ইশ্ এই শীতকালে মেঘলা আকাশ দেখলেই ভীষণ মন খারাপ লাগে বলো। রঞ্জনা বারান্দার দরজাটা দিতে দিতে বলে।
প্রদীপ্ত লেপের মধ্যে নিজেকে সঁপে দেয়– ঠিক বলেছ। এরকম দিনে কেমন যেন পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে।
– তোমার পুরোনোদিনের কথা মানেই তো রেখা আসবে। ঠোঁট টিপে হাসে রঞ্জনা।
– বেশ রেখার কথা আর বলব না। তুমিই তো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করো, অভিমানী স্বরে বলে প্রদীপ্ত।
– খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আবার কী! রেখার কথা যা বলো তাই শুনি। মনে কোনও প্রশ্ন জাগলে জিজ্ঞাসা করি। ব্যস। মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্র কী আর সাধে বলেছিলেন, বাল্যপ্রেমে অভিশাপ আছে, মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে চপলসুরে বলে রঞ্জনা।
প্রদীপ্ত লাজুক হাসে– যাঃ ওই বয়সে প্রেম কী তাই জানতাম না। আলগাটানে রঞ্জনাকে বিছানার মধ্যে নিয়ে এসে দু’হাতের তালুতে রঞ্জনার মুখটা ধরে বলল–প্রেম তো খুঁজে পেলাম অনেক পরে। রঞ্জনার দু’চোখে চুমু খেয়ে বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল– এখানেই আমার প্রেমের আশ্রয় বুঝেছ।
রঞ্জনা প্রদীপ্তর চুলগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘাড় নাড়ল। তারপর আদুরে গলায় বলে– অনেকদিন রেখার কথা শুনিনি।
প্রদীপ্ত শুয়ে রঞ্জনার আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। রেখা এক অদ্ভুত ধরনের মেয়ে ছিল, জানো তো। ক্লাসে সবসময় আমার পাশে বসত। ওকে কেউ যদি মারত আমাকে নালিশ করত। কারও কাছে বকুনি খেলেও আমাকেই বলত। একটু নাকি সুরে কথা বলত। বলার সময় ঠোঁট দুটো ফুলে যেত। চোখ ছলছল করত। অথচ আমরা তো একই বয়সি ছিলাম। কিন্তু সেই নার্সারি ক্লাস থেকেই আমি কী করে যেন রেখাকে আগলে রাখতাম। এমনকী মাঝেমধ্যে ধমক-ধামকও দিতাম। কিন্তু কক্ষনো মারতাম না। ওকে দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগত।
– তোমার বন্ধুরা কিছু বলত না?
– অত ছোটো বয়স। এখনকার বাচ্চাদের মতো তো ম্যাচিওরড ছিলাম না। তবে মনে আছে স্কুলে কোনও অন্যায় যদি করতাম তাহলে পানিশমেন্ট হিসেবে টিচাররা আমাদের দুজনকে আলাদা বসিয়ে দিতেন। একটা মজার ঘটনা শোনো। উৎসাহে প্রদীপ্ত বালিশটা কোলে নিয়ে উঠে বসল– ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় রেখা অঙ্কে ফেল করল। কিন্তু আমি একশোতে একশো। রেখা তো হাপুসনয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলছে– এই খাতা দেখালেই বাবা আমাকে প্রচণ্ড বকবে। আর মা তো খুন্তিপেটা করে সারা গায়ে দাগ করে দেবে। তুই আমাকে বাঁচা, তা রেখার কান্না দেখে আমারও চোখে জল চলে এল।
রঞ্জনা হেসে ফেলে– শেষমেশ রেখাকে মারের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছিলে কি?
– সে আর এক কাণ্ড। পরে বলব। আসলে রেখাকে নিয়ে যে কত ঘটনা আছে ভাবতে পারবে না।
– সত্যি, তোমাদের মধ্যে কেমিস্ট্রিটা বেশ ছিল। আচ্ছা তোমার কী মনে হয়, রেখারও তোমার মতো করে এত ডিটেলে সব কথা মনে আছে?
প্রদীপ্তর ঘাড় নাড়া রঞ্জনা আবছা আলোতেও বুঝতে পারল।
প্রত্যয়ী স্বরে প্রদীপ্ত বলে– পৃথিবীর যে-প্রান্তেই থাকুক, রেখা কখনওই আমায় ভুলতে পারবে না।
চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে প্রদীপ্তর বুকের ভেতর থেকে– ক্লাস ফোরের অ্যানুয়াল পরীক্ষার পরপরই রেখার বাবার ট্রান্সফার অর্ডার এল। ওরা আগরপাড়া ছেড়ে গৌহাটিতে চলে যাবে। খবরটা শোনামাত্র আমি আর রেখা চিলেকুঠুরির ঘরে বসে কী কান্নাই না কেঁদেছিলাম। চলে যাবার দিনও আমরা একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, কেউ কাউকে ভুলব না।
ছোট্ট হাই তোলে রঞ্জনা – তারপর?
– তারপর আবার কি? তখন তো আর ঘরে ঘরে টেলিফোন ছিল না। তাই আমরা একে অপরকে চিঠি লিখতাম। তুমি আগরপাড়ার বাড়িতে গেলে দেখো। চিলেকোঠার ঘরে একটা ট্রাংকে রেখার চিঠিগুলো এখনও রাখা আছে। গোটা গোটা অক্ষরে রেখা খুব সুন্দর চিঠি লিখত। রেখা শেষ যে-চিঠিটা দিয়েছিল, তাতে লিখেছিল, ওরা গৌহাটি থেকে ট্রান্সফার হয়ে মিরাট চলে যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে নতুন ঠিকানা জানিয়ে চিঠি দেবে। কিন্তু তারপর আর কোনও চিঠি পাইনি। হয়তো ডাক গোলযোগে পাইনি।
রঞ্জনা প্রদীপ্তর কপালে নেমে আসা অবাধ্য চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দেয়–ফেসবুকে পাত্তা লাগাতে পারো তো। না হলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দাও, ‘রেখা তোমাকে আমি খুঁজছি’। বলে খিলখিল করে হেসে উঠে রঞ্জনা আবদারের গলায় বলল– এই সত্যি বলছি। বিজ্ঞাপনের খসড়াটা করে দিও। আমি পাঠিয়ে দেব। দারুণ মজা হবে। হারিয়ে যাওয়া কাউকে খুঁজে পেলে কত ভালো লাগে জানো?
প্রদীপ্ত রঞ্জনার গালে আলতো টোকা মেরে বলে– রেখাকে তো হারাইনি।
রঞ্জনা বুঝতে পারে না প্রদীপ্তর কথায় ওর বুকে সূক্ষ্ম ঈর্ষার কাঁটা খোঁচা দিল কিনা।
– কত বছর আগের কথা ভাবো। মনে মনে সামান্য হিসেব করে নিয়ে প্রদীপ্ত বলে– তা প্রায় কুড়ি বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখনও রেখার সেই রোগাপাতলা চেহারা, মাঝেমধ্যে কাঁধ থেকে টেপফ্রক পরে যাওয়া, দুপাশে দুটো বেনুণি, নাকি সুরে কথা, সবকিছু আমার স্পষ্ট মনে আছে। এখনও কারও নাম রেখা শুনলেই আমি চমকে তাকাই। মেলাবার চেষ্টা করি।
রঞ্জনা বুকে বুঝি আর একবার পিঁপড়ের কামড় টের পেল।
কিন্তু রঞ্জনা জানে, প্রদীপ্ত ভীষণ সহজ সাদা-সিধে মানুষ। এজন্যই রঞ্জনার প্রদীপ্তকে ভালো লেগেছিল। কাজের সূত্রেই প্রদীপ্ত রঞ্জনাদের অফিসে আসত। আলাপ-পরিচয়পর্ব মিটিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। প্রদীপ্ত ওর জীবনে আসা মেয়েদের কথা পরিহাসচ্ছলে প্রায়ই বলে। বিশেষ করে রেখার কথা তো কত সহজেই বলে।
অথচ ওদের বিবাহিত জীবনের এক বছরের মধ্যেও রঞ্জনা সিদ্ধার্থর কথা প্রদীপ্তকে বলে উঠতে পারেনি। প্রদীপ্তর সঙ্গে ওর পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিতটা যাতে নড়ে না যায় সে বিষয়ে রঞ্জনা ভীষণ সতর্ক থাকে।
তবে এটাও ঠিক, রঞ্জনা মনে করে প্রতিটি মানুষেরই একটা নিজস্ব জগৎ থাকে, থাকে কিছু স্পর্শকাতর বিষয়। যা-সবসময় মনের মধ্যে সযত্নে রেখে দিতে হয়।
প্রদীপ্ত রঞ্জনার হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলল– আচ্ছা তোমার কথা কিছু বলো না কেন রঞ্জনা?
রঞ্জনা হেসে ফেলে– তোমার রেখার মতো আমার জীবনে দাগ কাটার মতো কেউ এলে তো বলতাম। এখন ঘুমোও তো। অনেক রাত হল।
– আরে কাল সানডে। এই শীতের দিনে ন’টার আগে বিছানা থেকে নড়ব না। সপ্তাহের ছ’টা দিনই তো শুধু চরকিপাকের মতো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরি। শনিবার রাতটা অন্তত বেহিসেবি হয়ে খরচ করতে দাও।
– তাহলে রেখার কথা বলো, শুনি।
– উহুঁ… আবার অন্যদিন বলব। তোমার কথা কিছু বলো না রঞ্জনা? প্রেম না থাক, ভালোলাগা বা দুর্বলতা ছিল এমন কারও কথা তো বলো।
কথাটায় রঞ্জনা প্রদীপ্তর মুখটা দেখার চেষ্টা করল। প্রদীপ্ত নিছকই কৌতূহলবশে জিজ্ঞাসা করছে কিনা তাও বোঝার চেষ্টা করল।
আসলে রাত্রির নির্জনতাকে রঞ্জনা ভয় পায়। মানুষের যে একটা সত্তা আছে, রাতের কাছে সে অসহায়। এক এক সময় অত্যন্ত দুর্বল মুহূর্তে তা আত্মসমর্পণ করতে চায়। সেজন্য রঞ্জনা সন্তর্পণে নিজেকে গুটিয়ে রাখে।
মাঝে মাঝেই রঞ্জনা একান্ত অবসরে ভাবে, কে জানে সিদ্ধার্থদা ওর কথা মনে রেখেছে কিনা।
কলেজে সিদ্ধার্থদার সঙ্গে যখন আলাপ হয় তখন রঞ্জনার সেকেন্ড ইয়ার। সিদ্ধার্থদা ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। শান্ত, স্থিতধী চেহারা। অসাধারণ বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয়। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে সিদ্ধার্থদাকে নিয়ে মুগ্ধতাবোধ রঞ্জনার নজরে পড়ত। আর এই মুগ্ধতা থেকেই সিদ্ধার্থদার প্রতি একটা চোরা টান রঞ্জনা অনুভব করত।
তাই যেখানেই সিদ্ধার্থদা ইউনিয়নের কাজে রঞ্জনাকে যেতে বলত, রঞ্জনা খুশি মনে যেত। অথচ রাজনীতির কূটকাচালি কোনওদিনই রঞ্জনার ভালো লাগত না। তখনই রঞ্জনা বুঝেছিল যে, কাউকে ভালোবাসলে তার সবকিছুই কেমন যেন ভালো লেগে যায়। তাই পড়াশোনায় সিরিয়াস হয়েও সিদ্ধার্থদার কথায় ক্লাস বাংক করতেও রঞ্জনা আপত্তি করত না।
কিছুদিনের মধ্যেই রঞ্জনা বুঝতে পেরেছিল যে, সিদ্ধার্থদা ওকে একটু অন্য নজরে দেখে। সেজন্য স্বপ্না, সুশ্রীমা, মৌসুমী, কবিতা ওকে ঈর্ষার নজরে দেখত, সেটাও রঞ্জনা টের পেয়ে বেশ গর্বিত হতো।
একবার জুলাই মাসে ওরা কলেজ থেকে বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে পার্টিসম্মেলনে ডায়মন্ডহারবার গিয়েছিল। সিদ্ধার্থদা ছাড়া বিধানদা, মৃণালদা, শিলাদিত্যদারাও ছিল। তবে প্রধান উদ্যোক্তা ছিল সিদ্ধার্থদা। সারাদিন পার্টির নেতাদের বক্তৃতা শোনার থেকে নিজেদের মধ্যেই আড্ডা দিয়েছিল বেশি। ফেরার সময় যে-যার সুবিধেমতো দল করে বাড়ি ফিরেছিল।
রঞ্জনাকে শুধু একফাঁকে এসে সিদ্ধার্থদা বলে গিয়েছিল –তুমি আমার সঙ্গেই ফিরবে।
রঞ্জনাও মনে মনে এটাই চাইছিল। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হওয়ার মুখে রঞ্জনা অস্থির হয়ে ওঠে। আসলে অনেক রাতে ফিরলে হোস্টেল সুপার ঝামেলা করেন। যদিও ওর রুমমেট কপোতাক্ষীকে বলা আছে, কোনওভাবে ম্যানেজ করে নেবে। তবুও অস্বস্তির চোরাস্রোত রঞ্জনাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না।
তাড়া দিয়ে দিয়ে অবশেষে সাড়ে সাতটা নাগাদ সিদ্ধার্থদাকে মিটিং থেকে বার করতে পারল। কিন্তু স্টেশনে আসার পথে রিকশাওয়ালাই জানাল, ওভারহেডের তার ছিঁড়ে বিকেল থেকেই সব ট্রেন বন্ধ।
সিদ্ধার্থদা উদ্বিগ্নস্বরে জিজ্ঞাসা করল– কলকাতা যাবার বাস কোথা থেকে ছাড়ে?
সিদ্ধার্থদার অজ্ঞতায় তাচ্ছিল্যের সুরে রিকশাওয়ালা বলে –শেষ বাস সাড়ে ছ’টায় বেরিয়ে গেছে।
–তাহলে উপায়? রঞ্জনার ছিটকে আসা উৎকন্ঠিত স্বরের জবাবে রিকশাওয়ালা বলে –চলুন আমার সন্ধানে ভালো থাকার জায়গা আছে। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই। ট্রেন কাল কখন চালু হবে ঠিক নেই। বরং কাল সকাল ছ’টা পনেরোর বাস ধরে ধর্মতলা পৌঁছে যেতে পারবেন।
রঞ্জনা সে সময় কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন অসাড় লাগছিল। তাই সিদ্ধার্থদার সঙ্গে রিকশাওয়ালার আর কী কী কথা হয়েছিল তা রঞ্জনার কানে ঢোকেনি।
শুধু মনে হচ্ছিল, ওকে ফোন না করে মা যদি হোস্টেল সুপারকে ফোন করে, তাহলে? এরকম দু-একবার করেছে মা। পরিণতিটা ভেবেই রঞ্জনার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল।
সিদ্ধার্থদা সেটা বুঝে রঞ্জনার পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলেছিল –প্লিজ রঞ্জনা, বি স্টেডি।
রঞ্জনার মনে আছে, একটা সাধারণমানের দোতলা হোটেলের সামনে ওরা নেমেছিল। রিসেপশনের এক আধবুড়ো ভদ্রলোক ওদের আপাদমস্তক দেখলেন। কিন্তু কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ না করে সিদ্ধার্থদার সামনে রেজিস্টার খুলে দিয়ে বেয়ারাকে চাবিটা দিয়ে দিলেন।
ঘরটা ছিল সাগরফেসিং। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রঞ্জনা মেঘে ঢাকা আকাশের মধ্যে তারাদের খুঁজছিল। অন্ধকারে জলের মধ্যে টিমটিম করে জ্বলা মাছধরার নৌকাগুলোকে দেখে রহস্যময় লাগছিল।
রঞ্জনা ঘরের মধ্যে না তাকিয়েও সিদ্ধার্থদার উপস্থিতি টের পাচ্ছিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল –যাও মুখে চোখে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও।
রঞ্জনার মনের মধ্যে একটা অচেনা ভয় সর্পিল গতিতে জড়িয়ে ধরে ক্রমশ অসাড় করে দিচ্ছিল। তবুও বাথরুম যাওয়াটা জরুরি বলেই বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিল বাথরুমে। তারপর নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বেরোল। দেখল সিদ্ধার্থদা জিন্সের প্যান্টটা হ্যাঙারে টাঙিয়ে রেখেছে। আর একটা তোয়ালে জড়িয়ে বসে আছে। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি।
একনজরে দেখেই রঞ্জনা অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিল। ব্যাগ থেকে চিরুনি বার করে চুলটা আঁচড়াতে থাকল। দেয়াল আয়নার মধ্যে দিয়েই সিদ্ধার্থদার মুগ্ধ দৃষ্টি ও টের পেল। কেমন যেন শীত শীত করছে। সেটা কি ভয়ে, না সাগরের উত্তাল হাওয়ায় তা ঠিক বুঝতে পারছে না।
এর আগে সিদ্ধার্থদার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসেছে। এমনকী পর্দাঢাকা কেবিনেও দু-তিনবার বসেছে। ইউনিয়ন রুমের মধ্যে একান্তে নানা সময় কাটিয়েছে। নানা সুযোগ পেয়েও সিদ্ধার্থদা কোনওদিন রঞ্জনার হাত ধরা তো দূরের কথা, কোনওরকম ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও বলেনি। তাই রঞ্জনা ঠিক বুঝতে পারছে না, একঘরে রাত কাটানোর পরিণতিটা কী হবে।
ইতিমধ্যে কপোতাক্ষী ফোন করলে রঞ্জনা গলাটা যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে দিল –ট্রেন বন্ধ। তাই এক দূর সম্পর্কের মাসির বাড়িতে থেকে যাচ্ছি রে। সুপারকে একটু ম্যানেজ করিস প্লিজ। ভাগ্য ভালো, আজ বাড়িতে মামা-মাইমা এসেছেন বলে মা খুব ব্যস্ত। তাই প্রথাগত দু-একটা কথা বলেই ফোনটা রেখে দিয়েছে।
রঞ্জনা স্মৃতির মাউস ক্লিক করে মনের মনিটারে ভেসে আসা সেদিনের ছবিগুলো দেখছিল।
রঞ্জনার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, সিদ্ধার্থদা এর পরের পার্টি সম্মেলন কোথায় হবে এই নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল। তারপরই অত্যন্ত অনায়াস ভঙ্গীতে রঞ্জনার ডানহাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে আলতো চাপ দিয়ে বলল –রঞ্জনা এবারের কলেজ ইলেকশনে আমি জিএস হয়ে দাঁড়াচ্ছি। তুমি নিশ্চয়ই আমার পাশে থাকবে।
আকস্মিক হাত ধরার ভালোলাগায় অথবা সিদ্ধার্থদার কন্ঠস্বরের আকুলতায় রঞ্জনা তখন রীতিমতো সম্মোহিত। তাই মুখে কোনও কথা না বলে শুধু ঘাড়টা হেলিয়ে সম্মতি দিয়েছিল।
তারপর সিদ্ধার্থদা ওর খুব কাছে এসে দু’হাতের তালুর মধ্যে রঞ্জনার মুখটা ধরেছিল। সিদ্ধার্থদার দু’চোখের দৃষ্টিতে কি মায়া ছিল কে জানে, তবে রঞ্জনা সিদ্ধার্থর ইচ্ছায় নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে দ্বিধাবোধ করেনি।
সাগরের হু-হু বাতাস খোলা জানালার পর্দা উড়িয়ে ঘরের মধ্যে পাক খাচ্ছিল।
সারারাত জেগে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কখন যে ওরা সুখের আবেশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল কেউই খেয়াল করেনি। দরজা ধাক্বার আওয়াজে ঘুম ভেঙে দেখে সকাল সাড়ে আটটা। ব্যস তারপরই হুড়মুড় করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল দুজনে।
প্রায় ন’বছর হতে চলল, তবুও রঞ্জনা সেই রাতের প্রতিটা মুহূর্তের কথা একটুও মুছতে পারেনি স্মৃতি থেকে।
আশ্চর্যজনক ভাবে ডায়মন্ডহারবার থেকে ফিরে আসার পর থেকেই সিদ্ধার্থদা ওকে দেখলেই এড়িয়ে যেত।
প্রথম প্রথম রঞ্জনা ব্যাপারটা বুঝতে পারত না। ভাবত ফাইনাল ইয়ার, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাছাড়া সামনেঞ্জইউনিয়নের ইলেকশন, সেজন্যই সারাদিন মিটিং মিছিলে ব্যস্ত। তাই হয়তো আগের মতো রঞ্জনাকে সময় দিতে পারছে না। পরে সত্যিটা বুঝতে পেরে রঞ্জনাও দুরন্ত অভিমানে সরে গিয়েছিল।
পরে ওর সামনে দিয়েই সিদ্ধার্থদা মিমিকে নিয়ে ঘুরত। মিমি সরে যাবার পর শ্রাবণী।
রঞ্জনা তখন বুঝতে পেরেছিল ওর ভালোবাসার মূল্য দেয়নি সিদ্ধার্থদা। ওর বিশ্বাসকে চরম অমর্যাদা করেছে। নিছক শরীরী চাহিদা মেটাতে ওকে ব্যবহার করেছে।
ওর মুখ আর মুখোশের স্বরূপ জানার পর রঞ্জনা দীর্ঘদিন অবসাদগ্রস্ত ছিল। মাঝে মাঝে বঞ্চনার শিকার হয়েছে বলে রাগে ফুঁসত। কখনওবা সিদ্ধার্থদাকে দায়ী করে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবত।
এত বছর পরেও অপমানের সেই জ্বালা রঞ্জনার মধ্যে চোরাস্রোতের মতো বয়ে চলেছে। প্রদীপ্তর মতো যদি মন খুলে বলতে পারত, তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত।
প্রাণপণে রঞ্জনা সেই অভিশপ্ত রাতটার কথা ভুলে যেতে চায়। পারে না। মাঝে মধ্যেই শুশুকের মতো ওর মনের গভীরে ঘটনাটা ভেসে ওঠে।
এখন তো সিদ্ধার্থদা পার্টির বড়ো নেতা হয়ে গেছে। খবরের কাগজ বা টিভিতে প্রায়ই দেখা যায়। দেখলেই যেন রঞ্জনা ফ্ল্যাশব্যাকে সিনেমার কাটা রিলের মতো ছোটো ছোটো দৃশ্যগুলো দেখতে পায়।
– এই কী হল তোমার? একেবারে চুপ মেরে গেলে যে! এত কথা বলে যাচ্ছি অথচ কোনও সাড়াশব্দ করছ না যে? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
প্রদীপ্তর ঝাঁকুনিতে রঞ্জনার ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। সত্যি তো এতক্ষণ ধরে প্রদীপ্ত কত কথা বলে যাচ্ছিল, অথচ ওর কানে কিছুই ঢোকেনি। সামাল দিতে বলে –যাঃ, ঘুমাব কেন? তোমার রেখার কথাই তো মন দিয়ে শুনছি। রেখা সম্বন্ধে এত কথা তো আগে কখনও শুনিনি।
–থাক, খুব হয়েছে, এখন এসো তো কাছে।
রঞ্জনার শরীরের উত্তাপ নিতে নিতে প্রদীপ্ত ভাবে, জীবনের যাবতীয় রহস্য যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে তাহলে জীবনটা একঘেয়ে ক্লান্তিকর হয়ে যায়। চাকরির শুরু থেকেই অফিসটুরে প্রদীপ্ত বেশিরভাগ ব্যাঙ্গালুরুতেই যায়। ফ্লাইট লেট বা ক্যানসেল হবার ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়।
গত মাসে সকালবেলায় ব্যাঙ্গালুরুতেই এয়ারপোর্টে এসে শুনল ঘন কুয়াশার জন্য ফ্লাইট লেটে ছাড়বে। লাউঞ্জের কোণায় বসে এক কাপ কফি নিয়ে প্রদীপ্ত সেদিনের খবরের কাগজটায় চোখ বোলাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর এক সুবেশা ভদ্রমহিলা এসে ওর পাশে বসল। ঈষৎ উত্তেজিত হয়ে চোস্ত হিন্দিতে কাউকে ফ্লাইট লেট হবার কথা বলছিলেন। কথাবার্তা শুনে মনে হল ভদ্রমহিলা দিল্লিতে কোনও ভাইটাল মিটিং অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছেন।
ফোনটা রেখে প্রদীপ্তর দিকে তাকিয়ে মুখে আলগা হাসি টেনে বলল –এক্সকিউজ মি, ক্যান আই হ্যাভ ওনলি দ্য ফ্রন্ট পেজ অফ ইয়োর নিউজপেপার প্লিজ।
প্রদীপ্ত মৃদু হাসি হেসে ঘাড় নেড়ে বলল –ইয়েস ইয়েস। হোয়াই নট! পুরো পেপারটা ধরে ভদ্রমহিলার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল।
তারপর অলস দৃৃষ্টি ফেলে প্রদীপ্ত টুকরো টুকরো নানা ঘটনা দেখছিল।
হঠাৎ ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ রিংটোনটা কানে ভেসে এল। তারপরই ‘ইয়েস রেখা স্পিকিং’ কথাটা শোনামাত্র প্রদীপ্ত সচকিত হয়ে গেল।
ভদ্রমহিলার হাতের ছোটো ব্যাগটায় লাগানো ট্যাগটা সন্তর্পণে দেখার চেষ্টা করল। দেখল লেখা আছে রেখা রায়।
প্রদীপ্ত দেখল ভদ্রমহিলা ফোনে বাংলাতেই কথা বলছেন, তবে কথার মধ্যে ব্যস্ততার সুর। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে প্রদীপ্ত প্রায় কুড়ি বছর আগের দেখা রেখার সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করছিল।
নিজের অগোচরেই প্রদীপ্ত কতক্ষণ যে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে ছিল, জানে না। চমক ভাঙল ভদ্রমহিলার কথায় –ডু য়ু ওয়ান্ট টু সে সামথিং?
প্রদীপ্ত অস্বস্তির হাসি হেসে বলল –আপনি বাঙালি?
– হ্যাঁ। কেন বলুন তো?
কে জানে কেন ভদ্রমহিলার ভ্রূ কুঁচকে চোখ সরু করে কথা বলার ভঙ্গিটা প্রদীপ্তর খুব পরিচিত লাগল।
তাই সামান্য ইতস্তত করে বলল –আপনি কি কখনও আগরপাড়ায় থাকতেন? কুসুমপুর বিদ্যামন্দিরে পড়াশোনা করতেন? আপনার নাম রেখা দে?
প্রদীপ্তর কথায় ভদ্রমহিলার চোখে-মুখে একরাশ বিস্ময়। আলতো করে ঘাড় নেড়ে বললেন –হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো আমি ঠিক…।
প্রদীপ্ত একগাল হেসে বলল –আমাকে চিনতে পারলে না রেখা? আমি প্রদীপ্ত। প্রদীপ্ত সিন্হা। দ্যাখো একেই বলে পৃথিবী গোল। আমি জানতাম। ঈষৎ প্রত্যয়ীস্বরে বলল –শুধু জানতাম না বিশ্বাস করতাম, একদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবেই। আর দেখা হলে চিনতে আমি পারবই।
ভদ্রমহিলা অস্বস্তির হাসি টেনে বললেন –প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আর একটু যদি ডিটেলে বলেন তো হয়তো সব মনে পড়ে যাবে।
ভদ্রমহিলার কথায় প্রদীপ্তর যেন সব উৎসাহে জল পড়ে গেল। অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার দিকে তাকায় প্রদীপ্ত –সত্যি আমায় চিনতে পারছ না? নাকি ঠাট্টা করছ? আরে ক্লাসে সবসময় তুমি আমার পাশে বসতে। আমরা একসঙ্গে স্কুলে আসতাম, ফিরতামও একসঙ্গে। তুমি কাঠচাঁপা ফুল খুব ভালোবাসতে। স্কুলের পিছনের গাছটা থেকে আমি ফুলের ডাল ভেঙে আনতাম। মনে পড়ছে?
ভদ্রমহিলা ঘাড় নেড়ে বললেন –হ্যাঁ, হ্যাঁ একটু একটু মনে পড়ছে।
প্রদীপ্ত মরিয়া হয়ে মনে করানোর চেষ্টায় বলল –আচার খেতে খুব ভালোবাসতে। ঠাকুমার ঘর থেকে আচার চুরি করতে গিয়ে কাঁচের বয়াম ভেঙে ফেলেছিলাম। হাত-পা কেটে রক্তারক্তি কান্ড। তা দেখে তুমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলে, আর আমি ধরা পড়ে গেলাম।
সরস্বতী পুজোর দিনে সকালে উঠে ফুল চুরি করতাম। মনে পড়ছে সে সব দিনের কথা?
কথার মাঝেই দিল্লি ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জারদের চেক্ ইন করার জন্য অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা গেল।
ভদ্রমহিলা হাতের ব্যাগটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর প্রদীপ্তর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি হেসে বললেন – বাব্বা কতদিন আগেকার ঘটনা। এত ডিটেলে সব কিছু মনে আছে দেখে সত্যিই ভীষণ আশ্চর্য লাগছে। ওকে চলি। সো নাইস টু মিট ইউ। বলে প্রদীপ্তর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
প্রদীপ্ত যন্ত্রবৎ হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। দুটো হাতের ছোঁয়াতে কোনও উষ্ণতা ছিল না।
রেখার চলে যাওয়াটা প্রদীপ্ত দেখতে দেখতে ভাবল, এতদিনে রেখা সত্যি সত্যিই ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেল। তারপরই হঠাৎ মনে হল, নাঃ এভাবে রেখাকে ও হারিয়ে যেতে দেবে না। রেখার সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাটা প্রদীপ্ত রঞ্জনাকে কখনও বলবে না। রেখা ওর জীবনে যে-জায়গায় ছিল, রঞ্জনার কাছে গল্প করার মধ্য দিয়ে প্রদীপ্ত ওর রেখাকে ঠিক সেই জায়গাতেই নিজের করে রাখবে।