতে পারি না। আমার আসে না।
দীপা বলল, আমাকে তুমি তুমিই বলো।
—তার মানে? তুমি বলবে আর আমি বাধ্য শিশুর মতো তোমার কথাকে শিরোধার্য করে তোমাকে তুমি তুমি করে তোমার ওপর আমার দুর্বলতাকে সাড়ম্বরে জানান দিই আর কী!
আমার মনের ভেতরে কেন জানি এসব বুদবুদের মতো ভেসে উঠতেই আমি বলে বসলাম, এখানে সবাই যখন তুই বলতে পারে, তখন আমাকেও তো চেষ্টা করে পারতে হবে। কথাগুলোকে এমন ধীরে-সুস্থে বললাম, যেন দীপার মতো অমন ডানাকাটা পরি গোছের একটা সুন্দরী মেয়েকেও মনে হতে থাকে, কই তেমন তো কিছু দেখলাম না আমার চোখে! এমনই উন্নাসিক ভাবে তাকাতে গেলাম ওর দিকে। কিন্তু সত্যিকারের আগুনে কি আর শিশির ভেবে হাত রাখা যায়?
আমার দিকে দীপার অদ্ভুত প্রগল্ভ চাউনি দেখে একটা তীব্র সুখ যন্ত্রণার আকারে বুকের রক্তে আঘাত করতেই সারাৎসার রক্ত নুয়ে পড়ছিল। তখনও কি জানতাম, এই দীপার একজন প্রেমিক আছে?
মেয়েদের চোখে আমি নাকি মুখচোরা গোছের। একথা বহুবার আমার কানে এসেছে। সুমিতা, দীপা ওরাও তাই ভেবেছে নিশ্চয়ই। তবে যে-অর্থে ওরা আমায় মুখচোরা ভাবে, সেদিক দিয়ে কারুর চাইতে কম যাই না আমি। তবু চট করে কারুর সঙ্গে তেমন ভাবে জমিয়ে নিতে পারি না।
সেই আমার সঙ্গে দীপার মতো সপ্রতিভ চরিত্রের মেয়ের পরিচয় হওয়াটা নিতান্তই দৈবাৎ। আরও বেশি দৈবাৎ ঘটনাটা ঘটে গেল ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন। কাউকে জানাইনি কথাটা। আগের দিন ঠিক করে ফেললাম মনে মনে। বলেও ফেলতে পারতাম। কিন্তু তুষার, অসীম, সুমিতার সঙ্গে দীপাও ছিল। রহস্যময় ভাবে কথাটা তাই চেপে গেলাম বেমালুম।
এখানে আমার এ বিষয়ে কেউ জানে না কিছু। তাই সামান্যও ধারণা বা আঁচ করতে পারেনি কেউ। সে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও কথাও ওঠেনি। তলে তলে ব্যবস্থা পাকা করেছি আমি একা। দীপা না থাকলে হয়তো শেষ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে বলেই ফেলতাম কথাটা। প্রথমদিন আলাপের পর দীপার সঙ্গে আমার আর কোনও কথাই হয়নি বলতে গেলে।
ইউনিভার্সিটিতে সবার সামনে মাঝেমধ্যে আমার সুপ্ত বাকপটুতার আত্মপ্রকাশ ঘটলেও, দীপা এসে গেলেই আমার ক বর্ণ কথাও নিতান্তই মূল্যহীন মনে হয়েছে। কেবলই মনে হয়েছে, যা বলেছি সে তো হাজার হাজার লোকের মুখের কথা। দীপাকে আমি এমন কথা শোনাই, যা শুনে দীপা চমকে যাবে। সম্পূর্ণ আলাদা গোছের, সম্পূর্ণ আনকোরা, দারুণ মূল্যবান, অথচ সহজ হৃদয়গ্রাহী। যে-কথা এর আগে কেউ বলেনি। এসব ভেবে বাকহীন জড়ের মতো সবার কথার মধ্যে বসে থেকেছি। মাঝেমধ্যে দু-চার কথায় সায় দিয়েছি। দীপার সঙ্গে সরাসরি কোনও কথা হয়নি। ও-ও বলেনি। আমিও সহসা পারিনি কিছু বলতে।
পরদিন নবীন বরণে এসেছি অনেক আগে থেকেই। তখনও কাউকে বলিনি কিছু। কাউকে বলে ফেললে হয়তো ভেতরটা অনেক হালকা হয়ে যেত। তবু সবাইকে চমকে দেওয়ার একটা তীব্র স্পৃহা কাজ করল মনে মনে। টেনশনটা সেজন্যই বাড়ছিল আরও বেশি। যতই সময় এগিয়ে আসতে লাগল, ততই কী হয়! কী হয়! ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল।
তখন অনেকেই এসে পড়েছে। দীপাও এই এল। হালকা আকাশি রঙের ফিনফিনে হাওয়ার মতো পাতলা গোছের শাড়িটায় কালচে বুটি। এই শাড়িটার জন্য দীপার শরীরের প্রভা আরও বেশি ফুটেছে নাকি? দু-একটা বিশেষ তারা যেমন আকাশে কখনও সখনও দেখা যায়।
সুমিতা, সোনালি, তুষার, বিমল ওরা এদিক ওদিক যাচ্ছে আসছে, কলকল করছে। আমিই কখনও ওদের কাছ থেকে খাপছাড়া হয়ে একা হয়ে যাচ্ছি। কেবলই মনে হচ্ছে শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে না। সুমিতার কখন এলির উত্তর দিতে গিয়ে তখন অস্পষ্ট গলা ক্ষীণ কেঁপে গেছিল। এখন হাত নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।
দীপাকে আজ যে-সারপ্রাইজ দেব, সেটা ওর পছন্দসই হবে কিনা তা নিয়ে যত ভয় ও সংশয়। একজনের গান আরেকজনের কাছে কান্না মনে হতে পারে। আবার কারও কান্না কারও কাছে গানের মতো মনে হতে পারে।
একসময় এমন ছিল, বুবুনদিকে আমার যখন তখন চমকে দিতে ইচ্ছে করত। শুধু মনে হতো, নতুন আরও নতুন ভাবে চমকে দিই বুবুনদিকে। তখন জানতাম না, পৃথিবীতে চমকে ওঠার মতো কোনও টাটকা ঘটনা আর নেই। সব ঘটনার রংই বিবর্ণ ফিকে হয়ে গেছে। নতুন করে রং চড়ালেও তাতে আর কোনও রোমাঞ্চ নেই।
বুবুনদি তুমি জানো না। তোমাকে চমকে দেওয়ার জন্যে আমি তোমার ঘরে খাটের নীচে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। বিলুদা এসেছিল তোমার ঘরে। তোমার সঙ্গে বিলুদাকে সেদিন ভালো দেখিনি আমি। লোকটা ভালো ছিল না। তুমি ভালো থেকো। ভালোবাসা নিও।
সেন্টেনারি হলে সবাই ঢুকে পড়েছে। আমি ঢোকার মুখে টেনশন কাটাতে সিগারেটে ঘনঘন টান দিচ্ছিলাম। দীপা তুমি কখনওই জানতে পারবে না, তোমাকে শুধুমাত্র তোমাকে একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ দেবার জন্য আমার ভেতরে এখন কী ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধস পেয়ে যাচ্ছে সব। সিগারেটটাকে টোকা দিয়ে ছুড়ে চোখ ফেরাতেই দেখি দীপা। তন্ত্রীতে কোথায় আকস্মিক বাধাপ্রাপ্ত রক্তের বেগ ধুন্ধুমার ঘটিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর জুড়ে। আমি চোখ ফেরালাম।
দীপা ওর অদ্ভুত চাউনিতে হাসির আলো ছড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এল আমার দিকে। এসেই বলল, এখানে একা। কী করছিস? তুই নাকি গান গাইছিস? কাউকে বলিসনি তো তুই গান জানিস! ইউনিয়নের শ্যামসুন্দরদা বলল, তোমাদের বাংলার উত্তীয় গান গাইবে। সত্যি?
—আমি হ্যাঁ বুঝিয়ে মাথা নাড়লাম। ভেতরটা তখনই আমার নিস্তরঙ্গ স্বাভাবিক হয়ে গেল। দীপা বলল, চ, ভেতরে আয়। আমি দীপার সঙ্গে ভেতরে গেলাম।
দুই
যেমন দৈবাৎ পরিচয় হয়েছিল, তেমনই দৈবাৎ ঘনিষ্ঠতাও হয়ে গেল দীপার সঙ্গে সেই ফ্রেশার্স ওয়েলকামের দিন থেকে। দীপা যেখানে, সেখানে আমি। আমি যেখানে দীপা সেখানে। বাংলার সবাই আমাদের নিয়ে নানা কথা ছুড়ে দিতে লাগল। দীপা ভ্রূক্ষেপ করত না। আমি মাঝে মাঝে রাগ দেখাতাম। এমন ভাব দেখাতাম যে, এখনই একটা রিভলবার পেলে ছয়ঘোরা করে একেকটার বুকে সিঁধিয়ে দিতাম। সেটা শুধুই আলগা, বাইরের। ভেতরে ভেতরে দারুণ ইচ্ছে করত, গিয়ে সবার পিঠ চাপড়ে বলি, সাবাশ বচ্চে, আউর বোলো, চিলহা চিলহা কর বোলো। সারি দুনিয়া কো মালুম করা দো, দীপাকে সাথ মেরা কেয়া সিলসিলা।
একটা ছোট্ট কথাই শুধু বলা হয়নি দীপাকে। কীভাবে বলব? কী কথা দিয়ে শুরু করে আসল কথার দ্বীপে গিয়ে দাঁড়াব? কীভাবে সাজিয়ে বললে দীপার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হবে, ভেতরে ভেতরে এই নাট্যরঙ্গের ডামাডোলেই আর বলা হয়নি কিছুই। দীপার মতো মেয়ে আগ বাড়িয়ে কোনওদিনই একথা বলবে না। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাকেই বলতে হবে।
আবার মনে হয়েছে, সব শুনে দীপা যদি বলে, না রে উত্তীয়, এ আমি চাইনি। আমি বন্ধুত্ব চেয়েছি। তুই আমাকে ভুল ভেবেছিস। এসব নেহাতই প্রেমিক মনের অহেতুক ভয়। দীপা আমাকেই ভালোবাসে। একথা আমি চোখ বুজে বাঁহাতে লিখে দিলেও একটা বর্ণেরও হেরফের হবে না। আমি হলফ করে বলতে পারি। কত কথা মনে হয়েছে বলব। দীপার কাছে যেতেই মনে হয়েছে, কথা নেই কোনও। বস্তুত, কোনও কথা থাকে না, সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে বারবার।
রবিঠাকুরের গান পছন্দ করে দীপা। কেবলই মনে হয়েছে দীপাকে একটা রেয়ার গান শোনাই। দীপার সঙ্গে আমার রুচি ও পছন্দের আদ্যোপান্ত মিল। কোনও কবিতা ভালো লেগে গেলে মুখস্থ করে ফেলেছি। দীপাকে শুনিয়েছি। ও খুশি হয়েছে। খুব সহজে খুশি না হওয়াটাই যেন দীপার বিশেষত্ব। কিন্তু যখন মনে হয়েছে, দীপা সত্যিই মুগ্ধ হয়েছে, তখন সুখের যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা ভরে গেছে।
দীপা আমার ছোটোখাটো, খুচখাচ সব ব্যাপারেই নজর রেখেছে। একটুতেই ডাক দিয়েছে। চোখ পাকিয়ে শাসনের ধরন নিয়েছে। তখন আরও বেশি করে আমার মনে হয়েছে, দীপা তুই আমার। একচেটিয়া সুখের আধিপত্য নিয়ে বিশ্ব সংসারে আমি একাই এসেছি। তার মূলে তুই।
কিন্তু, রামেন্দ্রসুন্দরের ওপর বইটা যেদিন হারিয়ে ফেললাম, দীপা সেদিন আমায়, তুই একটা যা তা, ইরেসপন্সিবল কোথাকার এসব মুখের ওপর বলে দিয়েছে। কারও কাছ থেকে যেন চেয়ে এনেছিল বইটা। তারপর ক্লাসে আমার কাছে দিয়ে বলেছিল, তোর কাছে রাখ। রেখেছিলাম। তবে ভাবতে পারিনি বইটা হারিয়ে যাবে।
আমায় সঙ্গে করে দীপা গোটা ক্লাস রুম, ক্যান্টিন, করিডোর, লাইব্রেরি, যেখানে যেখানে গেছি তখনও পর্যন্ত, সব জায়গায় খুঁজেছে। আগ বাড়িয়ে একে তাকে জিজ্ঞেস করেছে। তত বেশি করে রেগে গেছে আমার ওপর। বারবার ওর মুখে শুনতে হয়েছে, তুই একটা কী রে? এত ইরেসপন্সিবল! সামান্য একটা বই দায়িত্বে রাখতে পারলি না?শুনে লজ্জায়, অপমানে আমার কর্ণমূল আরক্তিম হয়ে উঠেছিল।
দীপাকে কোন মুখে কী বলব? কিছু বলার থাকে আর? দীপা আর কোনওদিন আমার কাছে আর কিছু রাখতে দেবে না। কোথায় হারালাম বইটা, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। মনেই ছিল না। দীপা চাইতেই তখন মনে পড়ল।
আজ যাওয়ার সময় দীপা আমায় ডাকল না। সব দিন ডাকতে হয় না। সঙ্গে থাকি, যাই বাসস্টপ পর্যন্ত। বাস এলে দীপা উঠে যায়। আমি হ্যারিসন রোড ধরে হাঁটা শুরু করি। নিজের প্রতি একটা মিহি ঘৃণা, একটা তাচ্ছিল্য শরীরময় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। দীপার কাছে আমি ছোটো হয়ে যাই, দীপা আমাকে অপদার্থ ভাবুক, তা কি মনের ভুলেও ভেবেছি? বরং মনে মনে উলটোটাই চেয়েছি। সাবলীল সুপুরুষের সবক’টা গুণ খুঁজে পাক দীপা আমার মধ্যে। আবিষ্কার করুক এক অনন্য নবীনকে।
দীপার কী দোষ? ওকে তো বইটার জন্য অন্যের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে। সে তো আমারই জন্য। দীপা কারও কাছে সহজে ছোটো হওয়ার মেয়ে নয়। সেখানে যদি যার বই সে দু’কথা বলার সুযোগ পেয়ে যায়, আর দীপাকে তা শুনতে হয়, তাহলে কল্পনাতীত কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। দীপা আমাকে আরও যা মুখে আসবে বলে দেবে। কথা বন্ধ করে দেবে। না দীপা তুই কথা বন্ধ করে দিস না। আমার কথা তো ছোঁয়াচ পেয়ে উজ্জ্বলতা পায়, তুই বুঝিস না?
পরদিন ইউনিভার্সিটি এসেছি। ভয়ে ভয়ে গা আড়াল করে থাকতে ইচ্ছে করছিল। দীপার চোখের আড়ালে আড়ালে থাকতে চাই। পারলাম না। দীপা আমার কাছে এসে বসল। দীপার মুখোমুখি অপরাধীর মতো বসেছিলাম। তাকাতে পারছিলাম না ওর দিকে। আমি অপার অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। দীপা ওর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আমার গ্রীবা ঘুরিয়ে আনল। বলল, আমার ওপর তুই রাগ করছিস না রে? তাকা আমার দিকে।
আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম দীপার চোখে। পর্যাপ্ত অভিমানে ক্রমে দু’চোখ জলে ভার হয়ে এল আমার। আমি অস্পষ্ট কাঁপা গলায় বললাম, কই না তো।
দীপা এবার ঝুঁকে এল আমার কানের কাছে। তারপর পরম গোপনীয়তার সতর্কতায় ফিসফিস করে বলল, কাল মেট্রোতে ম্যাটিনির দুটো টিকিট কেটে রাখিস। আমি ঠিক সময়মতো চলে যাব।
দীপা বলেছে, স্টুডিওটার সামনে দাঁড়াস। এদিক ওদিক যাস না কোথাও। অন্য কোথাও যাইনি আমি। টিকিট দুটো কেটেও নিয়েছি। শীতের রোদ। তবু বেশ কড়া। তা হোক। তবু নড়িনি। আমি অনেক আগেই এসে পড়েছি। দীপার আসার এখনও অনেক দেরি।
ধারবাহী জনস্রোত, ফুটপাতে হকারদের চিৎকার, ডবল ডেকারের পেছন থেকে কালো ধোঁয়া ছেড়ে মোড় নেওয়া, অনন্তকাল ধরে বয়ে চলা দ্রুতগতি যানগুলোকে আমার তীক্ষ্ণ নজর ছেঁকে ধরছিল। এদিকে আমার বাঁহাতের কবজিতে সময় এগিয়ে মেট্রোর ম্যাটিনিকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে। আনমনা গালে হাতের প্রলেপ দিতে গিয়ে মনে পড়ল, তাড়াহুড়োয় দাড়িটা কাটা হয়নি। গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়ে গেছে। কালো মুখে এই দাড়ি দীপার কাছে মোটেই নয়ন সুখকর হবে না।
দীপা কেন আসছে না? আমি তো স্টুডিওর সামনে থেকে একচুলও নড়িনি। চোখে রোদ পড়ছে। তবু সানগ্লাসটা নামিয়ে রেখেছি। খালি চোখেই দীপাকে দূর থেকে লক্ষ্য করতে সুবিধে হবে।
হলের বাইরে দর্শকদের ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। শো শুরু হওয়ার পরেও ঠায় একঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। একটার পর একট সিগারেট খেয়েছি। দীপা আসেনি। চোখের শিরা বুক থেকে রক্ত টেনে জড়ো করছিল। একটুতেই ঝরে পড়বে বুঝতে পেরে অতি সন্তর্পণে ঢোক গিলে গিলে বুকের রক্ত বুকে ফেরাতে চেয়েছি।
দীপা এল না কেন? কী এমন ঘটতে পারে যার জন্য এল না? সিনেমা দেখার কথা তো দীপাই বলেছে। আমি তো বলতে যাইনি। তোষামোদ করতে যাইনি। তোকে যেতেই হবে এমন মাথার দিব্যি দিয়ে তো রাজি করাইনি। তুই তো নিজেই গদগদ হয়ে বললি। নাকি বই হারিয়ে ফেলার প্রতিশোধ নিল? আর আমাকে একটা নিরেট গবেট ভেবে পুরোটাই কৌতুক করে মজা পেতে চাইল দীপা?
দীপার শরীরে কি মহম্মদ বিন তুঘলকের রক্ত আছে? এসব সবই আমার রাগের মাথার ভাবনা। কেন-না দীপা আসেনি বলে কিন্তু ওর ওপরে রাগের চেয়ে অভিমানই হচ্ছে বেশি। যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে অনাবশ্যক রূঢ় কথা বলা, মাঝেমধ্যে তাকেই শত্রু প্রতিপন্ন করার পেছনে একটা সূক্ষ্ম তৃপ্তি আছে। আর কারও না থাক, আমার আছে। রাগের মুহূর্তে হাবিজাবি মনে আসে। আসলে দীপাকে আমি খুব ভালো চিনেছি। বই হারিয়ে ফেলার প্রতিশোধ নেবে, এত নীচু মন ওর না। ও হয়তো কোনও কারণে আটকে গেছে।
দীপা আবার ভুলে যায়নি তো? ভুল তো মানুষেরই হয়। আমারও তো মনের ভুলে বইটা গেল। কিন্তু সিনেমার কথা দীপা যখন খেয়ালে বা কথার কথায় বলেনি, তখন ভুলে যায় কী করে? বড়ো কথা, নিজে থেকে ওভাবে কথাটা বলে কেউ ভুলে যেতে পারে? সদ্য সদ্য কালকের বলা কথা আজই ভুলে যাওয়ার মতো ভুলো মন দীপার না। নিশ্চয়ই কোনও বড়ো কারণে আসতে পারেনি। এসব ভেবে সান্ত্বনা পেতে ইচ্ছে করল না। ভেতরে ভেতরে কেবলই দীপার ওপর তীব্র রাগ ফুঁসে উঠছিল। কাল ইউনিভার্সিটিতে এসে দীপা নিশ্চয়ই কোনও মোক্ষম কারণ দেখাবে।
—মেয়েদের কত অসুবিধে, কত রকম ট্রাবল ফেস করতে হয় তুই তার কী বুঝবি? হেনাতেনা সাতসতেরো অনেক কথাই বলবে, বোঝাতে চাইবে। যত যাই বলুক, বোঝাতে চাক, আমি কোনও কথাই বিশ্বাস করি না মুখের ওপর বলে দেব। নিজেই সিনেমা দেখার কথা বলে, আমাকে উসকে দিয়ে না আসার জন্য দরকার হলে দীপার মুখের ওপর আরও রূঢ় কথা বলে দিতে আমার একটুও বাধবে না।
—আমি তোকে চিনি না, কোনওদিন তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। যার কথার দাম নেই, তার সব কিছুই মূল্যহীন। বাঃ বেশ জব্বর শিক্ষা দিলি ভাই। আরও কুকথা মুখে যা আসবে বলে দেব। অত ছাড়াছাড়ি নেই। অবশ্য দীপা এনিয়ে ন্যাকা গাওনা গাইতে এলে তবেই শোনাব। নিজে থেকে ঘটা করে এসব শোনাতে যাওয়ার কোনও ঠেকা নেই আমার। তার চেয়ে দীপা আসেনি তার জন্য আমার কষ্ট হয়েছে খুব, আমি ভীষণ রেগে গেছি, সাড়ম্বরে এসব জানান দেওয়াটাই বেশি বোকামি হবে। বরং এমন ভাব দেখাব যে, তুই আসিসনি আরে তাতে কী হয়েছে? আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলাকে নিয়ে দিব্যি দেখেছি। তুই ভাবিস কী আমায়?
দীপার সঙ্গে চোখাচোখি হলে প্রথমটায় এমন ভাব দেখাতে হবে যেন এই প্রথম দেখছি মেয়েটিকে। তারপর ও তেমন উৎসাহ দেখালে, দেখাবে নিশ্চয়ই। তখনই সেই ভাবটা আনতে হবে, আরে এ তো আমাদের বাংলারই সেই মেয়েটা না? ব্যস তার বেশি কেরামতি দেখানোর দরকার নেই। ভেতরে ভেতরে এমনই একটা সতর্কীকরণ নিয়ে পরদিন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলাম।
—আমি জানতাম, দেখা হলে দীপা প্রথমেই বলবে, এই এই কারণে কাল সিনেমায় যেতে পারিনি রে। তুই নিশ্চয়ই এসেছিলিস? শুধু শুধু তোকে কষ্ট দিলাম। আমিও সেয়ানা ঘুঘুর মতো চরম নির্লিপ্ততায় ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করব, কী ব্যাপার বল তো? কীসের কষ্ট?
দীপা তখন নিশ্চয়ই বলবে, ওই যে কাল তোকে সিনেমার কথা বলে যেতে পারলাম না।
—আরে হ্যাঁ। সত্যিই তো তুই বলেছিলি! কী কাণ্ড দেখ, আমি তো ভুলেই মেরেছি। ভাগ্যিস তুই যাসনি। গেলে কী কেলেঙ্কারি হতো বলতো? মুহূর্তে ভাবলাম, এইটেই সেরা মেডিসিন। দীপাকে এই ক্যাপসুলই গিলিয়ে দেব।
—কী ব্যাপার? দীপা কি আসেনি নাকি? নাহ, পরপর তিনটে ক্লাসে দীপাকে দেখলাম না। একবার ভাবলাম, জিজ্ঞেস করি সুমিতাকে। আবার ভাবলাম, না, কানাকানি হবে। তুষার, বিমল যদি জানতে পারে, আমি দীপার বিরহে কাতর, তাহলে আর রক্ষে নেই।
সুমিতাকে আলাদা করে ডেকে দীপার কথা জিজ্ঞেস করা যায় না? কিছু জানে নাকি ও? না তা হয় না। সুমিতা বলবে, তা একথা জিজ্ঞেস করার জন্য তুই আমায় ক্যান্টিনের জমাটি আড্ডা থেকে ডেকে আনলি? আবার ফিরে গিয়ে মালা, কণাকে বলবে। মালা, কণা বলবে তুষার আর বিমলকে। ব্যস, তবে তো হয়ে গেল।
দীপার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পর থেকে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থেকেও তখনই আমি একা হয়ে গেছি। তা আজ ধ্রুব সত্যির মতো বুঝে গেলাম। আরও বিলক্ষণ বুঝে গেলাম, এই ইউনিভার্সিটির জগতে সবার চাইতে দীপার চোখে আমি সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু কাল সিনেমায় এল না, আজ ক্লাসে এল না। কেবলই মনে হচ্ছে, দীপা আসেনি, আজ ছুটির দিনে আমরা সবাই না জেনে এসে পড়েছি। নিজেকে ভীষণ একা আর নিঃসঙ্গ অসহায় মনে হচ্ছে।
দীপা আমার এক কপর্দকও ধরে ফেলেছে। আমি তোর কাছে ধরা পড়ে গেছি রে দীপা, সে কথা আর নতুন করে কোনও ভাবেই বুঝতে হবে না। তুই এসে দেখে যা! সিনেমায় না আসার জন্য দীপার ওপর আমার সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, অনুযোগ, অভিমান গলে জল হয়ে কঠিন কষ্ট হয়ে বুকের রক্তে মিশে গেছে।
কাল ইউনিভার্সিটিতে এসে দীপাকে না দেখা পর্যন্ত আমি একটাও স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারব কিনা সে নিয়ে ভয় তো ছিলই। আবার সম্ভবপর আতঙ্কে আঁতকেও উঠেছি, কালও যদি দীপা না আসে?
আজ সাতদিন হয়ে গেল দীপা আসছে না। সাতদিন দীপাকে দেখি না। মনে হচ্ছে কত যুগ! দীপার মুখটা অচেনা হয়ে যাবে না তো? পেছন থেকে ইতিহাসের সেই মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠেছি। দীপা না? ভুল ভেঙে গেছে। সবাই কি আর দীপা হয়? না সব দীপার জন্য আমি সাতদিন ধরে অস্থিরতায় কষ্ট পাচ্ছি? ট্রামে, বাসে, ট্রেনে রাস্তায় বিপুল জনস্রোতে কত হাজার হাজার দীপা হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। সেই দীপাদের দলে ইউনিভার্সিটির বাংলার দীপা নেই। থাকতে পারে না। থাকলে সে আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাবে, অত সস্তা না।
দীপার সঙ্গে এই সাতদিনে একবার তো দেখা হতে পারত। ইউনিভার্সিটি না এলেও কি কোনও কাজে রাস্তায় বেরোয়? নিদেনপক্ষে মাথা ধরার ট্যাবলেট আনতে যাচ্ছি বলেও তো একবার বিকেলে বেরোতে পারে। রাস্তার মধ্যে আচমকা উত্তীয় বলে ডেকে ছুট্টে কাছে এসে তো বলতে পারত, এই অসুবিধে তাই ক্লাসে যাচ্ছি না রে। তুই খুব একা হয়ে গেছিস না রে? একি তুই কাঁদছিস!
একা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কেবলই আঁতকে পেছন ফিরে তাকিয়েছি। দীপা ডাকল না? দীপা ডাকে না। আজ সাতদিন দীপার ডাক শুনিনি। অনেক রাত পর্যন্ত শুয়ে শুয়ে দীপাকেই ভেবেছি শুধু। ঈশ্বরকে ডেকেছি মনে মনে দীপাকে যেন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখি।
দীপাকে স্বপ্নে দেখিনি। দীপার আসার সময় পেরিয়ে গেছে জেনেও দীপার বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থেকেছি। ফেরার পথেও দীপার বাসস্টপে এসে দাঁড়িয়েছি। দীপার বাস এলেই উঠে গেছি। গিয়ে নেমেছি হরিশ মুখার্জি রোডে। ঠিকানা জানি না। তাই গোটা হরিশ মুখার্জি রোডে চক্কর দিয়েছি, কোনও বাড়ির জানালা থেকে বা ঝুলবারান্দা থেকে দীপা আমাকে দেখে ফেলতেও তো পারে। উত্তীয় বলে ডেকে বলতেও তো পারে, তুই এখানে? এইটে আমাদের বাড়ি। ডানদিকে গেট ঠেলে ঢোক। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আয়।
ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে ফুচকাওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি। দীপা এর কাছে ফুচকা খায়। ক্লাসে বসে শুধু মনে হয়, এই তো আমি বসে আছি, এই বুঝি পেছন থেকে দীপা এসে আচমকা পিঠে হাত রাখল। এই বুঝি মায়াবী চোখ পাকিয়ে বলল, এখনও রাগ পড়েনি? একি! কী বোকা রে! তুই কাঁদছিস?
ক্লাসের ভেতর সুমিতা, মালা, কণা, সোনালি, তুষার, বিমল সবার সঙ্গে আমিও বসেছিলাম। সুমিতা গাইছিল, তুষার বেঞ্চে তাল ঠুকছিল। আমি আস্তে উঠে বেরিয়ে এলাম। তারপর নেহাতই পায়চারি করার ঢঙে অন্য একটা ফাঁকা ক্লাসে ঢুকে পড়লাম। বুক কাঁপতে লাগল অনর্থক ভয়ে কেউ লুকিয়ে আমায় লক্ষ্য করছে না তো? এদিক ওদিক তটস্থ চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর পকেট থেকে একটা চক বার করলাম। হাত কাঁপছিল। তবুও লিখলাম, দীপা, তুই আসছিস না কেন রে? লিখেই মুছে ফেললাম।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে মুখের, গলার ঘাম মুছে ফেললাম। অস্বাভাবিক মাথা, কপালের দু’পাশের শিরায় যন্ত্রণা ঢিপঢিপ করতে লাগল। চোখে জ্বালা জ্বালা ভাব। কান্না ছাড়াও এক ধরনের জল বেরিয়ে আসছিল চোখ থেকে। কাউকে কিছু না বলে রাস্তায় নেমে এলাম। দীপার বাসস্টপ হয়ে আর হরিশ মুখার্জি রোডে যাওয়ার সাহস হল না। আচ্ছন্নের মতো এক অন্য মাদকতায় বেধড়ক মাতালের মতো টলতে টলতে সোজা বাড়ি চলে এলাম।
সকালের দিকে অরুণ ডাক্তার এসে দেখে প্রেসক্রিপশন করে গেছে। চিনিদা গাদাখানেক ট্যাবলেট, ক্যাপসুল নিয়ে এসেছে। ডান হাতের ফাঁড়া আজ কেটে গেছে। টাকুদা কাল আসবে বাঁহাতে সূচ ফোটাবে। আজ তেরো দিনের দিন জ্বর নেই। তবে দাঁড়ালে বুক কাঁপে। পা কাঁপে। জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখি মনে হয়, হাঃ! পালটে গেছে সব কিছু। বাইরের জল, হাওয়া, আলো সব পালটে গেছে। অনেক দেখা পুরোনো জিনিসও নতুন আঃ কী সুন্দর!
দীপাকে দেখলে নতুন মনে হবে। দীপা তোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। তোকে কতদিন দেখিনি রে। তুই সাতদিন এলি না কেন? তোকে অনেক খুঁজেছি। এখন আমার অসুখ। সেদিনই দুপুরের পরে দীপাকে স্বপ্নে দেখলাম। জ্বরের ঘোরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। দেখলাম দীপার সারা শরীর সবুজ। সারা গায়ে নক্ষত্র ফুটে আছে। সবুজ নক্ষত্র। আকাশ থেকে মেঘ সরিয়ে দীপা নেমে আসছে। বৃষ্টিতে ভিজলে যেমন শরীর থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে, তেমনই দীপার শরীর থেকে নক্ষত্র ঝরে পড়ছে।
—আমি চেঁচিয়ে বললাম, দীপা আমি এখানে, এই এখানে। আমাকে দেখতে পাচ্ছিস?
দীপা নেমে এসে আমার কপালে, গলার কাছে হাত রাখল। বলল, তোকেই তো দেখতে এলাম। কেমন আছিস?
—ভালো, এখন ভালো আছি। তুই এতদিন কোথায় ছিলি? রোজ আসবি তো?
—আসব, রোজ আসব।
ঘুম ভেঙে যেতে দেখি, সত্যি সত্যিই দীপা এসেছে। তবে ওর শরীর সবুজ না। যেমন ছিল তেমনই। সঙ্গে সুমিতাও এসেছে। আমার বিছানার কাছে ওরা বসে আছে। আমি চোখ খুলতেই দীপা বলল, কী? কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? দেখলি তো চলে এলাম সোজা। স্টেশনে নেমে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ি পেয়ে গেলাম। কলেজের কাছে বাড়ি, তা তো জানতামই। তোর মুখে শুনেছি অনেকবার।
সুমিতা বলল, আমরা তো অবাক দু’সপ্তাহ তোর কোনও পাত্তা নেই। তাই আজ যাই কাল যাই করে চলেই এলাম।
দীপা সোজা আমার বাড়ি চলে আসতে পারে! বিস্ময়ে মুখে কথা ফুটল না সহসা আমার। দীপা কাছে এসে আমার রোগা বুকে হাত রাখল। তারপর কপালে। অল্প ঘাম হচ্ছিল তখন। দীপা বলল, এই তো ঘাম দিচ্ছে। জ্বর নেই আর। আমি অসহায় হাসলাম শুধু।
মা এ ঘরে ওদের জন্য চা, লুচি তরকারি জলখাবার এনে দিল। চা খেতে খেতে দীপা বলল, ঠিক দু’সপ্তাহ পর তেইশ তারিখ আমরা বিকেসির নেতৃত্বে আমাদের বাংলার দশজন শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি। তুইও যাচ্ছিস আমাদের সঙ্গে। ততদিনে আমি শরীরে ভালোমতো জুত পেয়ে গেলাম।
তিন
বিকেল বিকেল পৌঁছোলাম শান্তিনিকেতনে। স্টেশনে নেমে রিকশা নিলাম। বেশ শীত পড়ে গেছে। আমি আর বিমল উঠলাম একটা রিকশায়। তুষারটা ঠিক ঝোপ বুঝে নিয়ে কণার পাশে গিয়ে উঠে বসেছে। দু’জন অধ্যাপক এক রিকশায়। সোনালি, মালা, মিত্রা, অসীম, চঞ্চল ওরাও সুবিধে মতো ভাগাভাগি করে চেপেছে। দীপা আর সুমিতা একটা রিকশায়।
কয়েক মিনিটের পথ স্টেশন থেকে টুরিস্ট লজ। এটুকু পথেই রিকশাওয়ালারা নিজেদের মধ্যে রেস শুরু করে দিল। দীপার রিকশা আমাদের আগে আগে যাচ্ছিল। আমি দু’চার হিড়িক দিতেই আমাদের কম বয়সি সারথি ছাড়িয়ে গেল দীপাদের রথ। ঢালাও পিচের রাস্তা মোড় নিল। খানিকটা রাঙামাটির মোরাম বিছানো রাস্তা পেরিয়ে এসে উঠলাম লজে।
জানলা খুলতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। বহু দূর পর্যন্ত মাঠ, ধানখেত। ধান কাটা হয়ে গেছে। ধানের গোড়া পড়ে আছে। নানান গাছগাছালি, খেজুর গাছের মাথায় সন্ধের অন্ধকার ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো এসে লটকে যাচ্ছে। শীতের ফিনফিনে হাওয়া আসছিল দেখে জানালা বন্ধ করে দিলাম। মেয়েটা এসে তাড়া লাগাল। চলো চলো বেরিয়ে পড়ি, বেড়িয়ে আসি। ওরা একেবারে সেজেগুজে রেডি।
একটা সবজে অদ্ভুত সুন্দর শাড়ি পরেছে দীপা। বলল, কী রে উত্তীয়, তুই বেরুবি না? গড়িমসি করছিস যে! তুষার, বিমল ওরাও ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। ওরাও তাড়া লাগাল, চ’ চ’ নে ওঠ। শেষে ফিরতে রাত হয়ে যাবে।
অগত্যা বেরতেই হল। দু’জন স্যার ঘরে বসে জমিয়ে নিয়েছেন। বললেন, বেশি দেরি কোরো না তোমরা।
লাল কাঁকুড়ে মাটির পথ। দুপাশে বিস্তৃত মাঠ। মাঠের বুক চিরেও রাস্তা গেছে। চাঁদের আবছা আলোয় বেশ ভালোই ঠাহর হচ্ছে। মনে মনে বললাম, এই তো সেই রবিঠাকুরের গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ। বাড়ি-ঘরগুলো বেশ ছিমছাম সাজানো। সব বাড়ির সামনেই এক চিলতে ফুলের বাগান। আলাদা রুচির ছাপ। আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে হাঁটতে লাগলাম।
দীপার বাঁ হাত ধরেছে সুমিতা। ডান হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, উত্তীয়, ধরবি তো ধর। নইলে কাউকেই দেব না ধরতে। মুহুর্তে বিদ্যুতের বেগে দীপার হাতটা ধরে ফেললাম।
দীপার নরম পেলব হাতটা স্পর্শে মনে হল, দীপা আমায় কোনও কষ্টই দেয়নি। যেটুকু কষ্ট বলে মনে হয়েছে, সেটুকু এই সুখ, আনন্দের অঙ্কুর ছিল। আমি তখনও জানতাম না, দীপার প্রেমিক আছে। জানলাম তখন, যখন তুষার পাশ থেকে টিপ্পনী কাটল। বলল, একবারে হাত ধরে গদগদ ! আর কত ঝোলাবি ব্যাটাকে?
শুনে দীপা রেগে গেল। বলল, আর যাই বল, উত্তীয়কে নিয়ে এসব আমি সহ্য করব না। সে রকম মন নিয়ে ওর সঙ্গে আমি মিশি না। ও শুধুই আমার বন্ধু। তার চেয়ে বড়ো কথা অনেক আগে থেকেই আমি প্রেম করি। আমার প্রেমিক আছে।
কথাটা শোনা মাত্র আমার বুকের রক্ত ছলাৎ করে পিছলে গেল বীভৎস যন্ত্রণায়। কাউকে বুঝতে দিলাম না। দীপার হাত থেকে আমার হাত তখনই আলগা ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দু’হাতে নিজের বুক চেপে ধরলাম। ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা। কাছেপিঠে বুবুনদি নেই। বুবুনদি এখান থেকে বহু দূরে আছে এখন। তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, বুবুনদি তোমাকে এখন একটা দারুণ সারপ্রাইজ দিতে পারি। আমি যে-মেয়েটিকে ভালোবেসেছি, তার একজন প্রেমিক আছে।
চার
ঘন্টা হিসেবে নৌকা চুক্তি করল দীপা। বেলা পড়ে এসেছে। নিরুত্তাপ রোদের জন্য বেশ ভালো লাগছিল। দূরে কোনও খেয়াঘাটের লঞ্চের ভোঁ শব্দটা যেন জল সাঁতরে এদিকে ভেসে আসছিল। হাওয়া এসে জলের বুক ছুঁয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। নৌকা ছেড়ে যেতেই সিগারেট জ্বালালাম একটা। আজকের নায়ক আমি। আমি উত্তীয় সেন। স্বপ্নের ঘোরের মতো তাবত দৃশ্যপট ছেয়ে থাকল। আমার চোখের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া মুখ ছাড়া হয়ে বাতাসে মিশেই যেন নাচের মুদ্রায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
পরদিন ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে দীপার সঙ্গে বাসস্টপে যেতে যেতে দীপা বলল, কাল একবার আসবি তুই?
—কেন? কাল তো রোববার!
—বলছি তো সেজন্যই।
—মানে? মানে কাল প্রশান্ত আসবে।
—অ! তোর ইয়ে কিন্তু তাতে আমি কেন?
—তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, ভালো হবে।
—তাই? তা আসছে কোথায়?
—আউট্রামে তিনটের মধ্যে আসবে। তুই দুটোর সময় কফি হাউসের সামনে থাকবি। আমি ওখানেই তোকে খুঁজব, তারপর যাব ’খন।
—তা তোর প্রশান্ত আসছে, তাতে আমার কী? আমি কীসের আনন্দে ছুটির দিন দুপুরবেলা ছুটে আসব? ওর সঙ্গে পরিচয় না করলেই বা আমার কী আসবে যাবে?
—না না এসব বলিনি দীপাকে। এসব কথা আমার মনের মধ্যে একমুহূর্ত চড়ুইয়ে ঝাঁকের মতো কিচিরমিচির করে উঠেছিল। দীপার ওপর এখন অনীহা ভাব দেখালে ধরা পড়ে যাব আরও বেশি করে।
দীপা উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। তখনই নৌকা দু’পাশে বেশ জোরে দুলে উঠল। বেসামাল হচ্ছিল দীপা। একপাশে কাত হতেই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললাম ওকে।
হ্যাঁ! দীপা এখন আমার বুকে পরম নির্ভরতায় মুখ রেখে, চোখ বুজে বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। গলায় একটা অদ্ভুত আদুরে সুর এনে দীপা বলল, আমার চোখ খুলতে ভয় করছে। যদি জলে পড়ে যেতাম?
—বাঃ রে! আমি আছি, মাঝিরাও আছে। দীপাকে এমনভাবে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইলাম, যেন তুই জলে পড়ে গেলে জলের তলা থেকেও তোকে তুলে আনতে পারি আমি। আসলে আমি যে সাঁতারই জানি না, সেকথা দীপার সঙ্গে এই শঙ্খবেলার মুহূর্তে মনে না আসাই ভালো।
সূর্যটা অস্ত যাবে এক্ষুনি। পশ্চিম আকাশটা যেন রক্ত রঙের আবির মেখে হাসছে।
—দীপা বলল, কী চার্মিং তাই না রে।
—তার চেয়ে আর বেশি কোথায়?
এর বেশি বললে বাড়াবাড়ি হবে। দীপা বন্ধু ভাবে আমায়। সে জন্যই তো প্রশান্তর সঙ্গে পরিচয় করাতে চায়। কিন্তু আশ্চর্য প্রশান্ত এল না। জানি তো এখন আর প্রশান্ত আসছেই না। তাই নির্ভয়ে আরও একবার দীপাকে প্রশান্তর কথা জিজ্ঞেস করাই যায়। যার অনারে আসা, মাঝেমধ্যে তার জন্য একটু আধটু আফশোশ না দেখালে দীপা যদি আমাকে নির্লজ্জ ভাবে? যদি ধরতে পেরে যায় আমার ভেতরটা?
—কী রে তোর প্রশান্ত যে শেষ পর্যন্ত এলই না। ঠিক মতো বলছিলি তো? লুকিয়ে কখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। জ্যোৎস্না তখনও পরিষ্কার হয়নি।
দীপা আমার কানের কাছে সেই একই রকম ভাবে ঝুঁকে এল। তারপর সেই একইরকম ভাবে পরম গোপনীয়তায় ওষ্ঠ ও অধর ডুবিয়ে দিয়ে বলল, তুই এত বোকা কেন? আমার প্রশান্ত বলে কেউ নেই রে। আমি তো তোকেই…। তারপর আর কোনও কথা বেরোলো না দীপার মুখ থেকে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের ঝড়ে সাঁই সাঁই সুখের বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে।
দীপা এবার আমার মুখোমুখি বসল। বলল, তোকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম। আসলে তুই যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসিস, আমি অনেক আগেই তা বুঝতে পেরেছি। তাই পরীক্ষা করে দেখলাম, প্রশান্তর কথা বললেও তুই আসিস কিনা। আমি জানতামই যে তুই না করবি না। আর না এসে থাকতেও পারবি না।
—তার মানে? দীপা আমার সব কিছু ধরে ফেলেছে? এত সহজেই আমার ভেতরটা ও আঁচ করতে পেরেছে? আমার চালাকি সব ধরে ফেলেছে নাকি? নইলে আমার ওপর এমন অন্ধ ধারণা হয় কী করে?
মুহূর্তে ভেবে নিলাম, আমি তোর সব ধারণা পালটে দেব রে দীপা। আমি তোকে সত্যিই পাগলের মতো ভালোবেসেছি। তোর জন্য আমার কষ্ট হয়েছে। তবু সে সব এখন আমি উপেক্ষাও করতে পারি। হ্যাঁ এই মুহূর্তে আমার অন্তরাত্মা আমাকে সেই শলাই দিচ্ছে।
—আমি সহসা বলেই ফেললাম, তোর ধারণাটা পুরোপুরি ভুল রে দীপা। তুই শুধুই বন্ধু আমার। আসলে আমার একজন প্রেমিকা আছে। তোকে বলিনি কোনওদিন…
রাই এসে আমার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, বাবা, তুমি এখনও এখানে বসে আছো? অফিস গেলে না?
রাইয়ের সাড়া পেয়ে আমি মাথা তুলতে পারছিলাম না। তিরিশ বছর আগের সেই দীপা আমাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না।