পৃথিবী বিখ্যাত এক অভিনেতার প্রতিটি ছবি বাবদ উপার্জন ছিল প্রায় ৭৩ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁর স্থাবর, অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি, তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানদের হাতে তিনি পুরোপুরি সঁপে দিতে চান না। সাক্ষাৎকারে বলা কথার স্বপক্ষে তিনি জানিয়েছিলেন, এই বিপুল অর্থরাশি উপার্জনের কষ্ট সন্তানরা বুঝবে না, যদি তা উত্তরাধিকার সূত্রে অনায়াসে তাদের হস্তগত হয়। তাই তিনি তাঁর আংশিক সম্পত্তি দান করে যেতে চান কোনও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে। কয়েক দশক আগে আরও এক বিখ্যাত ব্যক্তিও তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি এক ফাউন্ডেশন-এর তহবিলে দান করে দেন।

আসলে ব্যক্তি বিশেষে চিন্তা-ভাবনা এবং সিদ্ধান্ত বদলে যায়। তাই, পিতা-মাতার সম্পত্তি সবসময় যে সন্তানেরই প্রাপ্য হবে, এমনটা না-ও ঘটতে পারে। সমাজ-সংসারের যদিও সেটাই প্রত্যাশা থাকে। অনেক মা-বাবা মনে করেন, সন্তান জন্মানোর পর কায়-ক্লেশহীন জীবন অতিবাহিত করে অভিভাবকদের কঠোর পরিশ্রম এবং সচ্ছলতার কারণে। এই জেনারেশনের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী তাই ভোগবিলাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন অনেক অভিভাবক। তাদের যুক্তি, সন্তানের হাতে অঢেল অর্থ তুলে দিলে তারা বিলাসিতার জীবনযাপন করবে। তাই, সন্তানের হাতে অর্থ-সম্পত্তি তুলে না দিয়ে, বদলে তাকে বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং পরিশ্রমের পাঠ দিতে চান অনেকে। এর ফলে সন্তান নাকি যোগ্য হবে এবং মা-বাবার উপার্জিত অর্থের মূল্য বুঝবে।

আর এই ধ্যান-ধারণার ফলে, আজকাল অনেকে তাদের সম্পত্তি দান করে যাচ্ছেন কোনও প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, সেই প্রতিষ্ঠানও কি মূল্য দিচ্ছে আপনার পরিশ্রম করে উপার্জন করা অর্থের? তারা আদপে এই বিত্তের কতটা অধিকারী?

সামাজিক কাজের জন্য সচ্ছল কোনও ব্যক্তি হয়তো তার অর্থ দান করলেন কোনও ধর্মীয় বা সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে। আখেরে দেখা যায় সেই অর্থের প্রতি কোনও মমত্ববোধ থাকে না প্রতিষ্ঠানগুলির এবং আর্তের সেবায় না লেগে সে টাকা নয়ছয় হয়। কিছুদিন আগেই এক বিখ্যাত কোম্পানির মালিক তার প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিলেন, কারণ তাঁর একমাত্র কন্যার এই ব্যাবসার প্রতি কোনও টান নেই। সে শিল্পকলায় আগ্রহী। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তাঁর বৃদ্ধাবস্থায় প্রতিষ্ঠান চালাতে অপারগ। ফলত, এই কোম্পানি এখন ক্রয় করেছেন তাঁরই চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।

এইরকমই ঘটনা ঘটে নানা যৌথ পরিবারের ব্যাবসার ক্ষেত্রেও। পরিবারের মধ্যে বিবাদের জেরে ব্যাবসা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায় বা বছরের পর বছর বাদানুবাদের মামলা চলে। আবার কেউ যদি মনে করেন তাঁর সারাজীবনের অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চার্চ, মন্দির বা মাদ্রাসায় দিয়ে যাবেন, তাহলেও কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, এই অর্থ সৎ-কাজে সদ্ব্যবহার হবে।

তাই সন্তানদের কাছে পারস্পরিক ভাবে বিত্ত হস্তান্তরিত হওয়া ছাড়া বিকল্প প্রায় নেই বললেই চলে। তাই, আপনার কষ্টার্জিত অর্থ কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেওয়া অর্থহীন। মাঝে সরকার এই দাতব্য বিত্তের উপর এস্টেট ডিউটি লাগু করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থা পৃথিবীর কোনও দেশেই কার্যকর হয়নি। ফলে এখন আইনি জটিলতায় না গিয়ে, সন্তানরাই উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা-মার বিত্তের অধিকারী হবে, ভারতীয় আইনে এই ব্যবস্থাই কায়েম রয়েছে।

উত্তরাধিকারীদের জন্য গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্ত্রী যদি তাঁর জীবিতাবস্থায় অর্থ, সম্পত্তির প্রয়োজনীয় আইনি কাগজপত্র তৈরি না করে রাখেন, তাহলে সমস্যা জট পাকাবেই। আর যদি সম্পত্তি এবং অর্থের একাধিক দাবিদার থাকে, তাহলে সমস্যা ঝগড়া-মারামারি থেকে খুনোখুনি পর্যন্ত যে গড়াতে পারে, এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে অসংখ্য। প্রায় প্রতিদিনই এরকম ঘটনার খবর আমরা পাই টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেল কিংবা খবরের কাগজের মাধ্যমে। আর যদি সমস্যা মারামারি কিংবা খুনোখুনি পর্যন্ত না-ও গড়ায়, তাহলেও আর্থিক এবং মানসিক ক্ষতির শিকার হতে পারেন উত্তরাধিকারীরা।

এ প্রসঙ্গে দুটো ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। জীবিতাবস্থায় কাউকে কানাকড়িও দেবেন না, এমনই জেদ ধরেছিলেন এক ব্যক্তি। তাই তাঁর উত্তরাধিকারীরাও ওই বৃদ্ধের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে চাননি। একসময় ওই বৃদ্ধ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া সত্ত্বেও, আত্মীয়স্বজনরা কেউ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি। শেষ পর্যন্ত পাড়ার ছেলেরা নিয়ে গিয়ে ওই বৃদ্ধের ইচ্ছেমতো বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে। কিন্তু বৃদ্ধ আর বেঁচে ফেরেননি এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে অনেক টাকার বিল করে মারা যান। এরপর আত্মীয়স্বজনরা কেউই প্রথমে হাসপাতালের বিল মিটিয়ে মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করেননি। পরে ওই মৃত বৃদ্ধের স্ত্রী আশ্বাস দেন যে, উত্তরাধিকীরা যাতে বিষয়সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হন, তার জন্য তিনি সবরকম আইনি সহায়তা করবেন। এরপরই বৃদ্ধের মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে শ্মশানে নিয়ে যান উত্তরাধিকারীরা।

দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও ভয়াবহ। এক ব্যক্তির ব্যাংক-এ অনেক টাকা ছিল। কিন্তু কোনও নমিনি কিংবা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট না করেই হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। আত্মীয়স্বজনরা প্রশাসনিক সাহায্য নিয়ে ওই ব্যক্তির কোনও খোঁজ পাননি। সময় এগিয়ে চলে। কেটে যায় পাঁচটা বছর। এখনও অসহায় উত্তরাধিকারীরা। এখন প্রশ্ন, যদি এরকম ঘটনা ঘটে, তাহলে কি চুপ করে বসে থাকতে হবে, নাকি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব? কী করতে হবে এর জন্য?

এর উত্তরে জানাই, সমস্যার সমাধানের পথ নিশ্চয়ই আছে। কারণ, ওই যে কথায় বলে– যে সমস্যার সমাধান নেই, সেটা কোনও সমস্যাই নয়। অতএব, সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এবং সাহায্য নিতে হবে। আর এই বিশেষজ্ঞ হলেন আইনজীবী। সমস্যা যতই গভীর হোক না কেন, আইনের পথ খোলা আছেই। তবে সতর্ক থাকলে সহজে সমস্যার সমাধান করা যাবে। এই সতর্কতার মধ্যে রয়েছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা। এছাড়া গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্ত্রী, অর্থাৎ যার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আপনি বিষয়সম্পত্তির অধিকারী হবেন, তাঁর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলা, নমিনি হিসাবে নিজের নাম নথিভুক্তিকরণের অনুরোধ, প্রত্যেকটি আইনি কাগজপত্র কোথায় তিনি রাখছেন তা জেনে রাখা ইত্যাদি।

আসলে এসব সতর্কতা সমস্যা কমানোর অন্যতম পথ। এছাড়া আর যা করা প্রয়োজন তা হল, গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্ত্রী যদি পেনশনার হন, তাহলে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা ফেলে রাখবেন না। প্রতি মাসের পেনশনের পুরো টাকাটাই তুলে রাখবেন। নয়তো, পেনশনারের মৃত্যুর পর তাঁর অ্যাকাউন্টে জমানো টাকা তুলতে সমস্যা হবে। আর এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্য একটি পথও খোলা আছে। পেনশনারের সঙ্গে যদি জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে রাখেন তাঁর স্ত্রী, তাহলে পেনশনারের মৃত্যুর পর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা খুব সহজেই জমা পড়ে যাবে ওই জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট-এ। এর জন্য অবশ্য স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটের ফোটোকপি এবং নাম পরিবর্তনের জন্য একটি আবেদনপত্র জমা দিতে হবে নির্দিষ্ট ব্যাংকে।

যিনি সম্পত্তি এবং টাকাপয়সার মালিক, তাঁর যদি কোথাও ধার-বাকি থাকে কিংবা আয়কর জমা না দেওয়া থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডেথ সার্টিফিকেটের ফোটোকপি জমা দিন নির্দিষ্ট দফতরে। এতে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বকেয়া আয়কর এবং ঋণের সুদ বহন করতে হবে, এর বেশি নয়। তবে শুধু আয়কর এবং ঋণ মকুবের ক্ষেত্রেই নয়, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃত ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেট কর্পোরেশনে জমা দিয়ে সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তনের জন্য (নাম পরিবর্তন) আবেদন করুন। তবে এক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীর প্রমাণপত্রও জমা দিতে হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...