(১ )
এই শনিবার পঞ্চানন পুজো। রাঘবের মনে ছিল না। যথারীতি সকালে উঠে লাল চা আর বিস্কুট, তারপর গরুর দেখভাল। দুটো গাই গরু আছে। এবেলা ওবেলা ভালোই দুধ দেয়। কিন্তু রাঘবের আফশোস বাড়ির কেউ দুধ খায় না, আর রাঘব নিজে দুধ বিক্রির বিরুদ্ধে। রাঘব রাতে দুধভাত আর দিনে দইভাত পছন্দ করে।
বড়ো মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে, সুতরাং সংসারে সাকুল্যে তিনজন। ছোটো মেয়ে বউ আর সে। শুক্রবার রাত্রে ছোটো মেয়ে জন্মদিন ছিল। লুচি করেছিল কৃষ্ণা। পাশাপাশি খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আমন্ত্রিত। রাঘবের অফিসে আবার সেদিন ছিল ইয়ার এন্ডিং। দুপুরে মাংস ভাত সাঁটিয়ে রাতে আর লুচি খেতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু লুচি রেখে দিয়েছে তার গিন্নি কৃষ্ণা।
ছোটো মেয়ে ইতু হঠাৎ বলে উঠল বাবা তুমি বাসি লুচি খাচ্ছ! আজ তো শনিবার। বটতলায় শিবের থানে যাবে না? দেড়খানা লুচি খেয়েছিল রাঘব, তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বলল ওরে বাবা কি পাপ করলাম…রে! অর্ধভুক্ত লুচি আর হাফ কাপ চা পড়ে রইল। আর সেদিনই দুর্ঘটনা ঘটল।
পুজো ছিল কদমগাছি রায়নাপুরে। বরাবর সে এটা করে। সবই নির্বিঘ্নে হল। কেবল ধ্যান করার সময় বাসি লুচির ঢেকুর। কেমন অম্বল অম্বল! মাথাটা চোঁ করে ঘুরে গেল রাঘবের। শুক্রবার মাংস, শনিবার বাসি লুচি। বটতলা থেকে রাঘব ফিরছিল, গায়ে নামাবলি।
দু-পাশে গাছ। পঞ্চায়ে লাগিয়েছে। পিচ ঢালা রাস্তা। মোরাম বদলে পিচ। সোনাঝুরি গাছের ছায়া। মনোরম লাগে রাঘবের। ছোটোবেলা থেকে বড়ো হয়েছে এই অঞ্চলে। আগে একটু নেশা করত রাঘব। এখন সেই সব বালাই নেই। ছেলেমেয়ে বড়ো হয়েছে। পুজোআচ্চা বেড়েছে। রাঘব নিজে এখন অভয়গিরি আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ। আজকাল মাঝে মাঝেই আকস্মিক বেগ চলে আসছে।
সোনাঝুরির গাছের পাশে চওড়া ড্রেন। সাইকেল থামিয়ে রাঘব বসে পড়ল। কানে পইতে। কিন্তু দু-এক ফোঁটা প্রস্রাব হওয়ার পরেই রাঘবের মাথা ঘুরে গেল। সটান ড্রেনে একেবারে মুখ গুঁজে পড়ল। কতক্ষণ যে সে ড্রেনে ছিল, তার নিজের খেয়াল নেই। অজ্ঞান রাঘব। যখন জ্ঞান ফিরল, সে তখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেডে। ডাক্তার বললেন সব গ্যাস থেকে হয়েছে। হাতে কোনও চোট নেই, মাথায় আঘাত নেই। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে কোমরে লাগছে।
চিত্তরঞ্জন থেকে বড়দা এসে উপস্থিত। বাড়ির বেশির ভাগ সদস্য ছড়িয়ে বড়ো বাড়ি, বেশিরভাগ ঘর তালা বন্ধ। একমাত্র দোল উত্সবে সবাই একসঙ্গে। তখন সাতদিন ধরে বাড়ি থাকে জমজমাট। রাধাকৃষ্ণের অষ্টমঙ্গলা পর্ব সমাপ্ত করে আবার সবাই কর্মস্থলে ফিরে যায়। অঢেল ভোগের এলাহি বন্দোবস্ত। লুচি ছোলার ডাল, তিন-চাররকম সবজি দিয়ে তরকারি, পায়ে। পাত পেতে সবাই মিলে ঘরে একসঙ্গে। বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাবার পর রাঘব কদিন ঝিম হয়ে বসে থাকে। নীলাচল, রাঘবের বড়দা এসে এবারে খুব হম্বিতম্বি করল। তার ধারণা রাঘব নেশা করে, রাঘব যত বলে সে নেশা থেকে শত হস্ত দূরে, নীলাচলের বিশ্বাস হয় না। বাড়ির পেছনেই তাল গাছ।
—তুই নিশ্চয়ই তালের রস খাস! নীলাচল বলল।
—বিশ্বাস করো দাদা রাঘব গলায় মিনতির সুর।
—তাহলে তাল গাছের মাথায় হাঁড়ি কেন? দড়ির মই কেন?
পরদিনই হাঁড়ি নামানো হল। দড়ির মই কেটে ফেলা হল। নীলাচলও নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল। ইচ্ছে করে রাঘবের মাঝে মাঝে তালের রস খেতে। কিন্তু গোপালপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবার কেউ নেশাভাং করে না।
কোমরের ব্যথা রাঘবের কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শে কোমরে বেল্ট, প্রতিদিন ব্যায়াম। রাঘবের বড়ো মেয়ে রানীগঞ্জে থাকে। জামাই গৌতম থানার সেকেন্ড অফিসার। বাড়ি বৈদ্যবাটি। চতুর ছেলে। নিজেই রাঘবকে বলে, বাবা মাইনেতে হাত দিতে হয় না। পকেট ভর্তি টাকা গৌতমের। গৌতমই সন্ধান নিয়ে এল, নিয়ামত্পুরের অদূরে একজন সাধিকা আছেন, তিনি ওষুধ দেন।
রাঘবের এক বছর চাকরি আছে। ছোটো মেয়ে ইতু এবার মাধ্যমিকে বসেছে। মনে উদ্বেগ সবসময় কাজ করে রাঘবের। যদি তার কিছু হয়ে যায়। মেয়েটার কি হবে! ড্রেনের ভেতর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় নাকে এসেছিল প্রস্রাবের গন্ধ। সেই গন্ধটা আর দূর হচ্ছে না। আর ওই গন্ধটা নাকে এলেই উদ্বেগ। বউ কৃষ্ণাকে বলেছে রাঘব। কৃষ্ণা খুব একটা পাত্তা দেয়নি। বলেছে ও তোমার মনের ভুল। এর জন্য রাঘবকে নিয়ামত্পুরের সাধিকার কাছে জোর করে নিয়ে এল জামাই গৌতম।
বাংলা বিহার সীমান্ত ঘেঁষা এক শ্মশানে সাধিকার আশ্রম দেখে রাঘবের চোখ ছানাবড়া। অত্যন্ত রূপসী। মাথায় জটা, একটি মধ্যত্রিশের মেয়ে গৌতমের সঙ্গে কী সব ইশারায় কথা হল। রাঘবের মোটেও পছন্দ হল না। গৌতম ও সাধিকা এমন ভাবে কথা বলছিল যেন দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা। লোকজন বিশেষ নেই। বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। অদূরে একটা মরা পুড়ছে। পাশে একটি সরু খাল। সামান্য জল। সেই জলে একটা লোক মুখ ধুচ্ছে। সন্ধে হয়ে আসছে। চারধারটা নির্জন।
জামাই গৌতমের স্কুটারে চেপে রাঘব এসেছে। তার আসার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। বড়ো মেয়ে জোর করে পাঠিয়েছে। বড়ো মেয়ে বিশ্বাস এই সাধিকার ওষুধ খেলে তার বাবা ভালো হয়ে যাবে। স্কুটারে ফেরার পথে রাঘব গৌতমের শরীর থেকে মদের গন্ধ পেল। রাঘবের কোমরে ব্যথাটা আজ যেন একটু বেশি। মাঝে মাঝে ভেতরে ভেতরে কেঁপে যাচ্ছিল রাঘব। ওষুধ খেতে হবে। রাঘবের মনে হচ্ছে স্রেফ বুজরুকি। সাধিকা ও গৌতমের নিভু আঁচে পারস্পরিক ইশারা ইঙ্গিত! ভাবতেই রাঘবের ব্যথা উঠে এল ঠিক শিরদাঁড়ার নীচে। কোমরের ডান দিকে।
রিতু, রাঘবের বড়ো মেয়ে বলল, বাবা কেমন বুঝলে? খুব ভালো সাধিকা তাই না!
রাঘব বিহ্বল। কেমন যেন ঘোর!
—ওষুধ দিয়েছে বাবা? নিয়ম করে কিন্তু খেতে হবে তোমাকে।
রাঘবের তখন বলতে ইচ্ছে হল রিতুকে, যেন গৌতম ওখানে আর না যায়! কিন্তু সবেমাত্র পেটে বাচ্চা এসেছে রিতুর। আগের বাচ্চাটা নষ্ট প্রসব। এই সময়ে এসব কথা বলা কি ঠিক!
রাঘবের চোখ বন্ধ। নাকে আসছে আশ্রমের ধূপের গন্ধ। রাঘবের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কাল ভোরেই চলে যেতে হবে। রাঘবের ফাটিকা গ্রাম। দেবখালের পাশে। দেবখাল বেশ বড়ো। খালের দুপাশে বাঁশের ঝাড়। খসেপড়া বাঁশের বাকল। হলদে ছায়া। নিরিবিলি। দুপুরের তাপ কেমন শান্ত! বাঁশ তলিতে গভীর ঘুঘু পাখির ডাক। নুয়ে পড়া বেতের লতা। একটা দুটো ফিঙ্গে পাখি। দেবখালের চারপাশে কৃষিজমি। বর্ষায় জল উপচে পড়ে। পচিয়ে দেয় জমির ধান। খালের জলের নীচে দলঘাসা শৈবাল। নলখাগড়া। দেবখালের সঙ্গে বিষহরি খাল মিশেছে।
( ২ )
বছর ঘুরে আবার পঞ্চানন পুজো। রাঘব নিবিষ্ট! কতক্ষণ বসে আছে রাঘব, কোনও খেয়াল নেই, চারদিকে প্রচুর মানুষ। রাঘবের স্পষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ। রাঘবের কোমরের ব্যথা শিরশির করছে। ব্যথার অনুভতি মেরুদন্ড বেয়ে ক্রমশ উঠছে।
শেষদিকে রাঘবের চোখে সবকিছু ঝাপসা লাগছে। কেমন যেন ছায়া ছায়া একটা আচ্ছন্ন ভাব। কিন্তু অর্চনা তো শেষ করতে হবে! এটা চার-পাঁচটা গ্রামের খুব ধুমধাম উত্সব। চোখ বন্ধ রাঘবের। কোথায় যেন পড়েছিল শ্রীপঞ্চানন (শিব) পরস্ত্রীর প্রতি আসক্তি পছন্দ করে না। রাঘবের তো নেই। তবে হঠাৎ এ কথা কেন মনে হল!
বাড়ি ফিরছিল রাঘব। গত বছর যেখানে তার দুর্ঘটনা হয়েছিল সেখানে রাঘব সাইকেল দাঁড় করল। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের রোদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। হঠাৎ কী যে মনে হল রাঘবের, একটা গাছের আড়ালে বসে নিজের পোঁটলা খুলে ফেলল। কৌতূহল, খিদে, একই সঙ্গে তার এখন। পোঁটলার মধ্যে কতরকম জিনিস। দেখে তো রাঘবের চোখ ছানাবড়া।
এক কুইন্টাল চাল, পাঁঠার মুড়ি, পাঁঠার পেছনের ঠ্যাং, তিন হাজার টাকা (পাঁচশো টাকার ছখানা কড়কড়ে নোট) তিন হাজার টাকার কয়ে। ওরে ব্বাস অস্ফুট কণ্ঠস্বর রাঘবের। সত্যি তো এত সব দিয়েছে তাকে! গত বছরে দেয়নি, তার আগের বছরও…! কিছু মনে নেই রাঘবের। কালে কালে কত হল। এতসব জিনিসপত্র নিয়ে সে কী করবে? তার বউ কৃষ্ণা, মেয়ে ইতু মাছ মাংস ছোঁয় না। রাঘবের ইচ্ছে করে খেতে।
পোঁটলার ভেতরে পোঁটলা। মাখা সন্দেশ, শসা, কলা, আপেল, আর নাড়ু। গুড়ের নাড়ু। পটপট কয়েটা নাড়ু খেয়ে নিল রাঘব। সঙ্গে বোতলের জল। পাশে পড়ে আছে ছাতা, দক্ষিণায় পাওয়া নতুন ধুতি। ক্রমশ অন্ধকার করে আসছে। তুমুল হাওয়া ও টিপটিপে বৃষ্টি। সকালের দিকেও মেঘ ঘন ছিল। মেঘের রং এত কালো যে বোঝাই যাচ্ছে না সময় কত! বাড়ি ফিরতেই তুমুল বৃষ্টি এল। আর তখনই তরল ছায়ার মতো শরীর নিয়ে কৃষ্ণা পাশে এসে দাঁড়াল।
—রিতুকে কেমন দেখলে? কৃষ্ণার প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল ভালো।
—আর গৌতম কেমন আছে? কৃষ্ণার পরের প্রশ্ন শুনে রাঘব বলল এসব প্রশ্ন করছ কেন হঠাৎ!
—কৃষ্ণা কেঁদে উঠল। বৃষ্টির শব্দ ও কান্নার হেঁচকি মিলেমিশে একাকার।
—কাঁদছ কেন? রাঘবের স্বরে বিস্ময়।
—ওরা গৌতমের মুখে অ্যাসিড ছুড়েছে। কান্নাভেজা গলায় কৃষ্ণা জানাল।
—কারা? রাঘব জিজ্ঞেস করল।
—মুখটা ঝলসে গেছে গৌতমের। সে এখন হাসপাতালে ভর্তি।
—কে মেরেছে অ্যাসিড রাঘব প্রশ্ন করল?
—আমাকে ফোন করেছিল হাসপাতাল থেকে কৃষ্ণা বলল।
ফ্যাকাশে হয়ে গেল রাঘবের মুখ। কৃষ্ণাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে কে ছুড়েছে অ্যাসিড?
ভোরবেলায় রওনা হল রাঘব। আসানসোল। বড়ো হাসপাতাল। বেডের কাছে কেউ নেই। চোখে মুখে ব্যান্ডেজ। বাইরে দাঁড়িয়ে গৌতমের বন্ধুরা। এদের মধ্যে অনেকেই পরিচিত রাঘবের। পলাশ গাছের নীচে রাঘবকে দেখে সবাই কেমন চুপ। রাঘব খুব নীচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, কে ছুড়েছে অ্যাসিড ওর মুখে? রাঘবের চোয়াল তখন শক্ত। কেউ বলতে চাইছে না। সবাই নিশ্চুপ।
বন্ধুদের মধ্যে একজন শুধু রাঘবকে ইশারায় পাশে ডেকে নিয়ে বলল, মেসোমশাই আমরা সামলে নিচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, গৌতম প্রাণে বেঁচে যাবে। শুধু মুখটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। এ সব ঘরের সমস্যা… সন্দেহ। চা খাবেন মেসোমশাই?
চায়ে দোকানে পাতা বেঞ্চিতে থপ করে বসে পড়ল রাঘব। কোমরের ব্যথাটা একেবারে মাথার পেছন বরাবর উঠে এসেছে। এভাবেও হয়! রিতু সন্দেহের বশে এই কাজটা করতে পারল? সন্দেহ তো তারও প্রথম থেকে হয়েছিল। তা বলে… বলে…!