পুলিশ দুই প্রকার, ভালো পুলিশ আর খারাপ পুলিশ। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সাধারণ মানুষ কখনওই পুলিশকে সুনজরে দেখে না। পুলিশ মানেই যেন খারাপ চরিত্রের। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার আগেই শুভ্রজ্যোতি জানতেন এটা। যুবক বয়সে নিজেও থানাপুলিশ এড়িয়ে চলেছেন। চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সময় বাছাবাছিতে যাননি। কারণ, তখনই চাকরির বাজার বেশ খারাপ। এমনই কপাল, শিকে ছিঁড়ল পুলিশের চাকরিতেই। গুরুজন এবং চেনাজানারা সকলেই বলল, যতই হোক সরকারি চাকরি। এইবেলা ঢুকে পড়।পরে এই চাকরিও দুর্লভ হয়ে যাবে।

জয়েন করে গেলেন শুভ্রজ্যোতি। ট্রেনিং পিরিয়ডে, বিশেষকরে থিয়োরির ক্লাসগুলোতে মনে হতো আমি ভালো পুলিশ হয়ে উঠব। পুলিশের চাকরি যথেষ্ট মর্যাদাকর। কতিপয় খারাপ মানুষ এই চাকরিতে ঢুকে পুলিশের বদনাম তৈরি করে। প্রথম পোস্টিং হল ডক এরিয়ার থানায়। অপরাধপ্রবণ এলাকা। সেই থানাতে একটাও ভালো পুলিশ ছিল না। দু’জন সৎ পুলিশ ছিল। তারা পয়সা খেত না, কোনও কাজও করত না। একেবারে নিস্ক্রিয়। শুভ্রজ্যোতি বসে বসে মাইনে নিতে পারবেন না। অলসতা তাঁর স্বভাবে নেই। কাজ করতে গেলেন, ধরে রাখতে পারলেন না সততা। প্রলোভন এবং পরিস্থিতির চাপের কাছে হার মানলেন। অনেক পুলিশ আছে, যারা হার মানে না। শুভ্রজ্যোতির কাছে তারা প্রণম্য।

সেইসব নমস্য পুলিশদেরও বিশ্বাস করে না সাধারণ পাবলিক। বলাবলি করে, পুলিশ ঘুষ খায় না, তা আবার হয় নাকি! বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনওদিন হয়তো বিড়াল মাছ খাওয়া ছেড়ে দেবে। পুলিশ ঘুষ খাওয়া ছাড়বে না। এরকম একটা ধারণা শুভ্রজ্যোতির প্রতি

আত্মীয়-পরিজনেরও ছিল। ঠাকুরদার দেওয়া অমন সুন্দর নাম ওই বদনামকে আড়াল করতে পারেনি। এমনকী ফুলশয্যার রাতে চন্দ্রিমা দু’চার কথার পরই জানতে চেয়েছিল, স্যালারি কত পাও সে তো বাবার থেকে শুনেছি, উপরি কীরকম হয়?

বেশি নয়। নিতে হয় বলে নিই। নয়তো চাকরি টেকাতে পারব না। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

চন্দ্রিমা বলে, বেশি নিয়ে কাজ নেই বাবা। স্বভাব নষ্ট হয়ে যাবে।

নববধূর ইমেজ রাখতেই কথাটা বলেছিল চন্দ্রিমা। পরবর্তীকালে বিলাসব্যসনের এই যে এত আয়োজন, জানতে চায়নি কোথা থেকে, কীভাবে আসছে? স্বভাব সত্যিই নষ্ট হল কিনা, কখনও খোঁজ করেনি।

চরিত্র ধীরে ধীরে অধঃপাতেই গেছে শুভ্রজ্যোতির। এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি হয়েছেন। বেড়েছে পদমর্যাদা। শুকনো থানায়, মানে যেখানে দুনম্বরি পয়সার আমদানি কম, সে সব জায়গায় পোস্টিং-এর খবর কানে এলেই দৌড়েছেন ওপর মহলে। নানান কৌশলে আটকেছেন বদলির চিঠি। তার জন্য প্রশাসনের হয়ে অন্যায় কাজ করে দিয়েছেন অনেক। যতদিন গেছে শাসকদল এবং প্রশাসনের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তবে এটাও ঠিক গোটা দেশ কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির ওপর ভর করে চলে না। এখনও সততা, ন্যায়নিষ্ঠার জোর অপরিসীম। এমনই এক সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ বড়োকর্তা শুভ্রজ্যোতির ডানা ছাঁটতে দেবনগরের আইসি করে পঠিয়ে দিলেন। বহু তদ্বির করেও বদলি ঠেকাতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। দেবনগর একেবারেই বন্ধ্যা জায়গা। কলকারখানা নেই, পুরোনো হাইওয়ে যেটা আছে, মাল পাচারকারীদের কাছে সেটা পরিত্যক্ত। বড়ো মার্কেট নেই। ক্রাইম প্রায় নেই বললেই চলে। সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এখানে ভাই-ভাই। কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচন হয় রাখি উৎসবের মেজাজে।

দেবনগরে এসে প্রথমদিকে খুবই ডিপ্রেশনে ভুগতেন শুভ্রজ্যোতি। বউ-ছেলে থাকে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। ওদের স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং বাড়িয়ে ফেলেছেন শুভ্রজ্যোতি। কীভাবে খরচ জোগাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। থানার অন্যান্য সহকর্মীদের কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। দেবনগরের সামাজিক আবহাওয়ায় মানিয়ে নিয়েছে। আলস্যে দিন কাটায়। শুভ্রজ্যোতি খুঁটেখুঁটে ক্রাইম বার করে দু’চার পয়সা কামাতে লাগলেন। এই যেমন, হেলমেটহীন বাইক আরোহীকে থানায় ধরে নিয়ে আসতে বলা। অন্ধকার মাঠে মাতাল, প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরপাকড় করা। যা টাকা পাওয়া যায়, তাই নিয়ে ছেড়ে দেওয়া। এরকম বিবিধভাবে তোলা তুলতে লেগেছিলেন শুভ্রজ্যোতি। নিজের ওপরে ধিক্বার এসে যাচ্ছিল। আগে যে থানাগুলোতে ঘুরে এসেছেন, বাঁয়া-ডাঁয়া দু’পা গেলেই পাঁচ-দশ হাজার আপনা থেকেই হাতে এসে যেত। কিন্তু ওই যে, কী যেন বলে না, ‘যেখানেই যাও কপাল যায় সঙ্গে সঙ্গে’, শুভ্রজ্যোতির হচ্ছে ঘুষের কপাল। দেবনগরের মতো শুখা থানাতেই বিরাট একটা দাঁও মারার চান্স এসে গেছে। যাকে বলে বিগ শট। এতটাই বিগ, কাজটা সাকসেসফুলি উতরে গেলে যে-টাকাটা পাবেন, বাকি জীবন চাকরি না করলেও আরামে চলবে। ছেলের জীবনও কেটে যাবে ওই টাকাতেই।

লটারি লাগার মতো এরকম একটা সুযোগ যে আসবে, এই দেবনগরে বসে, কল্পনাও করতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। রেলের লাইনের ওপারে নসিবপুর, দেবনগর থানার আন্ডারে। ওখানে একটা স্টিল ফ্যাক্টরি আছে। অনেকদিন ধরেই টিমটিম করে চলছে। কারখানার গায়ে প্রায় বিশ একর জুড়ে জলাভূমি। লোকে বলে হাতিডোবার বিল। বিশ একরের দশ একর কারখানার সম্পত্তি, বাকিটা খাস। বিলের মাঝে বড়ো একটা চরা আছে। সেখানে প্রায় তিরিশ ঘরের বসবাস। সকলেই উদ্বাস্তু। র্যাশন কার্ড নেই। জায়গাটার নাম মেছোডাঙা। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা একমাত্র নৌকো। কারখানা সমেত গোটা এলাকা জুড়ে আধুনিক শহর তৈরি হবে। ডেভলপমেন্ট হওয়ার কথা দেশি-বিদেশি সংস্থার কোলাবোরেশনে। কারখানার মালিক নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি। খাসজমি অধিগ্রহণের সময় সরকার চোখ বুজে থাকবে। কারণ, সরকার উন্নয়ন চায়। বাধ সেধেছে একটা গোষ্ঠী। যারা নিজেদের পরিবেশকর্মী বলছে। জলাজমি বুজিয়ে ফেললে জনবসতির ড্রেনেজ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যাবে চতুর্দিক। বিলে প্রত্যেক বছর পরিযায়ী পাখি আসে, তারা আর আসবে না। প্রচুর মাছ চাষ হয় বিলে। মেছোডাঙার বাসিন্দাদের ওটাই জীবিকা। এছাড়াও আছে ক্ষতির নানান ফিরিস্তি। সব ছাই মনেও থাকে না শুভ্রজ্যোতির। পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই যোগ দিয়েছে মেছোডাঙার পরিবারগুলো। সাকুল্যে দু থেকে আড়াইশো জন এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। স্টিল ফ্যাক্টরি সবে নিজের জমি ভরাট করতে শুরু করেছে, হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছে তারা। ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার থানার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন প্রথম যেদিন কারখানার গেটের সামনে বিক্ষোভ হল। আড়াইশোজনের অ্যাজিটেশন লাঠি উঁচিয়ে ফাঁকা করে দেওয়া পুলিশের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। ঘটেওছিল তাই। তারপরই ম্যানেজার শুভ্রজ্যোতিকে ডেকে পাঠান নিজের চেম্বারে। গোটা পরিকল্পনাটা ভেঙে বলেন, বিশ একরে আধুনিক শহরের প্ল্যান। বলেছিলেন, অত কম বিক্ষোভকারী দেখেঞ্জভাববেন না ওদের শক্তি কম। আইনের জোর আছে ওদের পিছনে। কারখানা বাড়ানোর নাম করে আমরা নিজেদের জলাজমি ভরাট করছি, এখনকার আইন বলছে তা আমরা করতে পারি না। পরিবেশ দফতরের পারমিশন লাগবে। ‘জলাজমি’ ব্যাপারটা এখন এত সেনসেটিভ, অনুমতি পাওয়া যাবে না। আন্দোলনকারীরা কোর্টে যাওয়ার আগেই কারখানার দশ একর ভরাট করে ফেলতে হবে আমাদের। কয়েকটা রাতের মধ্যে চুপিচুপি সেরে ফেলতে হবে কাজ। আপনি আমাদের প্রোটেকশন দেবেন। কোর্টের রায় যদি এসেও যায় আপনার হাতে, আপনি অ্যাকশন নিতে গড়িমসি করবেন। একবার ভরাট হয়ে গেলে বাকিটা সামলে নিতে পারব আমরা। আমি ইতিমধ্যে মেছোডাঙার বাসিন্দাদের অফার দিয়েছি, কারখানা বড়ো করে চাকরি দেব তোমাদের। আমরা যে কারখানা বিক্রি করে সরে পড়ার তাল করছি, এটা ওদের বুঝিয়েছে আন্দোলনে থাকা শিক্ষিত মানুষ। মেছোডাঙার লোকেরা আমাদের বিশ্বাস করছে না। আপনি যদি পুরো অবস্থাটা আমাদের ফেভারে নিয়ে আসতে পারেন, প্রচুর টাকা দেব।

টাকার অঙ্ক শুনে চোখ কপালে উঠেছিল শুভ্রজ্যোতির। তখনও জানতেন না আরও দু’টো পার্টির থেকে এরকমই আকর্ষণীয় অফার আসবে। সরকারের এক প্রভাবশালী ফোন করে বললেন, কাজটা করে দিন। ভালো জায়গায় বদলি এবং প্রোমোশন দেব। পার্টির ছেলেদের দিয়ে কাজটা অনায়সে করানো যেত। আড়াইশোজনের প্রতিবাদ ধোপে টিকত না। কিন্তু এইসব সেনসেটিভ ইস্যুতে ইন্টারফিয়ারেন্স নিলে পার্টির বদনাম হবে। বিরোধী পার্টির সঙ্গেও আপসরফা হয়ে গেছে। আপনি শুধু ওই আড়াইশোজনকে সামলান।

এরপর ফোন এসেছিল ডেভলপারের কাছ থেকে। কাজটা করে দেওয়ার জন্য তারা যে-টাকার অফার দিয়েছে, স্বপ্নেও তা কল্পনার অতীত।

এত সব উজ্জ্বল প্রস্তাব পেয়ে নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের মতো হয়ে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। তিনটে পার্টির কাছেই তিনি সময় চেয়ে নেন। বলেন, আমাকে প্ল্যান সাজাতে দিন। আমি না-বলা পর্যন্ত আপনারা কোনও স্টেপ নেবেন না।

কাজ অনেকটাই মেরে এনেছেন শুভ্রজ্যোতি। মাথা ঠান্ডা রেখে ঝড়ঝাপটা সামলাতে হয়েছে ভালোই। এখন লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল অপারেশনটা বাকি। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছেন। টেনশন বাড়ছে, নাগালের মধ্যে এসে গেছে বিপুল টাকা, চাকরির উন্নতি! স্টেপিং-এর সামান্য ভুলে সমস্ত কিছু চলে যেতে পারে হাতের বাইরে। উৎকণ্ঠায় কাহিল হয়ে শুভ্রজ্যোতি, জীবনে প্রথমবার কোনও প্রফেশনাল জ্যোতিষীর কাছে চলেছেন। সন্তানের কোষ্ঠীবিচার বাবা হয়তো কখনও করিয়েছিলেন, ফলাফল জানা নেই শুভ্রজ্যোতির। আত্মীয়বন্ধু মহলে দু’চারজনের কাছে হাত দেখিয়েছেন। সেসব ভবিষ্যদ্বাণী কিছুই মেলেনি। ভাগ্যবিচারকে বুজরুকি, দুর্বল মনের আশ্রয় বলেই গণ্য করতেন শুভ্রজ্যোতি। টেনশনের চোটে এখন মনে হচ্ছে সামনেটা যদি একটু জানা যেত, মনটা বশে থাকত অ্যাটলিস্ট।

জ্যোতিষীর কাছে যাচ্ছেন, একজন ছাড়া কেউ জানে না। সেই ব্যক্তিই দিয়েছিল জ্যোতিষীটির হদিস। জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হওয়াটা গোপন রাখতে চান শুভ্রজ্যোতি। চন্দ্রিমাকে বলার প্রয়োজন নেই। দূরে থাকে বলে জানতেও পারে না, শুভ্রজ্যোতি কোথায় যান না যান। থানার সহকর্মীদেরও কিছু বলেননি। চেনা একজনের গাড়ি নিয়ে সিভিল ড্রেসে চলেছেন চণ্ডীতলা। সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি, একতলায় চেম্বার।

দেবনগরের পর দু’টো থানা-এরিয়া পেরিয়ে গঙ্গার খালের ব্রিজের ওপারে চণ্ডীতলা। জ্যোতিষীর বাড়ি নাকি খালের গায়েই। সঙ্গে কোনও সহকর্মী এবং থানার গাড়ি নিয়ে আসতেই পারতেন শুভ্রজ্যোতি। আনেননি দুটো ভিন্ন কারণে। এক, জ্যোতিষীর কাছে পুলিশ পরিচয় লুকোতেই পরনে সিভিল ড্রেস এবং ‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়ি নেননি। সামান্য ক্লু পেলেই জ্যোতিষীরা অ্যানালিসিস করে প্রচুর অপ্রয়োজনীয় কথা বলে দেয়। ফালতু সময় নষ্ট। শুভ্রজ্যোতি সামান্য হলেও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পেতে চান। আর সহকর্মী কারওকে আনেননি নিজের ইমেজের কথা ভেবে। থানার সকলেই জানে তিনি রাফ অ্যান্ড টাফ। এইসব মানুষের জ্যোতিষীর শরনাপন্ন হওয়া মানায় না।

সাবঅর্ডিনেটরা সমীহ করবে না। ওদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে না পারলে জলাভূমি দখল করা মুশকিল। এখন অবধি ওরা যে কো-অপারেশনটা করছে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়, সমীহ থেকে। এই তো যেদিন মেছোডাঙার চার মাথাকে ফল্স কেস-এ চালান করলেন কোর্টে, কাজ মিটিয়ে ফিরে আসছেন থানায়, গাড়িতে পাশের সিটে বসেছিল সিনিয়র স্টাফ বাসুদেব গড়াই। বলেছিল, হাতিডোবার বিলটা না বোজালেই নয় স্যার? ওদিক থেকে দারুণ একটা হাওয়া দেয় বলেই দেবনগর এলাকাটা এত শান্ত। তারপর ধরুন সস্তায় টাটকা মাছ পাওয়া যায়। শীতকালে কাছে পিঠে এত সুন্দর পিকনিক স্পট! সেই সাইবেরিয়া থেকে পাখি আসে…

উত্তরে শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, আপনি এক কাজ করুন, চাকরিতে রিজাইন দিয়ে পছন্দসই গ্রামে বসবাস করতে চলে যান। রিটায়ারমেন্টের সময় তো হয়েই এল, লস খুব একটা হবে না।

বাসুদেব গড়াই আর কথা বাড়ায়নি। কাজ শেষের মুখে গড়াইয়ের ন্যাকামি শুনে গা জ্বলে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। কত সতর্ক হয়ে মিশনটাতে এগিয়েছেন। অফারগুলো আসার পর প্রথমে মিটিং করলেন পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে। জলাজমি বুজিয়ে কী হতে চলেছে বললেন পুরোটাই। যদিও ওরা সবই জানত। শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, জায়গাটার উন্নয়ন হচ্ছে, আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন?

ওদের বক্তব্য, কারখানা বন্ধ করে বড়োলোকদের বাসস্থান কী ধরনের উন্নয়ন। গরিব সাধারণ মানুষের কী উপকার হবে এতে? পরিবেশ নষ্ট হয়ে বরং ক্ষতিই হবে মানুষের।

এর পরের মিটিং শুভ্রজ্যোতি করলেন মেছোডাঙার বাসিন্দাদের সঙ্গে। মেছোডাঙায় গিয়ে ওদের বোঝালেন, তোমরা প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। জীবনের মান উন্নত হবে তোমাদের। চরা ছেড়ে চলে যাও।

ওরা বুঝল না। বলল, আমরা ছিটেবেড়ার ঘরে ভালোই আছি। খেয়েপরে দিন চলে যাচ্ছে। কোনও উন্নতির দরকার নেই আমাদের।

কিন্তু সকলেই তো আর নির্লোভ নয়। শুভ্রজ্যোতি ছোট্ট একটা দান চেলে রেখে এসেছিলেন মেছোডাঙায়। বলেছিলেন, ঠিক আছে, তোমরা ভালো করে ভেবে দ্যাখো। আমি জোর করব না। যদি মত পরিবর্তন হয় থানায় এসে আমাকে জানিও। তোমাদের জন্য দরজা সব সময় খোলা।

ওদের মধ্যে মাত্র দু’জন এসেছিল চুপিচুপি। তারা জীবনে উন্নতি চায়। তাদের ইনফর্মার হিসেবে নিয়োগ করলেন শুভ্রজ্যোতি। তিনি জানতেন মেছোডাঙায় মাঝে মাঝে বাইরের থেকে দুষ্কৃতিরা এসে গা ঢাকা দেয়। মেছোডাঙার বাসিন্দারা ভয় পেয়ে আশ্রয় দেয় তাদের। দুই ইনফর্মার এক দাগি অপরাধীর গাঞ্জঢাকা দেওয়ার খবর দিল। ফোর্স নিয়ে তাকে ধরতে গেলেনঞ্জশুভ্রজ্যোতি। নৌকো করেই যেতে হয়েছিল। তাছাড়া অন্য উপায় তো নেই। অপরাধী পালাল। শুভ্রজ্যোতি জানতেন নৌকোর মতো ধীর গতির যান নিয়ে অপরাধীকে ধরা যাবে না। দুষ্কৃতিরা সেটা বুঝেই ওখানে গা ঢাকা দেয়। শুভ্রজ্যোতির আসল উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হল। দাগি দুষ্কৃতিকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে মেছোডাঙার চার মাথাকে অ্যারেস্ট করলেন।

এতেই আন্দোলনকারীদের মনোবল অনেকটা ভেঙে গেছে।

যে-কেসে অ্যারেস্ট করেছেন, থানায় এসে বিক্ষোভ জানাতে পারছে না তারা। তবে ওরা খুব শীঘ্রই বিক্ষোভ জানাবে কারখানার গেটে। শুভ্রজ্যোতির নির্দেশে কারখানার ম্যানেজার ভরাট করতে যাবেন জলা। এটা আসলে টোপ। আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে সামিল হলেই, শুভ্রজ্যোতি তার দুই ইনফর্মার এবং দু’চারটে ভাড়াটে গুন্ডা ঢুকিয়ে দেবে ভিড়ে। তারা ভাঙচুর করবে কারখানায়। পুলিশ এলে ইট ছুড়বে। শুভ্রজ্যোতি বেছেবেছে আন্দোলনকারীদের মাথাগুলোকে অ্যারেস্ট করবেন। এবার তারা বেল পেয়ে জেল থেকে বেরোতে বেরোতে ঠিকাদাররা ভরাট করে ফেলবে হাতিডোবার বিল। বাধা দেওয়ার মতো লোকবল, পাকামাথা ওদের দলে থাকবে না। কারণ, হাতিডোবার বিল নিয়ে দেবনগর এবং আশপাশের শহর মফস্সলের বাসিন্দাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। জলার হাওয়ায় তারা শান্তি পায়। দেখতে যায় না হাওয়াটা আসছে কোথা থেকে? হাওয়া যে দেখা যায় না। এমনই স্বার্থপর হয়ে উঠেছে মানুষ। অথচ যত দোষ শুধু পুলিশের!

এই ফুলপ্রুফ প্ল্যানে একটাই কাঁকর, গোপার ছেলে সৌম্য। সে আন্দোলনকারীদের একজন। গোপার সঙ্গে শুভ্রজ্যোতির ফস্টিনস্টির সম্পর্ক। শুভ্রজ্যোতি যখন যে থানায় গেছেন, সেই এরিয়ায় নিশ্চিত করে একটা নষ্টামির রিলেশন তৈরি হয়েছে, যার অাঁচ কিছুতেই পেৌঁছোতে দেন না বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। পার্টনারের সঙ্গে সেরকমই অ্যাডজাস্টমেন্ট করা থাকে। গোপা হাজব্যান্ড সলিলকে নিয়ে থানায় এসেছিল বাড়িওলার নামে অভিযোগ জানাতে। দোষ যদিও গোপাদের। দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া দেয় না। স্বাভাবিক কারণেই বাড়িওলা ওদের উঠে যেতে বলছে। হুমকি দিয়েছে অল্পবিস্তর। জলের লাইন কেটে দিয়েছে। গোপাকে পছন্দ হয়ে গেল শুভ্রজ্যোতির। ওদের বাড়িতে চা খেতে আসার নেমতন্ন পেলেন গোপার থেকে, সঙ্গে গোপার ভ্রূ ভঙ্গিতে আরও গোপন কিছু পাইয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত। শুরু করলেন ওদের বাড়িতে যাওয়া। বাড়িওলা জলের লাইন জোড়া লাগিয়ে দিল। ভাড়াও চায় না। সলিলটা ভেডুয়া টাইপের, শুভ্রজ্যোতি ওদের বাড়ি গেলেই কোনও একটা অছিলায় বেরিয়ে যায়। সমস্যা সৌম্যকে নিয়ে। কলেজে পড়া ছেলে। বাড়ির বাইরেই থাকে বেশিরভাগ। তবু কখনও যদি বাড়ি এসে শুভ্রজ্যোতিকে দেখে, এমন ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়, সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে শুভ্রজ্যোতির পক্ষে।

পরিবেশকর্মী বা আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেবনগর, নসিবপুরের লোক হাতেগোনা। বেশিরভাগ বাইরের। হাতেগোনা ক’জনের মধ্যে কেন যে সৌম্য কাঁকরের মতো রয়ে গেল… বিক্ষোভে কিংবা মিটিংয়ে যতবারই আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, সৌম্যর মতো ঘৃণার দৃষ্টিতে কেউ তার দিকে তাকায়নি। ও রাগ তো জলাভূমি নিয়ে নয়।

শুভ্রজ্যোতি গোপাকে বলেছেন, ছেলেকে ওসব আন্দোলনে থাকতে বারণ করো। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।

গোপা বলেছে, ও যেমন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে এবাড়িতে আসতে বারণ করে না, আমিও ওর ইচ্ছেতে বাধ সাধব না।

শুভ্রজ্যোতি একটা ব্যাপারে ভীষণ আশঙ্কিত হচ্ছেন, প্ল্যান মাফিক যে- গন্ডগোলটা কারখানার গেটে পাকাবেন ঠিক করেছেন, কোনও ভাবে যদি সৌম্য উন্ডেড হয়, একেবারে সাড়ে সর্বনাশ। ফোর্সকে তিনি যতই একজনকে বাঁচিয়ে অ্যাকশন করতে বলুন, ওই পরিস্থিতিতে সেই নির্দেশ পালন করা বেশ কঠিন।

সৌম্য পুলিশের মারে জখম হলে গোপা ছেড়ে দেবে না শুভ্রজ্যোতিকে। প্রতিশোধস্পৃহায় ফুঁসে উঠবে মায়ের মন। গোপা হয়তো চলে যাবে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে, আগুন জ্বালিয়ে দেবে শুভ্রজ্যোতির সংসারে। এই সব সম্ভাবনার কথা ভেবে শুভ্রজ্যোতির মনে উৎকন্ঠার পারদ ক্রমশ চড়ছে। ভবিষ্যতের আভাস পাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে সেই কারণেই।

চণ্ডীতলার জ্যোতিষীর সন্ধান দিন দশেক হল পেয়েছেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করে জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে ফিরছিলেন। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দেবাংশুর এখন ফার্স্ট ইয়ার। মেধাবী স্টুডেন্ড, জয়েন্টে র্যাংক করে চান্স পেয়েছে। বাবার ঘুষের টাকায় প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হতে হয়নি।

সে যাই হোক, এই ট্রিপে চন্দ্রিমা সঙ্গে ছিল না। শুভ্রজ্যোতির অপোজিট বার্থে বছর তিরিশের এক কো-প্যাসেঞ্জার বারবার পাথর লাগানো আংটিতে চুমু খেয়ে আংটির হাতটা কপালে ঠেকাচ্ছিল। চোখের সামনে ক্রমাগত একই ঘটনা ঘটতে থাকায় বেশ বিরক্ত হচ্ছিলেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলেটিকে একসময় বলেই ফেললেন, আপনি তো বেশ ভক্ত লোক মশাই। আপনার বয়সে এত ভক্তি সহজে দেখা যায় না।

খোঁচাটা খেয়ে ছেলেটি রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে ছিল। মুখে কিছু বলেনি। ঘটনাটা কিন্তু ঘটিয়েই যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সহযাত্রীর কাণ্ডকারখানা থেকে মনটাকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

ট্রেন শিয়ালদা পৌঁছোনোর পর যে কাণ্ডটা ঘটল, জানা গেল সহযাত্রীর ওই আচরণের কারণ। প্ল্যাটফর্মে নেমে ছেলেটি একটু বুঝি ত্রস্ত পায়ে হাঁটছিল শুভ্রজ্যোতির সামনে। ওর ধরনধারণ দেখে একটু ছিটিয়াল টাইপের বলেই মনে হচ্ছিল। আচমকা কোথা থেকে দুটো ছেলে ছুটে এসে ধাক্বা মারল ওই সহযাত্রীকে। মুহূর্তের মধ্যে ওর কাঁধের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে দু’জনেই ধাঁ।

পুলিশ হয়েও শুভ্রজ্যোতি ঘটনাটায় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। দুষ্কৃতিদের চেজ করা হয়ে ওঠেনি। সহযাত্রী ছেলেটি ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে বসে পড়ে মাথা চাপড়াচ্ছে। বলছে, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। সব গেল আমার… ও মা, এবার আমি কী করব…

শুভ্রজ্যোতি সহযাত্রীটির পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসেছিলেন। পিঠে হাত রেখে সহমর্মীর গলায় বলেন, মনে হচ্ছে ওদের কাছে খবর ছিল দামি কিছু ক্যারি করছেন আপনি। কী ছিল ব্যাগে?

হা-হুতাশ থামিয়ে ছেলেটি রাগের চোখে তাকিয়ে ছিল শুভ্রজ্যোতির দিকে। মুখ ঝামড়ে বলেছিল, প্রচুর টাকা ছিল। আমার বিজনেসের টাকা। ট্রেনে আপনি বলছিলেন না, আমার ভক্তি বেশি। ভক্তি এই কারণে। বলে ছেলেটি হাতের আংটিটা দেখিয়ে মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিল। আংটিতে পান্না বসানো। যে-জ্যোতিষী দিয়েছিলেন, বলে দেন বিপদে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই রত্নের রং গাঢ় হতে শুরু করবে। তখনই যেন সতর্ক হয়ে যায় ছেলেটি। ট্রেন জার্নি-তে পান্নার রং আরও সবুজ হতে দেখে ছেলেটি চিন্তায় পড়ে যায়। সামনের স্টেশনে নেমে পড়বে, নাকি পুরোটাই যাবে? বিপদ দু-জায়গাতেই ওত পেতে থাকতে পারে। তাই সে আংটিতে চুমু খেয়ে আংটি কপালে ঠেকিয়ে ভগবানের কাছে বারবার প্রার্থনা করছিল, এ যাত্রায় সে যেন বেঁচে যায়।

শেষ রক্ষা হয়নি। শুভ্রজ্যোতি কিন্তু তাঁর এই টেনশনের সময়কালে পাওয়ারফুল জ্যোতিষীর সন্ধান পেয়ে গেলেন। ছেলেটিকে বলেছিলেন, ব্যাপারটা আপনি আগে বলবেন তো আমাকে! আমি পুলিশ। আর্মস আছে সঙ্গে। অ্যালার্ট থাকতে পারতাম।

আপনি পুলিশ, আমি জানব কী করে! বলেছিল ছেলেটি। ভুল কিছু বলেনি। ছেলেটিকে শুভ্রজ্যোতি নিয়ে যান জিআরপি-তে। নিজের পরিচয় দিয়ে ডায়ারি লেখান। ততক্ষণে জ্যোতিষী চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যর ঠিকানা নিয়েছেন ছেলেটির থেকে। জ্যোতিষী সপ্তাহে তিনদিন দুপুর দু’টো থেকে সন্ধে ছ’টা অবধি চেম্বারে বসেন। প্রবল ভিড় হয়। নাম লেখাতে হয় আগে থেকে। সোমবার ভিড় একটু কম।

আজ সোমবার। গত শনিবার ফোন করেছিল পল্লব, ট্রেনের সেই সহযাত্রী। সুখবর শোনাল। বলল, আপনার সঙ্গে গিয়েছিলাম বলেই জিআরপি উঠে পড়ে লেগে আমার অনেকটা টাকাই উদ্ধার করে ফেলেছে। আপনি পুলিশ অফিসার বলেই কেসটা সিরিয়াসলি নিয়েছিল ওরা। কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব আপনাকে… যাই হোক চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন নাকি ইতিমধ্যে?

না, যাইনি। দু’একদিনের মধ্যেই যাব। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

পল্লব বলল, সোমবার চলে আসুন। আমি যাচ্ছি। নাম লিখিয়ে রাখব। ক’টা নাগাদ আসবেন বলুন।

বিকেল চারটের আশেপাশে যাবেন বলে রেখেছেন শুভ্রজ্যোতি। আধঘন্টা মতো দেরি হয়ে গেল। পল্লব নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।

খালের ব্রিজে গাড়ি নিয়ে এসে পড়েছেন শুভ্রজ্যোতি। খালে টলটলে জল। ব্রিজ থেকে নেমে যে-রাস্তাটা খাল বরাবর চলে গেছে, সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি।

রাস্তাটা অপ্রশস্ত এবং শুনসান। ডানপাশে খাল, বাঁ দিকে পরপর চালাঘর, পাকা ছাদের বাড়ি চোখেই পড়ছে না। গাড়ির স্পিড আস্তে করে নিয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে জ্যোতিষীর বাড়ি কোনটা?

ছেলেটি এসে পড়ল। শুভ্রজ্যোতি গাড়ি থামালেন। ছেলেটিকে বললেন, চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়িটা কোথায়?

– সোজা চলে যান। লাল রকওলা দোতলা বাড়ি। বলার পর ছেলেটি জানতে চাইল, আপনি কি হাত দেখাতে এসেছেন?

হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না শুভ্রজ্যোতি। শুধু ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলেন, এটা পুলিশি অভ্যেস। ছেলেটা নিজের থেকেই প্রশ্নের কারণটা বলবে। এবং বলল, উনি হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন মাস খানেক হল। গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

কেন ছেড়ে দিয়েছেন জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলেন না শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। পল্লব কি তাহলে জানে না হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন? ও যে বলল নাম লিখিয়ে রাখবে? নাম না লেখাতে পেরে একটা ফোন করতে পারত। পল্লবকে এখন কি একবার ফোন করবেন শুভ্রজ্যোতি? না, থাক। জ্যোতিষীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক না ব্যাপারটা। এতটা যখন এসেই পড়েছেন।

নীচের তলার ঘরে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য গোমড়া মুখে বসে রয়েছেন তক্তপোশের ওপর। সামনে কাঠের চেয়ারে শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল আরোহী সঠিক খবরই দিয়েছে, ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পর পর ছ’জনের হাতে আসন্ন মৃত্যুযোগ দেখার পর তাঁর মনে হয়েছে, ঈশ্বর চান না তিনি আর ভাগ্যবিচার করুন। তাই সেই সব মানুষকেই হাত দেখাতে পাঠাচ্ছেন, যাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। যে ছ’জনের গণনা তিনি করেছিলেন, চারজনের মৃত্যুর খবর কানে এসে পৌঁছেছে, দু’জনের কী হয়েছে জানেন না। মৃত্যুযোগ প্রতিকারের ক্ষমতাও নেই চিত্তরঞ্জন জ্যোতিষীর। মিছিমিছি ভাগ্যগণনা করে কী লাভ! ঈশ্বর তাঁকে যতটুকু সম্পদ দিয়েছেন, বাকি জীবনটা ওতেই চলে যাবে।

শুভ্রজ্যোতি অনেক অনুনয়-বিনয় করে নিজের হাতটা দেখানোর চেষ্টা করলেন। পল্লবের রেফারেন্স দিলেন। বললেন ওঁরই দেওয়া সেই আশ্চর্য পান্নার কথা, বিপদ কাছে এলে যার রং গাঢ় হয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন পল্লবকে মনে করতে পারলেন না। পরপর খারাপ হাত দেখে জ্যোতিষ ব্যাপারটা থেকে মন উঠে গেছে তাঁর। বাধ্য হয়ে শুভ্রজ্যোতি হুমকি দিলেন, হাত আপনাকে আমি দেখিয়েই ছাড়ব। এতেই ঠিক হয়ে যাবে কার মরণ আসন্ন, আপনার না আমার।

এরপর থেকেই গুম মেরে গেছেন চিত্তরঞ্জন। এবার মুখ তুললেন। বললেন, আপনি পুলিশ বলেই এভাবে জোর খাটাচ্ছেন। ভাগ্যবিচার আমি করে দিচ্ছি। দেখে যেটা বুঝব, সেটাই বলব। ধাক্বাটা সহ্য করতে পারবেন তো?

আমি পুলিশ, কী করে জানলেন? নিশ্চয়ই পল্লব বলেছে। অথচ বলছেন পল্লবকে মনে করতে পারছেন না।

আপনার কথা কেউ আমাকে বলেনি। চুলের ছাঁট, কোমরে বেল্ট, জামা গুঁজে পরা, ঠায় শিরদাঁড়া সোজা রেখে বসা, এক দু’বার ঝোঁকার চেষ্টা করেও পারলেন না। বগলের তলায় বেল্টের সঙ্গে বাঁধা আছে পিস্তল। সর্বপরি আপনার শীতল চাহনি, দীর্ঘদিন পুলিশে চাকরি না করলে এমনটা হয় না। পিস্তল আর চাহনির চাপে পড়েই আপনার ভাগ্য গণনায় রাজি হলাম আমি। একটু বসুন, ওপর থেকে খাতাপত্তর নিয়ে আসি।

তক্তপোশ থেকে নেমে ঢিমেতালে বাড়ির ভিতরে গেলেন চিত্তরঞ্জন। শুভ্রজ্যোতির একটু ভয় ভয় করছে, লোকটা যা বলছেন, সত্যি হবে না তো? মৃত্যুযোগ কি আমার হাতেও আছে? ভগবানের পাঠানো সাত নম্বর ব্যক্তি কি আমি? …চিন্তাটা কাক তাড়ানোর মতো মাথা থেকে তাড়ান শুভ্রজ্যোতি। আগের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ কাকতালীয়। তাছাড়া ছ’জনের মধ্যে দু’জন হয়তো বেঁচে আছে, যাদের খবর পাননি চিত্তরঞ্জন। পল্লবের ব্যাপারটা নিয়ে শুধু ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। বলল, আজ আসবে। নাম লিখিয়ে রাখবে…

চিত্তরঞ্জন ফিরে এলেন। হাতে হালখাতার মতো লাল পুরোনো খাতা আর ম্যাগনিফায়িং গ্লাস। তক্তপোশে উঠে বসে চিত্তরঞ্জন বললেন, বলুন, আপনার জন্মের সময় আর তারিখ।

বললেন শুভ্রজ্যোতি। খাতা খুলে ছক কাটতে লাগলেন চিত্তরঞ্জন। নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। আঁক কাটা শেষ হতে বললেন, দিন, এবার ডানহাতটা দিন।

হাত বাড়ালেন শুভ্রজ্যোতি। হাতটা ধরে ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে দেখছেন চিত্তরঞ্জন। মোটা কাচের চশমা তো আছেই, আতসকাচও ব্যবহার করছেন।

এবার বাঁ-হাতটাও চেয়ে নিলেন। শুভ্রজ্যোতি নিবিষ্ট হয়ে জ্যোতিষীর এক্সপ্রেশন পড়ার চেষ্টা করছেন। চিত্তরঞ্জনের কপালের ভাঁজ এক এক করে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্তি দেখা দিচ্ছে চেহারায়। এবার মুখ তুলে একগাল হেসে বললেন, নাঃ, নেই মৃত্যুযোগ। এখনও বহুদিন বাঁচবেন। উন্নতি করবেন জীবনে। প্রচুর অর্থ উপার্জনও হবে। সুখে কাটবে বাকি জীবনটা।

শুভ্রজ্যোতির মুখে হাসি ফিরে এসেছে। হাত দু’টো ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, দেখলেন, কেমন একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েছিলেন। আমি জোর না করলে ভুলটা আপনার ভাঙত না, থেকেই যেত।

আসলে একের পর এক মৃত্যুর গ্রহণ লাগা হাত দেখতে কার ভাল লাগে বলুন! বিষণ্ণ গলায় বললেন চিত্তরঞ্জন।

শুভ্রজ্যোতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। পার্স বার করে একটা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন চিত্তরঞ্জনের দিকে। বললেন, এতে হয়ে যাবে তো?

টাকা দিচ্ছেন কেন! আমি তো ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছি। আপনি জোর করলেন বলেই…

শুভ্রজ্যোতি জ্যোতিষীর ডানহাতটা তুলে ধরে নোটটা রাখলেন। বললেন, প্রফেশন ছেড়ে দেবেন কেন? এই তো আজ একটা ভালো হাত পেলেন। এবার থেকে দেখতে থাকুন। মিছিমিছি নিজের ক্ষমতাকে অপচয় করবেন না।

শুভ্রজ্যোতি রিল্যাক্সড্ ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নোটটা ফতুয়ার পকেটে ঢোকাতে অস্বস্তি হচ্ছে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের। আবার অবসাদ ঘিরে ধরেছে তাকে। এই লোকটাও বাঁচবে না। মানুষটাকে মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কালসর্প যোগ আছে লোকটার। মানে অপঘাতে মৃত্যু। ফণা উঁচিয়ে আছে নিয়তি। আর ঘন্টা খানেকও বাঁচবে কিনা সন্দেহ। এরকম দাপুটে মানুষটা নিয়তির কাছে বড়ো অসহায়! লোকটার প্রতি মায়া হয় চিত্তরঞ্জনের। মানুষটাকে শেষবার দেখার জন্য বাড়ির রকে এসে দাঁড়ালেন। আঁতকে উঠলেন সামনের দৃশ্য দেখে! মৃত্যু যে বাইরেই ওত পেতে ছিল, ভাবতেই পারেননি। চার, নাকি পাঁচজন যুবক পুলিশ লোকটার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়ির বনেটে শুইয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে নিলেন চিত্তরঞ্জন। এক্ষুনি গুলি চালানোর শব্দ আসবে কানে।

আসছে না দেখে চোখ খুললেন। এখন অন্য দৃশ্য, কপালে বন্দুক ঠেকানোই আছে পুলিশের। লোকটাকে দিয়ে একটা কাগজে কী সব লেখাচ্ছে ছেলেগুলো। বেশি লিখতে হল না। সই করাল সম্ভবত। লোকটাকে ছেড়ে দিল ওরা। পুলিশটা দৌড়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। দু’টো বাইকে পাঁচজন যুবক চেপে চলে গেল জুটমিল বস্তির দিকে। নিয়তি তার মানে ছেলেগুলির ইচ্ছে অনুযায়ী ফণা নামিয়ে নিল। বেঁচে গেল লোকটা। ওই যুবকরা কি তা হলে নিয়তির চেয়েও শক্তিমান।

ছেলেগুলো খুন করেছে। শুভ্রজ্যোতিকে নয়, ওঁর ভিতরে থাকা খারাপ পুলিশটাকে। ব্রিজের ওপর উঠে এসে শুভ্রজ্যোতি আর গাড়ি চালানোর রিস্ক নেননি। হাত কাঁপছে, ধড়াস ধড়াস করছে বুক। গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। খারাপ পুলিশটার নগ্ন দেহ যেন খালের জলে ভেসে আসতে দেখছেন। এরকম হুমকিই দিয়েছিল ছেলেগুলো। আচমকা মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছিল পাঁচজন। শুভ্রজ্যোতি নিজের আর্মস বার করার সুযোগই পাননি। কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলল, কোনও সেয়ানাগিরি নয়। যা বলছি শোন। নয়তো দানা ভরে জামাকাপড় খুলে লাশ ফেলে দেব খালে। ভাটার টাইম, ভাসতে ভাসতে অন্য জেলায় চলে যাবি।

শুভ্রজ্যোতিকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে আসাটা ছিল ট্র্যাপ। শুনশান এলাকা। খালটা জেলার সীমানায়। এখানে বডি ফেলে দিলে নিখোঁজ শুভ্রজ্যোতিকে জেলার পুলিশ খোঁজার পর সারা রাজ্যজুড়ে তল্লাশি চলত। ততক্ষণে বডিটা হয়তো পৌঁছে যেত সাগরে। খুনের কোনও প্রমাণ থাকত না।

পাঁচজনের দলে পল্লব তো ছিলই আর ছিল গোপার ছেলে সৌম্য, সঙ্গে আরও দু’জন আন্দোলনকারী। বাকি দু’টো ছেলেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। ওরা যে-কাগজে সই করাল, তাতে শুভ্রজ্যোতি পুলিশ জীবনে যা যা অপরাধ করেছেন, সমস্ত লেখা আছে। ছেলেগুলো এতসব জোগাড় করল কী ভাবে, কে জানে! কাগজটা ছিল স্বীকারোক্তির বয়ান। শুভ্রজ্যোতিকে সাইন করিয়ে ওরা বলল, হাতিডোবার বিলে হাত বাড়াবি না। পুলিশ হওয়ার অ্যাডভান্টেজ নিবি না আর কখনও। যদি নিস, এই ডিক্লেয়ারেশনের এক কপি যাবে সিআইডি  ডিপার্টমেন্টে, আর একটা কপি মিডিয়ায়। প্রাণে বেঁচেছিস, এটাই জানবি তোর চোদ্দো পুরুষের ভাগ্যি।

মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা! এখন অনেকটা ধাতস্থ লাগছে। খারাপ পুলিশটা ব্রিজের তলা দিয়ে আবর্জনার মতো ভেসে গেছে সাগরের দিকে। পশ্চিম দিক থেকে ঠাণ্ডা ভেজা বাতাস বয়ে আসছে। সম্ভবত হাতিডোবা বিলের হাওয়া। শুভ্রজ্যোতি এবার চন্দ্রিমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দেবনগরে নিয়ে আসবেন। বলবেন, ছেলে যখন বাইরে, কলকাতায় একা থেকে কী করবে! দেবনগরে একসঙ্গে থাকি চলো। জায়গাটা বেশ ভালো। হইচই নেই। নিরিবিলি। পশ্চিমি হাতিডোবার বিল থেকে উঠে আসা হাওয়ার প্রভাবেই এলাকাটা এত শান্ত! যে-কথা বলবেন না, তা হল, কিছু অশান্ত, দামাল যুবক অহর্নিশ হাওয়াটাকে পাহারা দেয়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...