সকাল এখন আটটা। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আমার বিপরীতে অমর। আমাদের সংসারের তৃতীয়জন অর্থাৎ ঊর্মি আজ টেবিলে নেই। ঊর্মির কথা মনে পড়তেই ল্যান্ডফোন বিশেষ সুরে বেজে ওঠে। ফোন ধরতেই ও-প্রান্ত থেকে ব্যারিটোন ভেসে আসে এটা কি ঊর্মি দাশগুপ্তর বাড়ি?
—হ্যাঁ, বলছি, জবাব দিই আমি।
—আপনি?
—ওর মা, মিসেস দাশগুপ্ত।
—শুনুন মিসেস দাশগুপ্ত, ময়দান থানা থেকে বলছি, আপনার মেয়েকে সেন্সলেস অবস্থায় ময়দানে পাওয়া গেছে। ওকে আমরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করিয়েছি। পকেটে ভাগ্যিস মোবাইলটা ছিল। ওটা থেকেই আপনাদের নম্বর পেলাম। শিগগির একবার নার্সিংহোমে আসুন।
লাইন কেটে যায়।
পুরো ঘটনাটা ভালো করে বুঝে উঠতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগে। গতকাল রাতে ঊর্মি বাড়ি ফেরেনি। থানা, পুলিশ, নার্সিংহোম শব্দগুলি একসঙ্গে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ফেলে। আমি ঘামতে থাকি। ইদানীং সামান্য উত্তেজনাতেই প্রেসারটা বেড়ে যায়।
বিপরীতে বসে থাকা অমর নির্বিকার চিত্তে টোস্টে একটা কামড় বসিয়ে কফির মধ্যে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মাথাটা ঝাঁ করে জ্বলে ওঠে। হাতে থাকা স্যান্ডউচটা ধাঁই করে ছুড়ে মারি ওর মুখে। আচমকা আঘাতে অমর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চলকে পড়ে কফি। থতমত খেয়ে বলে, কী-কী মানে কী হল!
—কী হল! তোমার মেয়েকে ময়দানে আনকনসাস অবস্থায় পুলিশ পেয়েছে। ওকে ওরা উডল্যান্ডসে ভর্তি করেছে।
—সে কী! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে ওর। বলে, চলো চলো, এক্ষুনি চলো। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে অমর টেবিলে এমন জোরে ধাক্কা মারে যে টেবিলের কফিমাগ, ব্রেড, ডিমের পোচ, জলের জাগ, ইত্যাদি ছিটকে পড়ে আমার গায়ে।
রাগে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। এখন ঝগড়াঝাঁটির সময় নয়। দাঁত কিড়মিড় করে কেবল বলি, আচ্ছা অপদার্থ ব্যাটাছেলে একটা!
—বেবি, ইয়ে মানে, কিছু মনে কোরো না, আমি ইচ্ছে করে…, ঘাবড়ে গেলে তোতলানো অমরের পুরোনো অভ্যাস।
—চোপ, একদম চোপ। এক্ষুনি তৈরি হয়ে নাও। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করো। আর হ্যাঁ, তোমার ক্রেডিট কার্ড, ঊর্মির মেডিক্লেম কার্ডটা নিতে ভুলো না। যাও শিগগির।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে যাই, ধ্যাতানি খেয়ে অমর ছোটে। আমিও তৈরি হয়ে নিই চটপট! এমন একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটানো সম্ভব? অমরটা চিরকাল নার্ভাস। কোনও ঘটনা ফেস করার মতন মানসিক জোর নেই। কী করে অফিস সামলায় কে জানে? ইদানীং একটু ঘাবড়ে গেলেই হুইস্কি নেয়। আর হুইস্কি পান করে আরও বোদাটে মেরে যায়। মাথা একদম কাজ করে না। তখন বলে, বেবি, প্লিজ ডু সামথিং। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। হাত-পা কেমন ঠান্ডা মেরে যাচ্ছে। একটা যা তা।
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে অমর বলে, বেবি, ঊর্মির ইন ফ্যাক্ট কী হয়েছে বলল পুলিশ?
—বলল, ওকে আনকনসাস অবস্থায় ময়দানে আজ ভোরে পাওয়া গেছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু ঘটেনি, জবাব দিই আমি।
অমর খানিক থম মেরে থেকে আচমকা উত্তেজিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, এইসব, সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। তুমিই মেয়েটাকে জাহান্নমে পাঠাচ্ছ। উত্তেজনায় লাল হয়ে ওঠে মুখ-চোখ।
আমারও মাথা গরম হয়ে যায়, মুখ সামলে কথা বলো অমর। সাবধানে গাড়ি চালাও। ইদানীং মাঝেমধ্যেই ও কেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে জ্বলে উঠছে। বিয়ের পর প্রথম প্রথম এরকম করত। একবার শ্যামলদাকে দিয়ে আচ্ছা করে কড়কে দিয়েছিলাম। এতদিন ঠিক ছিল। আবার বিগড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওই উকিল বন্ধুটাই মাথা খাচ্ছে ওর। কী সাম চ্যাটার্জী যেন। ওটাকে একটু সাইজ করতে হবে।
গাড়ি পার্কিং লটে দাঁড় করিয়ে ছুটে যাই আমরা। দেখি ক্যালকাটা পুলিশের এক সাবইন্সপেক্টর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সামনাসামনি আসতেই বলল, আপনারা মি. অ্যান্ড মিসেস…
—দাশগুপ্ত, কথা শেষ করি আমি, হোয্যার ইজ আওয়ার চাইল্ড?
—আসুন আমার সঙ্গে, বলে অফিসার লিফটের দিকে এগোন। ওকে অনুসরণ করে একটি কেবিনের সামনে পৌঁছোই, উনি ইঙ্গিতে বোঝান ওটাই ঊর্মির কেবিন। ধন্যবাদ দিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি ঊর্মি আনকনসাস। পাশে একটি নার্স বসে। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ায়।
দ্রুত ঊর্মির সামনে যাই। ঠোঁট ফুলে উঠেছে, নীলচে বাদামি জমাট রক্ত। গালে, গলায় দাঁতের দাগ, বুঝতে বাকি থাকে না কিছু। অমরের দিকে তাকাই।
—ঊর্মি, মাই চাইল্ড, হাউমাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমর ওর বুকে। কাঁদতে থাকে অবুঝ শিশুর মতো। ওকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করি। নার্স বলে ওঠে, আরে আরে করছেন কী, শি নিডস কমপ্লিট রেস্ট। আপনারা ডক্টরের সঙ্গে দেখা করুন।
—কে দেখছেন ওকে? আমি প্রশ্ন করি। অমর চোখের জল মোছে। ডক্টর সোম। আসুন আমার সঙ্গে, নার্স এগিয়ে যায়। সোম-এর ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক পরিচয়টুকু দিয়ে ও চলে যায়।
—প্লিজ বি সিটেড। ডক্টর সোম বলেন, আচ্ছা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার মেয়ে কোনও ড্রাগস নিত?
অমর বা আমি কেউই এ প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। দুজনে দুজনার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উত্তর আমিই দিলাম, না, সেরকম তো কোনওদিন দেখিনি। এ প্রশ্ন করছেন কেন?
—মেয়েটি ডেডলি আনকনসাস। ওর ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে টেস্টের জন্য পাঠিয়েছি। প্রাথমিক পর্যায় জানা গেছে কোনও উচ্চ ক্ষমতাযুক্ত ড্রাগ ওর শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ড্রাগটা ল্যাবে আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা চলছে।
—বললাম, আপনি ডাক্তার, আপনার কাছে কিছু লুকোনো উচিত নয়। ইদানীং ঊর্মি ড্রিংকস নিত একটু আধটু। তবে ড্রাগস যে নিত না সে ব্যাপারে আমি শিওর।
—খোঁজ নিন ভালো করে। ওর ঘর সার্চ করুন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। আজকালকার হাইপ্রোফাইল অ্যাফ্লুয়েনট ঘরের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই এইসব নেশার কবলে পড়ে জীবন শেষ করে ফেলছে। মনে রাখবেন, ইয়োর চাইল্ড ইজ দ্যা মোস্ট প্রেশাস ব্লেসিং অন ইউ। একটা বাচ্চার জন্য চাইল্ডলেস কাপলসরা কী মর্মবেদনায় জ্বলে পুড়ে মরছেন তা তো দেখছি।
আমি চুপ করে থাকি। অমরের অবস্থা বুঝি এক্ষুনি ফেটে পড়বে। ইদানীং আবেগটাবেগ একদম চেপে রাখতে পারে না। স্থান কাল পাত্র বিবেচনা না করেই বার্স্ট করে, অত্যধিক অ্যালকোহল ইনটেকের ফল। কিন্তু মনে যে আশঙ্কা উঁকি মারছে সেটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া প্রয়োজন। বলি, ইজ শি ওকে অ্যাজ আ উয়োম্যান?
ডক্টর সোম কঠিন স্বরে বলেন, আই অ্যাম সরি টু সে মিসেস দাশগুপ্ত, শি ওয়াজ ব্রুটালি রেপড অ্যাজ অ্যান আনফ্রেমড প্রপার্টি। সম্ভবত, বাই আ গ্যাং অফ পার্সনস। আওয়ার এগজামিনেশন ইজ গোয়িং অন।
—ওহ্ মাই গড! শোনামাত্র অমর চেঁচিয়ে ওঠে পাগলের মতো। দুহাতে মুখ ঢাকে। আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। আমার মেয়ে এত বড়ো বোকামি করল? কিন্তু কেন? আমারই মতো ফাস্ট লাইফ চায় ও। হ্যাঁ, ওর চাওয়াকে প্রশ্রয় দিয়েছি আমি। তবে সেজন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা নিতেও কি শেখাইনি ওকে? অমরটা কেঁদেই চলে।
—শান্ত হোন, এ সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। ডক্টর সোম বলেন, থানায় যান। পুলিশের সঙ্গে কো-অপারেট করুন। ইয়োর কেস হ্যাজ অলরেডি বিন লজড।
মাথা ঠান্ডা রেখে বললাম, এখন আমাদের কী করণীয়?
—মেডিক্লেম কার্ড আছে নিশ্চয়ই? ওটা রেখে যান, সঙ্গে আপনাদের ভিজিটিং কার্ড। অমর ওগুলি এগিয়ে দেয়, ফের দুহাতে মুখ ঢাকে। বলে, উফ্ আমি, আমি ভাবতে পারছি না।
ডক্টর সোম এগিয়ে এলেন। অমরের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভেঙে পড়বেন না মি. দাশগুপ্ত। ঘটনা এর থেকেও খারাপ হতে পারত। মেয়েকে ফেরত না-ও পেতে পারতেন। দুষ্কৃতিরা ওকে বিক্রি করে দিতে পারত। কিংবা শরীর থেকে অপারেট করে কিডনি, আই, ব্লাড ইত্যাদি বের করে নিতে পারত। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন সেসব কিছুই ঘটেনি। মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন আপনারা। নাও প্লিজ গো হোম, অ্যান্ড কিপ ক্লোজ কনট্যাক্ট উইথ আস। ওর জ্ঞান আসলে জানানো হবে।
ডক্টর সোমকে ধন্যবাদ জানিয়ে অমর আর আমি থানা হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। মানসিক ভাবে দারুণ বিপর্যস্ত আমি। ঊর্মির এই মারাত্মক পরিণতিটা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
একটু আগে সন্ধ্যা নেমেছে। এইমাত্র ডক্টর সোম ফোনে জানালেন যে, ঊর্মির জ্ঞান ফিরেছে। বারবার বাবার কথা বলছে। এক্ষুনি ওর চোখের সামনে দুএকটি প্রিয়জনের মুখ বড়ো প্রয়োজন।
সাধারণত অফিস ছাড়তে আমার আটটা-সাড়ে আটটা বাজে। কিন্তু এরকম ফোন পাওয়ার পর আর অফিসে থাকা সম্ভব নয়। গাড়ি নিয়ে দ্রুত নার্সিংহোমের দিকে রওনা দিই।
গাড়ির গতি বাড়ে। বুকটা হু হু করে ওঠে ঊর্মির জন্য। চোখের কোল ভিজে যায়। ওর এই পরিণতির জন্য কি আমি দায়ী? ওকে তো সব সময় বোঝাতাম আমি। তা ছাড়া নিজের ভালো-মন্দ বোঝার মতন বয়স ওর হয়েছে। একুশ বছর বয়স নেহাত কম নয়! মানুষ হতে গেলে যতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রয়োজন তাতে খামতি ছিল না। তবু মেয়েটা এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল কেন?
—আচ্ছা বেবির কি উচিত ছিল না, একটু সংযত জীবন যাপন করা? নারীমুক্তি নারী স্বাধীনতায় ও বিশ্বাসী। স্বেচ্ছাচারিতাকে ও পলিশড স্বাধীনতার মোড়কে মুড়ে নিয়েছে। মায়ের অসংযত জীবনযাত্রা কি ঊর্মির মনে কোনও প্রভাব ফেলেনি? নিশ্চয়ই ফেলেছে। মা হিসাবে কতটুকু কর্তব্য করেছে বেবি? সেই ছোট্টবেলা থেকে তো মেট্রনের দাযিত্বে বাচ্চা। মাত্র চার মাসের বাচ্চাকে ফেলে অফিস জয়েন করেছিল, আমার বারংবার বারণ সত্ত্বেও। তিন বছর বয়স থেকেই ও ক্রেশে। ক্লাস ওয়ান থেকে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। বন্ডিংটা তৈরি হবে আর কী করে?
গাড়িটা পার্কিং লটে রেখে চারতলায় ঊর্মির কেবিনে যাই। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ঊর্মি, আমার দিকে তাকাল, অস্ফুটে উচ্চারণ করলে, বাপী। বলেই জ্ঞান হারাল।
দ্রুত ওর কাছে যাই। মাথায় হাত বুলোতে থাকি। চোখ দুটো আমার কেন যে এত অবাধ্য?
কতক্ষণ এভাবে কাটে জানি না। ঈশ্বরকে ডাকি, ভগবান, ওকে সুস্থ করে তোলো তুমি। নার্সের তাগাদায় বাইরে আসি। ডক্টর সোমের চেম্বারে যাই। বসুন মি. দাশগুপ্ত, বলেন ভদ্রলোক। এখন কেমন বুঝছেন?
—বেটার দ্যান বিফোর। সকালে বেশ কয়েকবার জ্ঞান এসেছে এবং গেছে। সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে মাইল্ড। আমরা চাইছি পেশেন্ট যতটা সম্ভব মেন্টাল রেস্টে থাক। জেগে উঠলেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠছে।
—ওর শরীরের ড্রাগটা আইডেন্টিফাই হয়েছে?
—হ্যাঁ, অতি পরিচিত একটা ওষুধ, কমনলি নোন অ্যাজ ক্লাব ড্রাগস। সম্ভবত ওর অজান্তেই ড্রিংকসে কেউ মিশিয়ে দিয়েছিল। শুনলাম ও সেদিন কলকাতার এক ডিসকো ঠেক-এ মাঝ রাত অবধি ছিল।
—ড্রাগটা কি খুব মারাত্মক?
—ইয়েস, ভিক্টিমের বিন্দুমাত্র বাধা দেবার ক্ষমতা থাকে না।
পুলিশ এসেছিল শুনলাম। আমি আবার প্রশ্ন করি।
—হ্যাঁ, ওরা তদন্তের স্বার্থে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছিল বলে শুনলাম। আমি তখন ছিলাম না, রাউন্ডে বেরিয়েছিলাম।
—ঊর্মির এ অবস্থায় ওদের অ্যালাউ করলেন কেন? অনুযোগ তীব্র হয় আমার।
—বারণ করে দিয়েছি, পেশেন্ট সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওরা আর ডিস্টার্ব করবে না, বললেন ডক্টর সোম।
—থ্যাংক ইউ ডক্টর।
—ইটস অল রাইট। মনে জোর রাখুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইট ইজ আ গ্রেট শক ফর হার। শি নিডস প্রপার কাউন্সেলিং। ওকে শারীরিক ভাবে একটু সুস্থ করে সে ব্যবস্থা আমরা করব।
ডক্টর সোমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফের ঊর্মির কাছে যাই। ও এখনও অচেতন। মাথায় হাত বুলোই। নীরবে চোখের জল ফেলি। একসময় নার্সিংহামে ছেড়ে গাড়িতে এসে বসি। নিজেকে এত দুঃখিত, এত অসহায় আগে কখনও মনে হয়নি।
ড্রাইভ করতে করতে মনে হয়, ঊর্মিকে বড়ো করে তোলার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। যদিও মেয়ের এডুকেশনাল ব্যাপারগুলি বরাবরই বেবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়েছে। বেবির ইচ্ছাতেই ঊর্মি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন গার্লস হস্টেলে। ঊর্মি ছুটিতে বাড়ি আসলে বেবি অসন্তুষ্ট হতো।
গাড়িটা ক্লাবে পার্ক করি। আজ আর কারুর সঙ্গে নয়, একা একাই মদ্যপান করব। কোনার দিকে এক টেবিলে বসে দুটি ড্রিংকসের অর্ডার দিই।
ড্রিংকস নিতে নিতে মনে হয়, আমি নিশ্চিত, ঊর্মির আজকের পরিণতির জন্য বেবিই দায়ী। হ্যাঁ ঠিক তাই, বেবিই দায়ী। একবার শক্ত হাতে হাল ধরতে গিয়ে যা অবস্থা হয়েছিল, ল্যাজে-গোবরে একদম। ক্যালকাটা পুলিশের কোন ইন্সপেক্টর নাকি ওর দাদা, সেই দিনটার কথা ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী অপমান!
শালা, এমন হড়কানি দিল, পিলে চমকে যাবার জোগাড়। ব্যাটা বলে কিনা, মি. দাশগুপ্ত, আপনার স্ত্রী যে কমপ্লেন দিয়েছেন তাতে এক্ষুনি ফোরনাইনটি এইট-এ ধারায় কেস স্টার্ট করতে পারি, সেটা জানেন কি? অ্যারেস্ট করে আজ সারা রাত লকআপে রাখব, কাল কোর্টে চালান করব। নব্বই দিনের আগে জামিন পাবেন না। আর উনি আমাকে আপনার সম্পর্কে যা যা বললেন, তা যদি কোর্টে বলেন, কম সে কম বছর দশেক জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে। যাবেন নাকি?
—কোথায়? সভয়ে প্রশ্ন করি আমি।
—ঘানি টানতে?
আমি চুপ করে থাকি। লজ্জায় মনে হচ্ছে, গলায় দড়ি দিই। নিজের স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে… উফ্ ভগবান!
শালা আইসি বলে, স্ত্রীকে আর ডিস্টার্ব করবেন না। ওকে ঘাঁটালে কী হতে পারে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই? যান, বাড়ি যান এখন। কমপ্লেনটা আমার কাছে থাকল, দেখবেন এটা যেন আমাকে ব্যবহার করতে না হয়।
ধ্যাতানি খেয়ে গরুচোরের মতো বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। সেই থেকে আর কোনওদিন বেবির সঙ্গে আমার সংঘর্ষ হয়নি। আমি আমার মতো থাকি, ও ওর মতো। বেবি কী একটা এনজিও চালায়। তাছাড়া নানারকম মিটিং-ফিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বছর খানেক কথাবার্তা বন্ধ ছিল। পরে বন্ধুবান্ধব, লোকজনের নিন্দামন্দের কথা ভেবে আমাকে আপস করতে হল, বিশেষ করে ঊর্মির মুখ চেয়ে। ঊর্মি তুই কি বুঝবি না মা, আমার যন্ত্রণার কথা? এই নীরব রক্তক্ষরণের কথা? চোখ ফেটে জল আসে আমার।
—স্যার, আর কিছু? দেখলাম অর্ডার নেওয়ার জন্য ছেলেটি আগ্রহী চোখে তাকিয়ে টু মোর প্লিজ, জবাব দিলাম আমি। বেয়ারা সোডা বরফ মিশিয়ে ড্রিংকস তৈরি করে দিল। গেলাসে ঠোঁট ঠেকাই আমি। আমার মনে হয়, বেবির সঙ্গে দাম্পত্যের এই ফাটলের প্রভাব আমি কোনওদিন ঊর্মির ওপর পড়তে দিইনি। আমার কর্পোরেট লাইফের তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও যখন যতটা পেরেছি সময় দিয়েছি ওকে।
আশ্চর্য! গত তিন-চার বছরে ঊর্মি কত দ্রুত বদলে গেল! যা সব বন্ধুবান্ধব জুটল। কী তাদের অদ্ভুত সাজগোজ, কানে দুল, নাকে দুল, চুলে রং। ঊর্মিকে কত বুঝিয়েছি, যে-ফাস্ট লাইফ তুমি লিড করছ, ইটস নট অফ ইয়োর কালচার। টেক ইয়োর লাইফ সিরিয়াসলি, সব সময় সাবধানে থাকবে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে বাবা হিসাবে এর বেশি আর কী বলা যায়?
বছর খানেক হল ঊর্মি কেন সাইলেন্ট হয়ে গেছিল। প্রশ্ন করলে কোনও উত্তর দিত না। বকাবকি করলেও কোনও প্রতিক্রিয়া ছিল না। কেবলই হাত খরচের টাকা বাড়াতে বলত। একুশ বছরের একটি মেয়ের পাঁচ হাজার টাকা হাত খরচে পোষায় না? কী করে ও অত টাকা নিয়ে একটা কল সেন্টারে কাজ করে, শুনেছি। ওখানে মাইনেপত্তর ভালো। এত টাকা উড়িয়ে কী সুখের সন্ধানে তুই মেতে ছিলি মা? একটিবার আমার কথা ভাবলি না?
কিন্তু সেদিন ডিসকো ঠেক-এ ঊর্মিকে কারা নিয়ে গিয়েছিল? কে ওর ড্রিংকসে ক্লাব ড্রাগস মিশিয়েছিল? এভাবে কারা রেপ করল ওকে? পুলিশ কি পারবে কালপ্রিটগুলোকে ফিক্স আপ করতে? হাজার প্রশ্নেরা আমাকে তাড়া করে। পাগলা কুকুরের মতো আমার ভিতর ছুটতে থাকি আমি। উত্তেজনায় মদের মাত্রা বাড়ে। এক সময় সব কেমন জেবড়ে যায়।
শ্রদ্ধেয় বাবা ও মা,
এ চিঠি যখন তোমরা পাবে আমি তখন অনেক অনেক দূরে। এখন রাত্রি তিনটে। একটু আগে ঘুম ভেঙেছে। বোধ হয় ঘুমের ওষুধের ক্রিয়া শেষ। আজ ষষ্ঠ দিন। শরীরের ব্যথা অনেকটা কমেছে, বেশ সুস্থ বোধ করছি। কয়েকটি ক্ষত থেকে যাবে মনে হচ্ছে।
এ কয়দিনে আমাকে নিয়ে পেপারে যা লেখালেখি হয়েছে তাতে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তাই এ-পাড়া ছেড়ে চলে যাব মনস্থ করেছি। যাবার আগে তোমাদের সব জানানো উচিত বলে লিখে যাচ্ছি এ চিঠি।
কীভাবে যে এত সব ঘটে গেল বুঝতে পারলাম না। রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে কোনও না কোনও পরিচিত মুখ পেয়ে যাব এই আশায় ডিসকো ঠেক-এ আমি গেছিলাম। এক পেগ হুইস্কি নেবার পর ইচ্ছা করল একটু নাচতে। ডান্স ফ্লোরে একটা ছেলে হেসে নাচতে ডাকে। ছেলেটা স্মার্ট। নাচতে নাচতেই পরিচয় দেয়, ওর নাম জাভেদ। নিউ মার্কেটে ওর নাকি লেদার গুডসের দোকান আছে।
নাচ শেষ করে একটু দম নেবার জন্য বসি। আর একটা পেগের অর্ডার দিই। আমার সামনে এক জোড়া ছেলে মেয়ে দারুণ নাচছিল। সম্ভবত সেই সময়ে পাশে থাকা চাপ দাড়িওলা লোকটা আমার ড্রিংকসে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল। আশ্চর্য, তাতে ড্রিংকসের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি।
পরের গান শুরুর মুহূর্তে আমার মনে হয়, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। ক্রমশ বনবন করে ঘুরতে থাকে মাথাটা। দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। চোখের সামনে চারপাশ দ্রুত ঝাপসা হয়ে আসে। খেয়াল হয়, জাভেদ, পাশের চাপদাড়ি, আরও দু-তিনজন ছুটে এসেছে আমাকে সাহয্যের জন্য। ধরাধরি করে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে চায়। বিপদ বুঝতে পেরে আমি প্রাণপণে বাধা দিতে থাকি, চেঁচাতে থাকি, হেল্প, হেল্প। অনেক কিছু বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না। টের পাই প্রতিরোধের সমস্ত শক্তি দ্রুত হারিয়ে ফেলছি। ছেলেগুলোর কথা কানে আসে ভাসা ভাসা, হঠ যাইয়ে হঠ যাইয়ে সামনে সে। মাই সিস্টার ইজ ফিলিং সিক।
আশ্চর্য! কেউ ওদের কোনও বাধা দিল না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যতদূর মনে পড়ে ওরা পাঁচজন আমাকে লিফটে করে নামিয়ে ধরাধরি করে একটা বড়ো গাড়িতে তোলে। বোলেরো কিংবা টাটা সুমো হতে পারে। একজন বলল, জলদি ভাগ হিয়াসে।
গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটছিল। গাড়ির মধ্যেই ওরা আমার শরীর থেকে জামাকাপড় টেনেহিঁচড়ে খুলছিল হিংস্র ভাবে। জানোয়ারগুলো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো কাড়াকাড়ি করে ছিড়েখুঁড়ে খেতে চাইছিল আমার দেহ। একজন জিন্সটা খোলার চেষ্টা করছিল। আমার বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ ক্ষমতা তখন নেই। ক্রমশ জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান হল, দেখি আমি নার্সিংহোমে। পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছি।
বাবা, তোমার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এও বুঝি তুমি নিজেকে কতটা অসহায় বোধ করো। তোমার প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। তোমার আর মায়ের মধ্যে যে বিরাট এক শূন্যতা তা আমাকে বারবার কষ্ট দিয়ে এসেছে। জানি এতে তোমার কোনও দোষ নেই। কেন যে এত মদ খাও তাও বুঝেছি। তবে এত মদ খেও না বাবা। অন্তত আমার কথা ভেবে মদ খাওয়াটা কমাও।
আমার দুঃখ কেবল একটাই— তোমরা আমার যন্ত্রণার খোঁজ কখনও নাওনি। আমার মনে পড়ে না, তোমরা দুজন একসঙ্গে স্কুলে আমাকে দেখতে এসেছ কখনও। জীবনে কোনওদিন একসঙ্গে আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছ। যে কটা জন্মদিন পালন করেছ, সেগুলিও কেমন যেন মেকি, ফাঁকা ফাকা, এলোমেলো।
মা, তোমাকে বলি, আমাকে তুমি কোনওদিন ভালোবাসোনি। চিরকাল নিজেকেই ভালোবেসেছ। নিজের সুখ, নিজের ভোগ নিয়ে মত্ত থেকেছ। তোমার বহু ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। সেসব কথা এখানে লিখতে চাই না। তবে বলতে লজ্জা নেই, পুরুষের প্রতি আসক্তি তোমার আজও কমেনি।
মা, তুমি আমার জন্য যতটুকু করেছ তা কেবল মিনিমাম কর্তব্যবোধ। আমার এই ছোট্ট জীবনে যতটুকু উপলব্ধি করেছি তাতে মনে হয়, দাম্পত্যে যদি ভালোবাসা না থাকে সেক্ষেত্রে তাদের সন্তান নেওয়া কোনওদিনই উচিত নয়। তুমি এ ঘটনার পর যে কবার দেখা করতে এসেছ, কেবল একটা কথাই জিজ্ঞাসা করেছ, আমার মেয়ে হয়ে তুই এত বড়ো ভুল করলি কী করে? মা, কীভাবে তোমাকে বোঝাই যে, ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।
বাবা, তুমি চিরকালই আমাকে বড়ো ভালোবাসো। তবু চিরকালই কেন যেন আমি নিজেকে খুব একা বলে বোধ করেছি। আজ তোমার মধ্যে আমি নিজের অসহায়তা, একাকিত্ব, যন্ত্রণা সব উপলব্ধি করতে পারছি বাবা।
বাবা, কাল তুমি এসেছিলে। বারবার আমার হাতখানা ধরে বলেছ, তোকে বাঁচতে হবে মা, বাঁচতে হবে নতুন করে। এসব দুর্ঘটনা ভুলে, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে তোকে। জীবনে তুই যত বড়ো পথ দেখেছিস, জীবন তার থেকে অনেক অনেক বড়ো।
নিজের ভুল আমি বুঝতে পেরেছি বাবা। বুঝেছি, মুহূর্তের অসাবধানতা আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে জীবন। তবে আমি বাঁচব বাবা। অন্তত একটি বার প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করব আমি।
এ মুহূর্তে আমার মুখময় অন্ধকার। এখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আমি। কোনও নতুন শহরে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে চাই। যেখানে আমার চারপাশে থাকবে না কোনও পরিচিত লোকজন, থাকবে না এই কালিমাখা অতীত।
তোমরা আমার খোঁজ কোরো না। প্রয়োজনে আমিই তোমাদের খোঁজ নেব। বিদায়, ভালো থেকো তোমরা। বাবা, আমার জন্য চোখের জল ফেলো না। তোমার কথাকে সম্মান দিয়ে যদি নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি তবেই ফিরব, নতুবা নয়।
প্রণাম—
ইতি,
তোমাদের ঊর্মি।
চিঠি শেষ। ভোরের আলো উঠি উঠি। ব্যাগ গোছানোই আছে। বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন গভীর ঘুমে। বাড়ির পিছনের গেট খুলে নিঃশব্দে পথে নামে ঊর্মি।
ক্রমশ ভোর হচ্ছে। ভোর এত সুন্দর! এত স্নিগ্ধ! পাখিরা ডাকছে। সকালের প্রশান্তি তার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক আশ্চর্য অনুভব। সামনে দূরের আকাশ, ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে ওটা।