সরলা মাসি একেবারে খাঁটি বাঙাল। খাসা হাতের রান্না। ‘বাঙালরা আনাজপাতির খোসাও ছাড়ে না’ কথাটা ব্যাঙ্গাত্মক শোনালেও, কোনও ঘটি মাইয়ার পক্ষে ওই খোসাকেই অতুলনীয় সুস্বাদু করে তোলা প্রায় অসম্ভব। আমার রান্নার লোক। বহুদিন হয়ে গেল রয়েছে এবাড়িতে। তার টানটান বাঙাল ভাষার সঙ্গে রসিকতা তো তুলনাহীন। বেশ মজায় কাটে সকালটা। সেদিন সকালে রান্নাবান্না নিয়ে মাসির সঙ্গেই কথা বলছি, সেই সময় পাশের বাড়ি থেকে সোমার চিৎকার, ‘কেয়া আছিস? আয় শিগগির একটা জিনিস দেখে যা।’
ক্ষণিক বিলম্ব না করেই জবাব দিলাম, ‘আসছি আসছি।’ কারণ, খুব ভালো করেই জানি সাড়া না দিলে এক্ষুনি বাড়িতে চড়াও হবে। কালই মুম্বই থেকে ওর বর ফিরেছে। নিশ্চয়ই ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। সেটা দেখানোর জন্যই এত তৎপর। যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই মাসি বেশ মজা করেই বলল, ‘যাও তোমারে হোয়াগ কইরা ডাকতাসে, কত কী দ্যাহাইব।’
‘ওঃ মাসি তুমিও না। ও যদি একটু দেখিয়ে শান্তি পায়।’
‘যাও যাও। তোমারে কেডা আটকাইতাসে।’
খানিক হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে তুমি রান্না করো। আমি আসছি।’
সোমার বাড়িতে ঢোকা মাত্রই একপ্রকার পাকড়াও করে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসিয়েই হাতে একটা সালোয়ার কামিজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ কী সুন্দর, না?’
‘দারুণ রে, কাপড়টাও খুব ভালো। কৌশিক এনেছে না?’
‘আর কে আনবে বল? ওই একজনই তো আছে আমার ডার্লিং। দ্যাখ না এইবার তো তিনটে নাইটিও নিয়ে এসেছে। এটা তো আমি কাল রাতেই পরেছিলাম। কী সেক্সি না।’ সোমার চোখেমুখে খুশি ফুটে উঠল। ‘মাসে একবারই তো বাড়িতে আসে। যা যা নিয়ে আসে সব ওকে পরে পরে দেখাতে হয়, না হলেই তেনার মুখভার।’
‘তবে একটা কথা মানতেই হবে কৌশিকের আনা নাইটিগুলো সত্যিই অন্যরকম। এগুলো পরলে অটোমেটিক একটা রিচ লুক চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে বললাম বটে, কিন্তু কেন জানি না খটকা একটা ছিলই। আমরা যে-স্ট্যান্ডার্ডে বিলং করি সেখানে এইধরনের ড্রেস একেবারেই খাপ খায় না। যে-কোনও কিছুর জন্যই যথাযথ পরিবেশ থাকাটা জরুরি। সেই পরিবেশ আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে কোথায়? ছোট্ট পরিসরে ফ্যামিলির সঙ্গে থাকতে গেলে এমন ভাবনাই ভুল। সেখানে কৌশিকের এমন পছন্দ…! ওর ব্যাকগ্রাউন্ডও তো তেমন সাউন্ড বলে মনে হয় না যে বলব,
বংশপরম্পরায় পাওয়া। তারপরেই মনে হল দূর এসব কী নিয়ে পড়লাম আমি, নিজেকে সংযত করলাম।
সোমা তখনও স্বামীর নাম জপে চলেছে। সেই সময় আমার বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠল। বাড়ি যাওয়ার একটা ছুতো পেয়ে গেলাম। ‘আমি আসি রে। কে ফোন করছে কে জানে। মাসিও তো রান্না সেরে বাড়ি ফিরবে। সব দেখে-টেখে নিই। যাই।’ বলেই বেরিয়ে এলাম। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই ফোনটা কেটে গিয়েছিল।
ফিরে আসার পরেও মনটা ওই নাইটির মধ্যেই আটকে রইল। শুধু কেন কেন কেন – মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন। স্বামীর এত প্রশংসা – কেন কী দেখাতে চায় ও? ওর স্বামী ওকে কত ভালোবাসে, নাকি কৌশিক এখন অনেক টাকা রোজগার করছে, সেটা জানানোটাই প্রধান উদ্দেশ্য।
কদিন আগেও তো কৌশিক স্টেজ-শো করে বেড়াত। সুদর্শন হওয়ার সুবাদে দু-একজন পরিচালকের দয়ায় সিরিয়ালে ছোটোখাটো রোলে অভিনয় করত। হঠাৎ বউয়ের কথা শুনে নতুন ব্যাবসা শুরু করে এত টাকা উপায় করে ফেলল যে, ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত কিনে ফেলল।
ভাবনায় এতটাই মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম যে, বুঝতেই পারিনি, মাসি এর আগেও আমাকে ডেকেছে। এবার বেশ জোরেই বলে উঠল, ‘কী ভাবতাস কও তো। তহন থেইকা ডাকতাসি।’
‘ও! হ্যাঁ হ্যাঁ। বলো কী বলছ?’
‘কইতাসি, রান্না হইয়া গেসে। আমি আইতাসি।’
দুপুরে খাবার পর শুয়ে শুয়ে টিভিতে খবর দেখছি, ফোনটা আবার বেজে উঠল। রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল খুনশুটি মেশানো স্বর, ‘হাই জানু, কী করছ?’
‘আরে টিভি দেখছিলাম…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপার থেকে বলতে শুরু করল, ‘টিভির দোহাই কেন দিচ্ছ ডিয়ার, বলোই না অজিত ছাড়ছিল না, তাই ফোন ধরতে এত দেরি করলে।’ স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বলে যাচ্ছিল রাইমা।
‘রাইমা, সত্যি তুই আর শোধরালি না।’
‘শোধরাতে চাইলে তবে না শোধরাব। মুম্বইতে এসে তো আরও বিগড়ে গেছি। তুইও আয় তোকেও বিগড়োনোর সব পথ বাতলে দেব। অ্যায়েশ কাকে বলে দেখবি তখন।’
‘কী করে যাব বল। জানিসই তো অজিতের ব্যাবসার চক্বরে এখন আর কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠে না। এখন তো বিজনেসের খানিকটা দায়িত্ব আমার কাঁধেও চাপিয়ে দিয়েছে। সময়ের অভাবে এখন আর স্ক্রিপ্টও লিখতে পারি না।’ মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার।
‘ডোন্ট ওরি কেয়া, ম্যায় হু না। সামনের মাসেই কলকাতায় আসছি। তোকে দিয়েই পুরো স্ক্রিপ্ট লেখাব ভেবেছি। কলকাতায় তো সময় দিতে পারবি নাকি?’
‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ এখানে হলে আমি ঠিক সময় বার করে নেব। তুই শুধু জানাস কবে আসবি, সেইমতো তোর থাকার ব্যবস্থা করব আমি।’ এক ঝটকায় মনটা ভালো হয়ে গেল।
‘না না, আমি হোটেলেই থাকব। কেন আমার আনন্দটা মাটি করতে চাইছিস বলতো।’ বেশ অবাক হয়েই বললাম, ‘মানে। ঠিক বুঝলাম না।’
‘জীবনকে কীভাবে উপভোগ করতে হয়, সেটা এখনও শিখিসনি তুই।’
‘তুই কী বলছিস কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বোকার মতো বলে বসলাম।
‘স্টুপিড কোথাকার। তোকে বুঝতেও হবে না। যখন কলকাতায় আসব সময় নিয়ে তোকে সব বোঝাব। চল ফোন রাখছি। আমার স্পেশাল খাবার এসে গেছে।’
‘স্পেশাল খাবার! হ্যাঁ তো ঠিক আছে না খেতে খেতেও তো…’ ততক্ষণে ফোনটা কেটে গেছে। রাইমাটা কী যে করে! যাকগে আমার জন্য এটাই ভীষণ খুশির খবর যে, ও কলকাতায় আসছে। হিন্দির পাশাপাশি বাংলাতে অনেক সিরিয়াল, টেলিফিল্ম বানিয়েছে ও।
সাত বছর আগে সেই যে সিরিয়ালের শ্যুটে মুম্বই গেল, ওখানকার হয়েই থেকে গেল। মাঝে ওর বাংলা সিরিয়ালের জন্য বার চার-পাঁচেক স্ক্রিপ্টও লিখেছি। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। অনেকে তো ভাবত, আমরা দুই বোন। আজ ও উচ্চতার শিখরে পৌঁছে গেছে। একডাকে সবাই চেনে। বলা যেতে পারে সেলিব্রিটি। এত কিছুর পরেও কিন্তু আমাকে ভোলেনি। ওখানে গিয়ে বহুবার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু সংসারের জন্য সম্ভব হয়নি। এখন যখন রাইমা এখানে আসছেই, কাজের জন্য বেশ কিছুদিন থাকার প্ল্যানও আছে, তখন আমারও কাজ করতে অসুবিধা নেই।
সেইদিন রাতেই অজিতকে, রাইমার শহরে আসা থেকে আমার স্ক্রিপ্ট লেখা সব কিছুই জানালাম। আনন্দে উচ্ছ্বসিত অজিত, আমার হাতদুটো ধরে বলেছিল, ‘বিশ্বাস করো কেয়া, আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার ব্যাবসার চক্বরে তোমার ট্যালেন্ট চাপা পড়তে বসেছে। হয়তো তোমাকে বলতে পারিনি, মনে মনে ভীষণ অনুশোচনা হতো। যাক, আজ আমি খুব খুশি।’
এখন শুধু রাইমা আসার অপেক্ষা।
দিনকতক পরে শহরে পৌঁছে একটি পাঁচতারা হোটেলে উঠল সে। হোটেলে চেক-ইন করার পরেই ফোন করে ডেকে নিল আমাকে। তৈরি হয়ে বেরোতে যাব, সেই সময় সোমা এসে হাজির। ঘরে ঢুকে কোনও দিকে না দেখেই হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্যাখ, আংটিটা। কাল শপিং করতে গিয়েছিলাম। সামনে জুয়েলারি শপ দেখে লোভে পড়ে ঢুকে গেলাম। কিনে ফেললাম আর কী। কেমন হয়েছে রে?’
কোনওরকমে দেখে বললাম, ‘ভালো হয়েছে।’
আমার দেখার ধরনটা ঠিক ওর পছন্দ হল না। মুখটা কেমন একটু বাঁকিয়েই বলল, ‘কোথায় এমন যাচ্ছিস যে একটু ভালো করে দেখবি সেই সময়ও নেই তোর।’
‘হ্যাঁ সত্যিই সময় নেই রে। সিরিয়ালে স্ক্রিপ্ট লেখার একটা কাজ পেয়েছি। প্রোডিউসারের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি। সরি রে আমি ফিরে তোর সঙ্গে কথা বলব।’
জানি এসব টিভি সিরিয়াল, অ্যাক্টিং ওর একেবারেই পছন্দের নয়। সেই কারণেই কৌশিকের পিছনে সর্বক্ষণ পড়ে থাকত। এসব ছোটোখাটো কাজ ছেড়ে যাতে মোটা টাকা উপার্জন করতে পারে, সেরকম কাজ করার কথাই বলত। আজ অবশ্য প্রপার্টি ডিলিং-এ ভালোই ইনকাম করছে সে। সোমার খুশি থাকার কারণই হল তাই। কৌশিক সোমাকে এত টাকা দেয়, যখন যা খুশি কিনে ফেলে।
‘অজিতদা জানে যে তুই…’
দরজায় তালা দিতে দিতেই বললাম, ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ।’ সোমা মুখ ব্যাজার করে চলে গেল। আমিও তর্কে না জড়িয়ে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।
হোটেলে পৌঁছেই দেখলাম রাইমাকে ঘিরে সাত-আটজন বসে রয়েছে। আমাকে দেখেই উঠে এসে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানাল সে।
‘হাই, মাই সুইটহার্ট… অনেকদিন পর দেখা হল আমাদের।’
‘সত্যিই অনেকদিন হয়ে গেল। তোকে ভীষণ মিস করতাম।’
‘ওহ্ রিয়েলি, সো সুইট। আয় বস।’ ওর পাশেই বসাল আমাকে।
‘আলাপ করিয়ে দিই, এ হল আমার সুইটহার্ট, কেয়া। আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু আর খুব ভালো রাইটারও… দশ বছর তো হয়েই গেছে না আমাদের বন্ধুত্বের… কী রে কেয়া তাই তো?’
হেসে উত্তর দিলাম, ‘বেশি হবে।’ সবার চোখেই তার প্রতি বেশ একটা সমীহ নজরে পড়ল।
‘কেয়া, ইনি হলেন ডাইরেক্টর বিনয়, ইনি মিউজিক ডিরেক্টর শতদ্রু। আর এরা রাহুল, সুমিত, প্রিয়ংকা আর শামসের। এরা সবাই শিল্পী তো বটেই, সঙ্গে আমার সমস্ত কাজ এরাই দেখাশোনা করে। আমাকে কিছু করতেই দেয় না।’
বুঝতেই পারলাম এরা সবাই রাইমার সহকারী। ‘রাহুল খাবারদাবারের ব্যবস্থা করো। অর্ডার দেওয়া হয়েছে তো?’ প্রশ্ন করল রাইমা।
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম এক্ষুনি চলে আসবে।’
মিনিট চল্লিশ পর খাওয়াদাওয়ার শেষে রাইমা সবাইকে সবার কাজ বুঝিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিল। ঘরে এখন ও আর আমি। ‘দ্যাখ পরের সিরিয়ালে আমি বাছা বাছা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছি। সেইমতো কথাও হয়েছে কয়েকজনের সঙ্গে। সুতরাং স্ক্রিপ্ট-টা কিন্তু ফাটাফাটি হওয়া চাই।’ ওর কথা বলার স্টাইল দেখেই মনে হল ও ওর কাজের প্রতি কতটা যত্নশীল।
ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। তারপর কিছু রিসার্চ পেপার দিল আমাকে, যেগুলোকে বেস করেই স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে আমাকে।
ওর কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বলেই ফেললাম, ‘এই কয়েক বছরেই ইন্ড্রাস্ট্রির খুঁটিনাটি সব কিছু বিষয়ে দারুণ অভিজ্ঞ হয়ে গেছিস।’
‘ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করব আর সেই জায়গা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকবে না তা কখনও হয় বল? তুইও আমার সঙ্গে থাক, তোকেও সব শিখিয়ে-পড়িয়ে নেব।’ বলেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘মনেই হচ্ছে না যে, তুই আমার সেই পুরোনো বন্ধু রাইমা।’
‘মনে হবে কী করে। আমি তো সত্যিই আর আগের মতো নেই।’ কথাটা শেষ করে আবার হেসে ফেলল সে।
‘আচ্ছা ঠিক আছে, এসব প্রসঙ্গ ছাড়। বলতো, অজিত তোর ঠিকঠাক দেখাশোনা করে তো?’
ওর চোখের দুষ্টু চাহনি দেখেই বুঝেছিলাম, এবার আমাকে রাগাবার ধান্ধায় আছে।
বললাম, ‘খুব ভালো করেই দেখাশোনা করে, খেয়াল রাখে…, আমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে না?’
‘আচ্ছা আর একটা কথা বল?’ ঠোঁটের কোণায় সেই শয়তানি হাসি।
‘আবার কী?’ বেশ বিরক্ত হয়েই বললাম।
‘না, বলছি রোজরোজ একই মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে তুই বোর হয়ে যাস না। না মানে, নতুন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না তোর?’
‘এই, তোর এই কথাগুলোই আমার ভালো লাগে না। ভালো কিছু বলতে পারিস না?’
‘দ্যাখ সেটাই তো বলছি, আমার একই কথা যেমন তোর ভালো লাগে না, সেইরকমই রোজরোজ একই জিনিস… মনে হয় না, নতুন কিছু করে দেখাই? বিলিভ মি, এই বিন্দাস লাইফ উপভোগ করতে শিখেছি মুম্বই গিয়ে। এখানে তো বেশিরভাগই মুখোশধারী।’ কথার মাঝেই ফোনের কি-বোর্ডে তার ফাইলকরা নেলপেইন্ট লাগানো আঙুলগুলো খেলা করে বেড়াচ্ছিল। আধুনিক জীবনের জনসংযোগ ব্যাবস্থা।
‘দ্যাখ সেই সকালে এসেছি, এখন সন্ধে হয়ে গেছে। কত কাজ, ক্লান্তি আসাটাই তো স্বাভাবিক বল। এখন মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য তো আর জয়পুর থেকে বরকে আসতে বলতে পারি না। যখন খিদে পায়, তখনই খাওয়া উচিত, বাড়ি ফিরে ঘরের খাবারই খাব এটা তো অযৌক্তিক ভাবনা, তাই না। বল এব্যাপারে তোর কী অভিমত।’
‘রাইমা, ক্ষ্যামা দে বাবা। ওহ্ তুই আর তোর চিন্তাভাবনা।’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় নক করে রাহুল ভিতরে এল।
‘বলুন ম্যাডাম।’
‘জয় কোথায়?’ বলেই আগ্রহী ভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘জয় পরশুদিনের শুটিং-এর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে গেছে। মিনিট পাঁচেক আগেই ফোন করেছিল। আসার সময় হয়ে এসেছে।’
‘ঠিক আছে। এলেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। তুমি একটু ড্রিংকস বানাও।’
‘ঠিক আছে ম্যাডাম।’ বলেই সে তার কাজে লেগে গেল।
রাহুলকে ড্রিকংস বানাতে বলার পর মুচকি হেসে হঠাৎই আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘এনজয় করেছিস কখনও? জীবন কাকে বলে জানিস?’
‘এ আবার কেমন কথা হল! গতবারই তো গৌহাটিতে গিয়ে দারুণ মজা হল। অজিত, আমি, মা, বাবা, অজিতের বন্ধুর ফ্যামিলি।’
রাইমা মাথা চাপড়ে বলল, ‘ধ্যাত তেরি কা। তোর দ্বারা কিস্সু হবে না।’ রাহুল ততক্ষণে ড্রিংক তৈরি করে দিয়ে চলে গেছে।
‘চল আজ আমরা দুজনে একসাথে জীবনটা উপভোগ করব।’ বলেই রাইমা আমার হাতে একটা আলতো চাপ দিল।
‘মানে!’ বিস্ময় ভরা নজরে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।
‘জয় বলে যে-ছেলেটাকে ডেকে পাঠালাম, দেখবি দারুণ হ্যান্ডসাম আর খুব চার্মিং। রাজস্থানের ছেলে… টুকটাক অভিনয় করত। অ্যাক্টিং-টা একেবারেই পারত না। আমি ওকে প্রোডাকশন কন্ট্রোলার-এর কাজটা দিলাম। ওকে দেখে যে কত অ্যাক্টর ফিদা হয়ে আমার কাছে কাজের জন্য আসে জানিস না। তাছাড়া আমার স্পেশাল কাজে তো লাগেই।’ রাইমার উপর কেমন যেন নেশা চড়ে বসল।
মনে মনে কুঁকড়ে গেলাম। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করলাম না। কিছু বলতে গেলে যদি ও রেগে যায়। খানিক চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করল রাইমা, ‘জানিস কেয়া, আমার সিরিয়ালে প্রথম যে-ভদ্রলোক টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তিনি তো আমাকে দেখে একেবারে পাগল। ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী রঞ্জনা আবার জয়কে দেখে নাছোড়। ওকে ওর চাই-ই। কতবার তো রঞ্জনা আর আমি জয়কে একসাথে শেয়ার করেছি।’
হাঁ হয়ে গেলাম আমি। আমাকে দেখে বলল, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভালোভাবে বাঁচতে গেলে, নিজেকে ভালো রাখতে গেলে এগুলো দরকার। জাস্ট ফর রিল্যাক্সেশন। অবশ্য আমিও ওর জন্য কম করি না। কাজের দরুন প্রতি মাসে চল্লিশ হাজার আর আমার মাইন্ড ফ্রেশ রাখার জন্য প্রতিবার দশ-কুড়ি হাজার দিই। সঙ্গে ওর বউয়ের জন্য কাপড়চোপড়। এছাড়া যখন যা সঙ্গে থাকে।’ এসব শুনে সামনের মানুষটা যে ওর সম্পর্কে ঠিক কেমন ধারণা করতে পারে, সেদিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রূক্ষেপ নেই রাইমার।
ওর সত্যিটা মানতে কষ্ট হলেও, নিজেকে সংযত করে বললাম, ‘দ্যাখ, প্রত্যেকটা মানুষই নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। তুই তোর পৃথিবীতে খুশি, আমি আমার ফ্যামিলি নিয়ে। যাক এসব কথা এখন থাক। তুই এনজয় কর, আমি চললাম।’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
আমাকে উঠতে দেখেই বলল, ‘হ্যাভ এ চেঞ্জ ডিয়ার। একবার ওকে দেখলে তোর আর ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করবে না। আমি তো তোকে অজিতকে ছাড়তে বলছি না। তোদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কও থাকল আর এক্সট্রা… মাঝে মাঝে তো এটা হতেই পারে নাকি।’ এক পেগ শেষ হওয়ার পর আর এক পেগ তুলে নিল রাইমা। ঠিক তখনই দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে এল জয়। দরজার দিকে পিছন করে বসেছিলাম বলে মুখটা ঠিক দেখতে পেলাম না।
‘কাম ডার্লিং, কাম।’ রাইমা ওর হাত ধরে নিয়ে একেবারে বিছানায় গিয়ে গা-ঘেঁষে বসল। অবশ্য গা-ঘেঁষে বললে বোধহয় ভুল হয়, কারণ রাইমার অর্ধেক শরীরটাই তখন জয়ের কোলে।
‘আমার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই… কেয়া।’ মুখ তুলে আগন্তুককে দেখেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ভুল দেখছি না তো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জয়েরও একই অবস্থা। কোনও কিছু বোঝার আগেই রাইমা জয়কে জড়িয়ে ধরে জয়ের শার্টের বাটন খুলতে শুরু করল। আর নিজেও প্রায় অর্ধনগ্ন হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর।
‘উঃ ডিয়ার জয়… জয়… জয়…’
বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না আমার। কৌশিক-ই তাহলে জয়। নাম ভাঁড়িয়ে কাজ করছে এখানে। তা হলে এটাই ওর প্রপার্টি ডিলিং-এর বিজনেস! মাথা ঘুরছিল। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বারবার সোমার সেই হাসি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। কৌশিক খুব ভালোবাসে। নতুন নতুন নাইটি, শাড়ি, দামি গিফট এনে দেয়। এই তার ভালোবাসার নমুনা! ওদের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কোনওরকমে আসছি বলে হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মনে হল জয় নিজেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ ছটফট করছে।
‘উঃ ছটফট করছ কেন। মুড খারাপ কোরো না আমার।’ রাইমার এই অস্ফুট স্বর সারা রাস্তা কানে বাজতে থাকল আমার। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। চেনামুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই রক্তমাংসের কদর্যতা সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। ভাবলাম বাড়ি ফিরে স্নান করব। মাথাটা ঠান্ডা হবে।
বাড়ি ফেরার পথেই মোড়ের দোকানে রমলার সঙ্গে দেখা। রমলা ও-বাড়ির কাজের লোক। থাকা-খাওয়া সবই ওখানে। ও-ই বোধহয় আমার ফেরার খবরটা দিয়েছে। জিরোব বলে সবে ফ্যানটা চালিয়েছি, অমনি দরজায় ধাক্বা। খুলে দেখি ‘সোমা’। ওকে দেখেই হঠাৎ করে কেমন যেন শিউরে উঠলাম।
‘কীরে ভূত দেখলি নাকি। এমন চমকে উঠলি কেন?’
‘না না এমনি। বস। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।’
ফিরে এসে দেখলাম হাতের আংটিটা নিয়েই নাড়াচাড়া করছে। দেখেও না দেখার ভান করলাম। ঘরে ঢোকামাত্রই জিজ্ঞাসা করল, ‘যে-কাজে গিয়েছিলি সব ঠিক হয়ে গেছে?’ উত্তরের আশা না করে হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ‘তখন তো ঠিক করে দেখলিই না। এই দ্যাখ ডায়মন্ড রিং এটা।’
প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েই প্রশ্ন করলাম, ‘কৌশিক কোথায় রে? ফেরেনি এখনও?’
‘না সকালে বলেই বেরিয়েছে কী যেন বড়ো একটা ডিল আছে, দুদিন ফিরতে পারবে না। কেন রে কিছু হয়েছে নাকি?’
‘নাঃ। এমনিই, কী আর হবে?’
একবার মনে হল ওকে সবকিছু জানিয়ে দিই, ওরও জানাটা প্রয়োজন। আবার পরক্ষণেই ওর মুখের হাসিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। চুপ হয়ে গেলাম।
ওকে দেখে ভীষণ মায়া হল। বেচারি। একজন মধ্যবিত্ত মহিলার পক্ষে পাঁচতারা হোটেলের অন্দরমহলে কী হচ্ছে, সেটাও তো জানা সম্ভব নয়। আর বড়ো বড়ো লোকেদের মাইন্ড রিল্যাক্সেশন – এসব তো ওর ভাবনাচিন্তার উর্দ্ধে।
টুকটাক শপিং ছাড়া মেয়েটা আর যায়ই বা কোথায়, যে স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতার কথা জানতে পারবে। স্বামীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের উপরই দাঁড়িয়ে আজ ও কত সুখী। সেই খুশিতে বাধ সাধতে ইচ্ছে হল না। কাজেই আমিও ওকে খুশি করতে আংটিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলাম। কখন যে হিরের দ্যুতি ঠিকরে এসে চোখের কোণায় জল জমিয়ে দিয়েছে বুঝিনি।