‘শুনছ? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’
শাড়িগুলো ভাঁজ করে ওয়ার্ডরোবে গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ-ই প্রশ্ন করল অদিতি। প্রশ্নটা কানে ঠিকই গেছে সুব্রতর। কিন্তু সে কোনও উচ্চবাচ্য করল না।
আসলে সে খুব ক্লান্ত। অফিস থেকে ফেরার সময় ট্রেনে আজ অসম্ভব ভিড় ছিল। বসার জায়গা পায়নি। অবিরত কনুইয়ের ধাক্বা খেতে খেতে একঘণ্টার রাস্তাটা আসতে হয়েছে। স্টেশনে নেমেও কি শান্তি আছে? স্টেশন থেকে বাড়ি বাসে নেয় দশ মিনিট। কিন্তু বাসটা সাধারণত এড়িয়েই চলে সুব্রত। সেই তো ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে হবে। তার চেয়ে ফুটপাথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়া অনেক আরামের। শরীরের ব্যায়ামও হয়, আবার পয়সাও বাঁচে।
কিন্তু সব মিলিয়ে এই ধকলটা তাকে খুব নাকাল করে দেয়। বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মনটা হাঁকুপাঁকু করে। কোনওমতে ঘামে ভেজা জামাটা ছেড়ে ঢুকে পড়ে বাথরুমে। তাদের এই নতুন বাসাবাড়িতে ট্যাংকের জল পাওয়া যায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ে। অদিতি সেই জল বালতিতে জমিয়ে রাখে। সন্ধেয় সেই বালতির জলই হুড়মুড় করে মাথায় ঢেলে, ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে। তারপর সটান বিছানায় গিয়ে চিতপাত হয়। টেলিভিশনটা খোলাই থাকে। তবে, ছবি দেখে না সুব্রত। কেবল কানে শোনে। খবর শোনে। স্টুডিয়োয় নেতা-নেত্রীদের বিতর্ক শোনে। অদিতি সাধারণভাবে এ সময়টা তাকে বিরক্ত করে না। চা করে এনে রেখে যায়। কিন্তু আজ অন্যরকম হল।
সুব্রতর কোনও সাড়া না পেয়ে অদিতি আবার ডাকল তাকে, ‘কী গো? ডাকছি যে, শুনতে পাচ্ছ না?’
সুব্রত এবার অসহিষ্ণু গলায় উত্তর দেয়, ‘কী?’
‘এদিকে ফেরো না! কেমন মানুষ গো তুমি?’
সুব্রত এপাশ ফিরে বলে, ‘ফিরেছি। বলো–!’
‘আজ এপাড়ায় একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গেছে, জানো?’ অদিতির কণ্ঠে উদ্বেগ।
সুব্রত চোখ বুজে রেখেই বলল, ‘কী হল আবার? এ পাড়াতেও কি তোমার মন বসছে না?’
হাতের শাড়িটাকে এলোমেলোভাবেই আলনার উপর ফেলে রেখে অদিতি, সুব্রতর পাশে খাটের উপর এসে বসল। সুব্রতর ডানপাশে জানলাটা খোলা আছে। তাই অদিতি গলা নামিয়ে বলল, ‘আজ এ পাড়ায় খুব মারপিট হয়েছে। ছুরি মেরেছে।’
‘কী?’ সুব্রত উত্তেজনায় আধশোয়া হয়, ‘কখন? কোথায়?’
‘এই তো আমাদের দরজার প্রায় সামনে। দুপুরবেলা। বাইরে হঠাৎ হইচই। দরজা খুলে দেখতে গেলাম, কে যেন কড়া গলায় বলল, ‘দরজাটা বন্ধ করে দিন বউদি।’ আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছি। অনেকক্ষণ হইচইটা চলল। তারপর সেটা একটু থেমে যেতেই কান্নাকাটির রোল, আর-এক রকম হইচই শুরু হয়ে গেল।’
সুব্রতর চোখে পড়ল জানলাটা খোলা। সে ত্রস্ত হাতে সেটা বন্ধ করে দিয়ে ঘন হয়ে বসল।
‘কে কাকে ছুরি মেরেছে?’
‘পল্টুকে চেনো তো? ওই যে গো, টাইম-কলের সামনের বাড়িটায় থাকে! ওর বাড়িতে নাকি একটা লোক প্রায়ই যাওয়া-আসা করে। ওর বন্ধু। আজ বোধহয় সেই লোকটা মদ খেয়ে এসেছিল। পল্টু বাড়িতে ছিল না। সুযোগ পেয়ে পল্টুর বউয়ের সঙ্গে অসভ্যতা করতে যায়। ইতিমধ্যে পল্টু ফিরে এসে ঘটনাটা দেখে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে একটা ছুরি এনে সোজাসুজি বসিয়ে দিয়েছে বন্ধুর পেটে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। ওহ্…!’
বলতে বলতে অদিতির চোখমুখের ভাব পালটে গেছে। এতক্ষণ পরেও ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল এই শীতের সন্ধেতেও।
সুব্রত নিজেও কম উদ্বিগ্ন হল না। জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কী,’ অদিতি বিরস গলায় বলল, ‘কেউ বোধহয় থানায় খবর দিয়েছিল। পুলিশ এল। লোকটা তখনও মরেনি। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেল দেখলাম। কে জানে লোকটা বাঁচল না মরল!
‘আর, পল্টু?
‘নাহ্, পল্টুকে ধরতে পারেনি। সে ঘটনা ঘটিয়েই পালিয়েছে। পুলিশ সকলকেই জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কেউ বলতে পারল না সে কোথায় গেছে। নাকি জেনেও বলল না, কে জানে!’
‘তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল নাকি, পুলিশ?’
‘করেছিল। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। সাফ বলে দিয়েছি, সেসময় দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিলাম, তাই কিছুই কানে আসেনি।’
‘ওরা বিশ্বাস করল?’
‘বিশ্বাস করল কিনা জানি না। তবে, মাথা নেড়ে চলে গেল। আর কিছু জানতে চায়নি!’
‘খুব ভালো করেছ!’
‘মাথা খারাপ? কেউ এইসব ঝামেলায় পড়ে?
অদিতির মুখ সাদা হয়ে গেছে। খুব দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে উত্তেজনায়। চোখের সামনে আহত লোকটির চেহারাটা যেই ভেসে উঠছে, অমনি শিউরে উঠছে অদিতি। মুহূর্তের মধ্যে মুখটা ঘামে তেলতেল করছে। শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে ভীত চোখে সে সুব্রতর দিকে তাকাল।
তারপর বলল, ‘এদিকে পাড়ার লোকেরা সবাই দেখলাম পল্টুরই পক্ষ নিয়েছে। বলছে, পল্টু যা করেছে ঠিক করেছে। দুর্বৃত্ত বন্ধুটির এমন কঠোর শাস্তিই পাওনা ছিল। মাতাল অবস্থায় লোকটি নাকি প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে মেয়ে-বউদের সঙ্গে অভব্যতা করত, রাস্তায়-ঘাটে তাদের উত্ত্যক্ত করে মারত। পল্টু ছিল ওর দোস্ত। বন্ধুর বউকেও শেষে লোকটা ছাড়েনি…!
সুব্রত আনমনাভাবে বলল, ‘কিন্তু তা বলেই তো আর নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে আর-একটা বড়ো অপরাধ করে বসা যায় না!’
এ কথার কোনও জবাব দিল না অদিতি। আধ-ভাঁজ করা শাড়িটাকে নিয়ে সে গোড়া থেকে ভাঁজ করতে থাকে। সুব্রতর ভয়টা অন্য জায়গায়। সারাদিন সেও বাড়িতে থাকে না। অদিতি একা থাকে। পল্টুর বন্ধুর মতো আরও কত লোক এ অঞ্চলে আছে কে জানে! কোনওদিন তারা তো এ বাড়িতেও ঢুকে পড়তে পারে সুব্রতর অবর্তমানে। সেই ভাবনাটা মনে আসতেই শিউরে উঠল সুব্রত।
এবং যে-সমাধানটাকে সে আর ভাবতে চায় না, সেটাই খুব সহজে বলে উঠল অদিতি।
‘আমরা অন্য কোনও জায়গায় বাসা ভাড়া করে চলে যেতে পারি না?’
অদিতিকে এর আগে অনেকবার সে বুঝিয়েছে, নিজের জায়গা থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। পালাতে পালাতে একদিন দেখা যাবে, পালানোর জায়গাটাই আর নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে সুব্রতর সেই যুক্তিটাকেও নেহাত জোলো বলে মনে হওয়ায়, সে মনে মনে অসহায় বোধ করতে থাকে।
অদিতি থেমে থেমে বলে চলেছে, ‘তুমি সকালবেলা চাকরিতে বের হয়ে যাও। সারাদিন এ বাড়িতে আমি একলা থাকি। ভীষণ ভয় করে, জানো! তাও তো কত ঘটনার কথা বলি না তোমায়! প্রত্যেকদিনই এ পাড়ায় কোথাও না কোথাও ঝগড়া, মারামারি! কখনও ছুরি-চাকু চলছে, কখনও লাথি-ঘুসি। যখন-তখন পুলিশ এসে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। ধরা পড়ছে মদের ড্রাম, আফিম কিংবা চুরির মাল। কখনও দিনের বেলা প্রকাশ্যে রাস্তায় পাড়ার কোনও মস্তান কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি করছে। আবার কখনও কাছেপিঠের কোনও বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে অল্পবয়সি মেয়েদের। তারা নাকি মধুচক্র বসিয়েছিল। আর কতদিন এই বিশ্রী অবস্থাটা দেখে যেতে হবে বলো তো? মাঝেমধ্যে আমার ভীষণ ভয় করে।
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অদিতি। সুব্রত তাকে কোনও সান্ত্বনার কথা বলে না। তার সংকোচ হয়। অদিতির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে তার দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ করল। অভিজ্ঞতায় সে দেখেছে সিলিংয়ের সাদা রঙের দিকে তাকিয়ে থাকলে ভাবনারা গতি পায়।
অদিতি তার সামনে যে-প্রশ্নটা রেখেছে, তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় তার নেই। আবার এই প্রশ্নটার সামনে সে অসহায়ও। চাইলেও অদিতির আপাতসরল প্রশ্নের জবাব দিতে সে অপারগ। সে যদি বলতে পারত, ঠিক আছে, আমরা কালই অন্য কোনও পাড়ায় উঠে যাব, নতুন কোনও বাসায়, সে যেন বেঁচে যেত। কিন্তু সুব্রত জানে, এই শহরে নতুন বাসা খুঁজে পাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। কত কষ্ট করে এখনকার বাসাটা পাওয়া গেছিল, সে কথা সুব্রত ভোলেনি। ভালো টাকা সেলামি দিতে হয়েছিল। সেইসঙ্গে রাজি হতে হয়েছিল উচ্চহারে ভাড়ার শর্তে।
সে কথা অবশ্য অদিতিরও অজানা নয়। অঞ্চলটা ভালো, কিন্তু সেখানে থাকার জন্য গুণাগারও দিতে হচ্ছে উচ্চ হারে, এ কথা সুব্রতর মুখ থেকে শোনার পর প্রথম বেঁকে বসেছিল সে নিজে।
‘এত টাকা ভাড়া?’ চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যাঁগো, বাড়িভাড়াতেই তো আমাদের সংসারের সব টাকা বেরিয়ে যাবে, আমরা খাব কী?’
‘কী আর করা? ভদ্রলোকের পাড়ায় থাকতে হলে এটুকু খেসারত তো দিতেই হবে–!’
তারপর আর আপত্তি করেনি অদিতি। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে সেদিন নিজের আপত্তিকে আরও জোরালো করে তুলতে পারলে বোধহয় ভালোই হতো। নিত্যদিনের এই উদ্বেগ আর হ্যাপা সইতে হতো না!
সারাসন্ধে, তারপর সারারাত পাড়াটা অদ্ভুত রকম নীরব আর শান্ত হয়ে রইল। সেই নীরবতা, যা সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর। যে নীরবতা ভয়ের বার্তাবহ। ভোর হওয়ার পরও থমথমে ভাবটা গেল না। গোটা পাড়াটা যেন দমবন্ধ করে অপ্রিয় কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছে। সকালে অফিসে বেরোনোর সময়ই সেটা টের পেল সুব্রত।
বাসস্টপে পৌঁছে খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। স্বপ্নেন্দুর একটা ছোটোখাটো ইলেকট্রিক জিনিসপত্রের দোকান আছে। প্রয়োজনে কখনও-সখনও স্বপ্নেন্দুর দোকানে যেতে হয়েছে সুব্রতকে। সেই থেকেই মুখ চেনা।
তাকে দেখতে পেয়েই স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞেস করল, ‘কাল আপনাদের পাড়ায় একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটেছে শুনলাম! কী কাণ্ড বলুন তো!’
সুব্রত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘ভাবছি এ পাড়া থেকে চলে যাব। আপনি তো জানেন ভাই, আপনার বউদি সারাদিন একা বাড়িতে থাকেন! কাল যা ঘটেছে শুনলাম, তাতে এখানে পরিবার নিয়ে থাকাটাই তো দেখছি বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে!’
‘কোথায় যাবেন?’ স্বপ্নেন্দু জানতে চায়।
‘ঠিক নেই। এখনও তো কাউকে কিছু বলিনি। তা ছাড়া এ সময়ে সুবিধেজনক ভালো জায়গায় বাড়ি পাওয়াও তো সহজ ব্যাপার নয়!’
স্বপ্নেন্দু শুনে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমার নিজের একটা বাসা আছে, দাদা! দশ হাজার টাকা সেলামি দিয়ে নিয়েছিলাম। ভাড়া দিই মাসে দু-হাজার। ভেবেছিলাম পরিবার নিয়ে ওখানেই থাকব আর বাড়ির বাইরে একটা দোকান দেব। কিন্তু সেটা শেষপর্যন্ত হয়নি।’
সুব্রত ভাবে, সকাল-সকাল স্বপ্নেন্দু তাকে পাকড়াও করে তার নিজের ইতিহাস শোনাতে বসল কেন!
স্বপ্নেন্দু অবিচলিত মুখেই বলে যেতে থাকে, ‘শেষপর্যন্ত পুরোনো বাড়িতেই রয়ে গেলাম, জানেন! ওই বাড়িটা তালা দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। এখন ভাবছি, ভালো ভাড়াটে পেলে তাকে ছেড়ে দেব!’
সুব্রত হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল।
‘ছেড়ে দেবে? টাকাপয়সা কী দিতে হবে?’
স্বপ্নেন্দু বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য কীসের টাকাপয়সা, কীসের কী দাদা? আপনি ওই দশ হাজার টাকাই সেলামি দেবেন। ভাড়া দু’হাজার। তাড়া নেই। রাজি থাকলে দশ-বারো দিনের মধ্যে একটু জানিয়ে দেবেন আমায়!’
স্বপ্নেন্দু তার মোটরবাইকের মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
চিন্তায় পড়ল সুব্রত। দশ হাজার টাকা সেলামিতে ভালো জায়গায় বাসা পাওয়া এই সময়ে সহজ কথা নয়। তার উপর ভাড়াটাও মোটামুটি সামর্থ্যের মধ্যেই বলছে। এখন দেখার, পাড়াটা কেমন। সুব্রত ভাবল, আজ একবার অফিস থেকে ফেরার সময় স্বপ্নেন্দুর দোকানে যাবে। স্বপ্নেন্দু সেসময় যদি ফাঁকা থাকে, তাহলে ওকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটাও দেখে আসবে একবার।
রাতে বাড়ি ফিরতে অদিতি অন্য নানা-প্রসঙ্গের পরে জানতে চাইল, ‘কাউকে বলেছিলে নতুন একটা বাসা দেখার কথা?’
সুব্রত তখন দু-আঙুলে রুটি ছিঁড়ে আলু-পটলের তরকারিতে ডুবিয়ে মুখে দিয়েছে। চিবোতে চিবোতে বলল, ‘আজই একটা দেখে এলাম অদিতি। পাড়াটা বেশ ভালো। বাড়িটাও। কিন্তু নিতে হলে দশ-বারো দিনের মধ্যে দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। এত অল্প সময়ে এত টাকা কোথায় পাই, বলো তো!’
অদিতি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘শোনো বিয়ের সময় বাবা কিছু গয়না দিয়েছিলেন। এমনিতেও সেগুলো খুব পুরোনো ডিজাইনের। আমি তো পরিই না–!’
আঁতকে উঠল সুব্রত, ‘তুমি কি পাগল হয়েছ? তোমার গয়না বেচে টাকা জোটাব? আমার দ্বারা হবে না।… আর তা ছাড়া পরে কখনও তোমার বাবা জানতে চাইলে কী জবাব দেবে?
‘জবাবের ভারটা আমার উপরই ছেড়ে দাও। সংসারের প্রয়োজনেই যদি কাজে না লাগল তো ওই গয়না দিয়ে আমার হবে কী?’
‘তবু, আমার ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না অদিতি,’ সুব্রত কিন্তু-কিন্তু করে।
‘তাহলে কি এভাবেই আমাদের জীবন কেটে যাক, এটাই বলতে চাইছ? প্রত্যেক মুহূর্তে উদ্বেগের মধ্যে, নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দমবন্ধ হয়ে মরতে হবে? তোমার আর কী? তুমি তো সারাদিন অফিসেই কাটিয়ে দাও! ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি আমি’– অদিতির চোখের কোলে জল টলটল করে।
অদিতিকে কিছু বলতে পারল না সুব্রত। সত্যিই তো, ত্রুটি তার দিক থেকেই হয়েছে। সুব্রতর বাবা-মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছিলেন। তিনকূলে কেউ ছিল না সুব্রতর, এক দিদি ছাড়া। দিদি নয়নার বিয়ে হয়েছিল মফসসলের দিকে। উপরন্তু বিয়ের পর ওরা পাকাপাকিভাবে মুম্বাইয়ের বাসিন্দা হয়ে যায়। কারণ, তার স্বামী অখিলের অফিস তাকে মুম্বাইয়ে বদলি করে। মুম্বাইয়ে যাওয়ার পরেই সুব্রতর উপরে বিয়ের জন্য চাপসৃষ্টি করা শুরু করে দেয় নয়না। স্বাভাবিক, দিদি হিসাবে তার গভীরতর চিন্তা ভাইকে নিয়ে। ভাইকে জীবনে সেটলড দেখলে খুশি ও আশ্বস্ত হয়। কিন্তু সুব্রতরও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যও তার দরকার ছিল কয়েকটা বছর। সে অনেকবারই এ কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছে একাদিক্রমে নয়না ও অখিলকে। ওরাও অনড় ছিল। অখিল তো এমনও বলেছিল, ‘তোমার তো বাড়তি চিন্তা করার কিছু নেই সুব্রত! আমরা তো রইলাম!’
সুব্রত বলতে চেয়েছিল, ‘বউকে এনে তুলব কোথায়? এই ভাঙাচোরা ভাড়াবাড়িতে?’
‘ভাঙাচোরা বাড়ি সারিয়ে নিলেই সুশ্রী হয়ে যাবে,’ অখিল সহজ সমাধান করে দিল।
‘কিন্তু, তা সত্ত্বেও কিছু হওয়ার নয় অখিলদা। একখানা মাত্র ঘর। তাও এইটুকু–!’
‘তাহলে অন্য একটা বাড়ি দ্যাখ! যত তাড়াতড়ি পারিস! আমি পাত্রী দেখা শুরু করি,’ কঠোর সিদ্ধান্তের মতো জানিয়ে দিয়েছিল নয়না।
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সুব্রতর কান্না পেয়েছিল। দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়া মলিন ঘরের অবিন্যস্ত চেহারা দেখে সে ভেবে পাচ্ছিল না কোন স্পর্ধায় কোনও তরুণীকে এ বাড়িতে থাকতে সে বাধ্য করতে পারে! নতুন বাসা যে দেখবে, সেও অনেক টাকার ব্যাপার। সেলামি দিতে হবে। পুরোনো বাড়ির মতো পুরোনো ভাড়ায় থাকা যাবে না।
আলমারির লকার থেকে ব্যাংকের পাশবই বের করে সে নানারকম হিসেবনিকেশ করে দেখল। সঞ্চয় সামান্যই। তবু, সেটাকেই সম্বল করে সে একটি ভদ্রস্থ বাসাবাড়ির সন্ধান চালাতে থাকে। অখিল অবশ্য বলেছিল, ‘আজকাল কলকাতায় এঁদো গলিতেও কত ফ্ল্যাট উঠছে!’ সুব্রত এড়িয়ে গেছে। ফ্ল্যাট কিনতে হলে তাকে লোন নিতে হবে। কিন্তু এখনই ঋণের জালে জড়াতে রাজি নয় সে।
নতুন বাসাবাড়ি ঠিক করে অখিল আর নয়নার সঙ্গে অদিতিকে দেখতে গেছিল সুব্রত। অফিসের কাজ উপলক্ষ্যে কলকাতায় এসেছিল অখিল। সঙ্গে নয়নাকেও নিয়ে এসেছিল। এক সন্ধ্যায় তারা গেছিল অদিতিদের বাড়িতে। শীতকাল। বড়ো রাস্তার হ্যালোজেনের নীচে মৌচাকের মতো কুয়াশা জমে আছে।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার অদিতিদের। আড়ম্বর বিশেষ নেই। প্রথম দর্শনেই ধীর-স্থির, শান্ত, ভীরু চোখের মেয়েটিকে দেখে তার প্রতি এক অজানা আকর্ষণ অনুভব করেছিল সুব্রত। অখিলের ফিরে যাওয়ার তাড়া ছিল। সুব্রতর সম্মতি আছে দেখে, এখানেই সম্বন্ধ পাকা করে এসেছিল নয়না। বলেছিল, ‘তাহলে, আসছে ফাগুনেই চার হাত এক হয়ে যাক–!’
অদিতি এ বাড়িতে আসার পর, দৈনন্দিন জীবনের চেনা ছকটাই পালটে গেল সুব্রতর। সংসারের প্রতি, বাড়ির প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ, প্রতিদিন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরিয়ে আনত বাড়িতে। জীবন একটা নতুন ছন্দে বয়ে যেতে থাকল স্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর মতো।
কিন্তু সেটা অন্তরের উন্মাদনা। তাদের নতুন পাড়ায় আরও অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল তাদের চোখের আড়ালে, যা সেই উন্মাদনার প্রাবল্যে কিছুদিন ঢাকা পড়ে রইল। উন্মাদনা কিঞ্চিৎ স্থিমিত হয়ে এল যেদিন, সেদিন থেকে চোখে পড়তে থাকল বাহিরের আসল চিত্রটা। তখনই চারপাশের পরিবেশটা যেন দীর্ঘ এক অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরতে থাকল তাদেরকে, এমনকী তাদের সম্পর্কের সারল্য, নিরাপত্তা আর নৈকট্যকেও।
একদিন অফিসে যাওয়ার সময় তাদের বাসার ঠিক সামনে কয়েকজন নারী-পুরুষের অশালীন ঝগড়া শুনল সুব্রত। আর-একদিন সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরতে অদিতি জানাল, পাড়ায় বোমা পড়েছে। একদিন গভীর রাতে তারা শ্বাস চেপে রেখে শুনল, পুলিশের জিপ আসার আওয়াজ। তার কিছুক্ষণ পরেই দ্রুত কিছু পায়ের দৌড়ে যাওয়া, চাপা গলায় চিৎকার। পরদিন সকালে শোনা গেল, কয়েক গ্যালন দেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে পাড়ার কোনও বাড়ি থেকে। নিত্যদিন এমনই চলতে থাকল। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে অদিতির কাছে পাড়া সম্পর্কে এক-একটি নতুন কাহিনি শুনতে থাকল সুব্রত। শেষে একদিন অত্যন্ত অসহিষ্ণু গলায় অদিতি প্রশ্ন করল, ‘আমি তোমার স্ত্রী তো, নাকি?’
‘হঠাৎ এমন অদ্ভুত প্রশ্ন?’
‘বলো, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও–!’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!’
‘এবার বলো, কোন স্বামী তার স্ত্রীকে এরকম একটা অসুরক্ষিত জায়গায় সারাদিনের জন্য একা রেখে চলে যায়?’ অদিতির চোখের কোলে অভিমানে টলমল করে জল।
সুব্রত খুব অসহায় হয়ে যায়। সহজে কোনও উত্তর দিতে পারে না। কতবার সে অধৈর্য হয়ে ভেবেছে অদিতিকে বলবে, ‘তুমি তাহলে আপাতত সেই মফসসল শহরে তোমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকো। এখানে একটা ভালো বাড়ি পেলে, তোমাকে নিয়ে আসব।’
কিন্তু বাক্যগুলো শেষপর্যন্ত জিভ থেকে ঠোঁটের গোড়ায় আসেনি। কেন-না, এই সাময়িক বিরহের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে সে নিশ্চিত হতে পারেনি। তাকে তার সহকর্মীরাও বলেছে, কলকাতা শহরে এ ভাড়ায় বাড়ি পাওয়া মুখের কথা নয়। এই অবস্থায় কোন মুখে অদিতিকে সে বাপেরবাড়িতে গিয়ে থাকতে বলে?
এইসব চিন্তাভাবনা তাকে তিষ্ঠোতে দেয় না। অফিসের কাজেও মন বসে না তার। অনেকেই তার মধ্যে এই উন্মনা ভাবটা লক্ষ করেছে। সেদিন তার সহকর্মী অয়ন তাকে রীতিমতো চেপে ধরল, ‘কী হয়েছে তোর?’
‘কই, কিছু না তো!’
‘কিছু তো হয়েছেই। তোকে এত আনমনা আগে কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই কিছ লুকোচ্ছিস!’
সুব্রত খানিকটা বাধ্য হয়েই সব কথা খুলে বলে। অয়ন সব শুনে গম্ভীর হল। খানিকক্ষণ থেমে থেকে বলল, ‘এটা তো ঠিক-ই কলকাতা শহরে ভাড়াবাড়ি পাওয়া এখন বেশ দুষ্কর। চতুর্দিকে সব ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। রেস্ত থাকলে কিনে নাও। না হলে একটা ভালো পাড়ায় কোনও ভদ্র গৃহস্থের বাড়ির একচিলতে ঘরের জন্য মাথা কুটে মরো!’
এসবই সুব্রত জানে। তবু অয়নের কথা শুনে যায়। শেষে অয়ন আসল কথাটা জিজ্ঞেস করল।
‘ঠিক কলকাতা শহরের মধ্যে না, একটু দূরে যাবি? এই ধর, বাসে করে অফিস পৌঁছোতে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট লাগবে!’
‘সে তো অনেক দূর!
‘দূর হলেই বা, শান্তি আছে। ওখানে আমার মামার বাড়ি। শরিকি বাড়ি। দিদিমা যে-অংশটায় থাকত, দিদিমা মারা যাওয়ার পরে সে অংশটা ফাঁকাই। দুটো বড়ো ঘর। রান্নাঘর। বাথরুম। রাজি থাকলে বল, কথা বলি!
সুব্রত মাথা চুলকে বলল, ‘একটু গ্রামের দিক হয়ে গেল না?’
‘গ্রাম?’ অয়ন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ‘গ্রাম কী রে? আগে ছিল মফসসল। এখন রীতিমতো শহর। কলকাতা শহরটা ক্রমশ ওদিকে বাড়ছে। পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে গোল গোল তরঙ্গ হতে দেখেছিস? ঠিক ওরকম করে বৃত্ত বড়ো হচ্ছে। মূল শহরে তারাই থাকবে, যাদের ট্যাঁকের জোর আছে, বুঝলি? আর, আমাদের মতো হাভাতেরা সেই তরঙ্গের ঘাড়ে চেপে ছড়িয়ে যাচ্ছে বৃত্তের বাইরে নতুন বৃত্ত তৈরি করে। ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট, বস্!’
অদিতিকে বলতে সে লাফিয়ে উঠল। সে মফসসলেরই মেয়ে। তার তো খুশি হওয়ারই কথা। তার দুটো গয়না বাঁধা দিতেই হল। নইলে সেলামির টাকাটা জোটানো যাচ্ছিল ন।
ওরা উঠে এল নতুন বাসায়। পুরোনো বাড়ি। কিন্তু অনেকটা জায়গা নিয়ে। পিছনের দিকে বেশকিছু গাছগাছালিও আছে। সুব্রত বলল, ‘নাও, এবার খুশি তো? এখানে আর দিনদুপুরে খুনখারাবির প্রশ্ন নেই। কত ভদ্র পাড়া!’
অদিতি আকর্ণ হেসে বলল, ‘সত্যি!’
তবে সুব্রতকে ইদানীং একটু তাড়াতাড়িই অফিসে বের হতে হয়। অনেকটা রাস্তা। আগে থেকে বোঝা যায় না, কখন যানজট হবে! ফিরতেও আগের তুলনায় রাত হয়। সেসবই হাসিমুখে মেনে নিয়েছে সুব্রত।
দেখতে দেখতে নতুন বাসায় দু-মাস কেটে গেল তাদের। ভরা বর্ষায় তাদের ভাগের কিচেন গার্ডেনে লকলকিয়ে উঠল লাউগাছ। সুব্রত এক রবিবার বাঁশের কঞ্চি কেটে মাচা বানিয়ে দিল।
মরশুমের শেষ বৃষ্টির দিন ছিল সেটা। ছাতা মাথায় আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে সদর দরজার কড়া নাড়তেই হাট করে খুলে গেল দরজাটা। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে দরজায় খিল এঁটে দিল অদিতি। লোডশেডিং হওয়ায় তার অবয়বটা শুধু আন্দাজ করতে পারছিল সুব্রত। তাতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
অদিতি বলল, ‘ওগো, আমরা আবার একটা খারাপ জায়গায় চলে এসেছি।’
‘মানে?’
‘আজ এ বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।’
‘কেন?’
‘পাশের বাড়িতে অনেকদিন ধরে নাকি মধুচক্র চলে। কলকাতার বেশ কিছু রাঘব বোয়ালের এখানে যাতায়াত। আজ পুলিশ এসে সবকটাকে হাতেনাতে ধরেছে। সব বাচ্চা-বাচ্চা মেয়ে, মা গো। কী নোংরা, কী নোংরা…!’
বলতে বলতে আন্ধকারের বুক চিরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল অদিতি। আকাশটা ভেঙেচুরে গিয়ে উথালপাতাল বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সুব্রত। অনুভূতিহীন। বৃষ্টির ধারাল ফোঁটাগুলি চৌবাচ্চার জলে লাফিয়ে পড়ছে। জমা জলে হুটোপুটি করছে। জলের তরঙ্গে বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। একটার পরে আর-একটা।