ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে অসীমার টনক নড়ল। এক্ষুনি রঞ্জন ওর বন্ধুকে নিয়ে এসে পড়বে। রঞ্জন বারবার বলে গিয়েছিল চা-জলখাবার তৈরি করে রাখতে। অসীমা তড়িঘড়ি চোখ মুছে ঠান্ডা জলের ছিটে দিয়ে রান্নাঘরে গেল। নিজের মুখটা না দেখলেও বুঝতে পারল কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে— জ্বালা করছে। কী যে করবে কিছুই বুঝছে না, সংসারটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল এই ক’মাসে। অসীমা জীবনের নেগেটিভ দিক, অভাব-অস্বচ্ছলতা কোনওদিন দেখেনি। আজ যেন ও মাঝপুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে। খড়কুটোও নেই যা আঁকড়ে ধরবে। বাবার কথা আজ এত বেশি মনে পড়ছে। বাবার জন্যই ব্যাবসায়ী হয়ে ওঠা রঞ্জনের। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল!

‘সীমা… সীমা,’ বলতে বলতে রঞ্জন বাজারের থলে নিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। অসীমা মুখ তুলে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই রঞ্জন অসীমার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। হাতের ব্যাগ নামিয়ে কাছে এসে নিবিড় ভাবে জিজ্ঞাসা করল ‘কী হয়েছে?’ অসীমা ট্রেতে চা-বিস্কুট নিয়ে রঞ্জনকে দিল, ‘আজ আবার সরকারবাবু এসেছিলেন।’

‘কী বললেন? চিৎকার করেননি তো!’

‘না, শুধু বললেন তাড়াতাড়ি ঘরগুলো ছেড়ে দিতে।’ রঞ্জন কিছু না বলে শুকনো মুখে ট্রে নিয়ে বাইরে চলে এল। অসীমা জানিয়ে দিল, ‘একটু বাদেই রুটি তরকারি দিচ্ছি।’ বলল বটে কিন্তু ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। কানের মধ্যে বাড়িওয়ালার কথাগুলোই ধাক্বা দিচ্ছে। এক মাসের মধ্যে ঘর ছেড়ে না দিলে কোর্টের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাবে। রঞ্জনকে তো সব কথা ইচ্ছে করেই বলেনি। মানুষটাকে তো দেখছে, এত চেষ্টা করছে তবু আশার আলো দেখছে কোথায়? বিগত পাঁচ-ছ’মাস ধরে ব্যাবসার ভরাডুবি। মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার উপর বাড়িওয়ালার হুমকি। ‘শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবছেন, আমার ছেলের বিয়ে, ঘর দরকার, তাই ভদ্রভাবে বলছি, উঠে যান।’

অসীমারা গত তিনমাস বাড়িভাড়ার টাকাটাও দিতে পারেনি ঠিকমতো। আসলে রাগটা সেখানেই, তাই বাহানা জুড়ে দিয়েছে। আবার কোর্টের ভয় দেখাচ্ছে। হাতে কাঁচা পয়সা এসেছে তো, তাই গুমরও বেড়ে গেছে সরকারবাবুর। আজ যে সমাজে সরকারবাবু উঠে যাচ্ছে রঞ্জন একদিন সেখানেই ছিল। সরকারবাবুর বখে যাওয়া ছেলেটা হঠাৎ শুরু করেছে প্রোমোটারি ব্যাবসা। একসময়ে সরকারবাবু সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে উপর মহলের সঙ্গে বেশ ভালো যোগাযোগ আছে। তাই ছেলের হয়ে সুপারিশ করাটা সরকারবাবুর কাছে জলভাত। মাত্র কয়েক মাস হল বেশ জমজমাট শুরু করেছে। উঠোনের ওপাশের ঘরটা আর বৈঠকখানা নেই, হয়ে গেছে অফিস ঘর। বড়ো বড়ো করে সাইনবোর্ডে লেখা ‘নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির জন্য যোগাযোগ করুন। প্রোমোটার – সনাতন সরকার। যোগাযোগের সময় সকাল : ১১টা – ৪টা।’

এতদিন অসীমা জানত না সরকারবাবুর ছেলের নাম। এখন সাইনবোর্ডের সুবাদে জেনে গেছে। সেই ছেলের বিয়ে। সরকারবাবুর স্ত্রীকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিল অসীমা। কিন্তু মহিলার বাচনভঙ্গির সামনে অসীমা খুবই অসহায় বোধ করছিল। উপর থেকে নীচে নেমে এসেছিল মাথা হেঁট করে। ঘরে এসে কেঁদে ফেলেছিল, আবার আপশোশও হয়েছিল রঞ্জনকে না বলে উপরে বাড়িওয়ালার কাছে গিয়েছিল আর্জি জানাতে। মাত্র কয়েক মাস আগেও অসীমারও তখন বোধহয় এখনকার মতো ছিল না। পতি গরবে গরবিনি ছিল সে। কী যে হল।

দশবছর আগে সে যখন নতুন বউ হয়ে শ্বশুড়বাড়িতে এল তখন শুধু দু’চোখে স্বপ্ন। বড়োলোক ঘরের মেয়ে অসীমা। বাবার আদুরে মেয়ের আবদারে সবাই অস্থির। সেই অসীমা এল শ্বশুরঘর করতে। তুলনায় রঞ্জন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। অসীমাদের মতন বড়োলোকি ব্যাপার না থাকলেও সম্পন্ন গৃহস্থ যৌথ পরিবার ছিল রঞ্জনদের। দুপক্ষই জানত অসীমা-রঞ্জনের মেলামেশার কথা। আপত্তি থাকলেও উভয়পক্ষই রাজি হয়েছিল এ বিয়েতে। রঞ্জনের মা-বাবা, দাদা-বউদির মনে ছিল একরাশ দ্বিধা। পারবে তো অত বড়ো ঘরের মেয়ে এই সাধারণ ঘরে এসে মানিয়ে নিতে। অসীমাকে নিয়ে রঞ্জন যেদিন প্রথম তার মায়ের কাছে এসেছিল, সেদিনটা অসীমার আজও মনে আছে। রঞ্জনের মাকে প্রণাম করতে গিয়ে উনি সহাস্যে বলেছিলেন ‘বসো মা, এই ছোট্ট ঘরে তোমায় স্বাগত জানাই। বাড়িটা তোমাদের মতো বড়ো নয় কিন্তু আমাদের সকলের মন অনেক বড়ো, তোমার এখানে থাকতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু আদর-ভালোবাসায় কোনও খামতি হবে না।’

এই কথা শুনে অসীমা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। এমনভাবে কেউ তো বলেনি। তার দুচোখে তখন রঙিন স্বপ্ন-উচ্চাশা। রঞ্জন যেন অতিরঞ্জিত হয়ে তার জীবনে ছড়িয়ে-মাখিয়ে আছে। অসীমা, রঞ্জনের মাকে মৃদু স্বরে জানিয়েছিল, ‘এই ছোট্ট ঘর-বাড়িই হবে তার সোনার সংসার।’

কোথায় গেল তার সোনার সংসার, স্বপ্ন! সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওই ছোটো বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই তার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। স্বামীর বাঁধাধরা চাকরি। বাঁধাধরা সময়। অসীমা ব্যবসায়ীর মেয়ে। বাবা-কাকা, খুড়তুতো ভাইদের সচ্ছলতা দেখতেই অভ্যস্ত। গোনা টাকায় কোনওদিন জীবনযাপন করেনি সে। সারাদিনই বাড়ি জমজমাট। সকালে বাবা-জেঠু কারখানায় যায় তো দুপুরে বাড়ি আসে, ওই সময় দুই দাদা আর কাকা যায়। বাবা-জেঠু সারাটা দুপুর বাড়িতে ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা দিয়ে আবার বিকেল চারটের চা-পর্ব চুকিয়ে বের হয়। দাদা-কাকারা মর্জি মতো বাড়ি আসে। আড্ডা মারে, কারুর জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। কিংবা বাড়িতে অতিথি এলে কারখানা-দোকান যেখানে হোক ফোন করলে কেউ না কেউ এসে হাজির, এভাবেই বড়ো হয়েছে অসীমা।

এখানে রঞ্জন সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই নাকেমুখে গুঁজে অফিস ছোটে। বাড়ি আসতে সেই সন্ধ্যা। যতই বাড়িতে জা-শাশুড়ি থাকুক, ভালো লাগে না অসীমার। রাতে রঞ্জনকে এ নিয়ে অভিযোগ জানালে রঞ্জন হেসে বলে, ‘সীমা, আমরা প্রায় পাঁচ বছর মেলামেশা করে তবেই বিয়ে করেছি, তুমি জানো আমার কাজের ধারা। অফিসের পর তুমি আমি এক জায়গায় মিট করতাম তারপর সারা সন্ধ্যা হইচই করে কাটিয়ে তোমায় বাড়ি দিয়ে আমি ফিরতাম। এখন সারারাত তুমি আমার কাছে, তবু তোমার আক্ষেপ। প্লিজ অবুঝ হয়ো না। এটাই তো জীবন, আমরা সবাই পরিবারবদ্ধ হয়ে বাস করি, চাকরিজীবী।’ অসীমা কিছুই বলার সুযোগ পায় না কিন্তু তার মন মানে না।

অসীমার বাবা এ বাড়িতে এলে প্রায়শই রঞ্জনকে ব্যাবসা করার কথা বলেন। অসীমার নামে যে মোটা অঙ্কের ফিক্স ডিপোজিট আছে তা থেকে লোন নিয়ে, ব্যাবসা শুরু করতে বলেন। কিন্তু রঞ্জনের তাতে সায় নেই। তার এক বোনের বিয়ে হয়নি এখনও। অসীমার সবসময় ভয় করত যদি রঞ্জন ওই টাকাটা চেয়ে বসে বোনের বিয়ের জন্য। বাবা-মায়ের প্ররোচনায় অসীমা বারবার বলত রঞ্জনকে ব্যাবসা করার জন্য। শ্বশুরবাড়ি গেলে শালারাও সবাই বোঝাত রঞ্জনকে ব্যাবসার পজিটিভ দিকগুলো। সকলের তাড়নাতেই বোধহয় রঞ্জন ব্যাবসা করা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সাথিও পেয়ে গেল ললিতকে। শ্বশুরমশাই কাপড়ের ব্যাবসায়ী। তাই কাপড়ের ব্যাবসা করাই সুবিধা। এমন ভাবনা চিন্তা নিয়েই ললিত-রঞ্জন শুরু করল কাপড়ের ব্যাবসা। মাঝারি মাপের একটা দোকান-ঘর ভাড়া নিল বড়ো রাস্তার উপরেই। মাস ছয়েকের মধ্যে রঞ্জন ইস্তফা দিল চাকরিতে। বাড়িতে সবাই ব্যাবসাটাকে খুব একটা ভালোভাবে না নিলেও কিছু বলল না।

অসীমার নিস্তেজভাব উধাও। সেই আবার ছটফটে হইচই করা, ননদের সাথে আড্ডা। যেমনটি ছিল বিয়ের পরপরই। রঞ্জনও বেশ খুশি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে অনেক ইচ্ছাই মনের কোণে চেপে রাখতে হয়। খুব শখ ছিল বাড়ির জন্য একট ফোর-হুইলার থাকবে। সে শখ পূর্ণ হয়নি। শখ ছিল মাকে, বাবাকে, বাড়ির সবাইকে নিয়ে সন্ধে হলে মাঝেমধ্যে লং ড্রাইভে যাবে। দারুণ জমজমাটি পরিবার হবে তাদের। পরিবারটা রঞ্জনদের জমজমাটি কিন্তু সাধ আর সাধ্য এক হয়ে ওঠেনি। এজন্য অবশ্য আক্ষেপ নেই। কাপড়ের ব্যাবসা শুরুর ঠিক দেড়বছরের মাথায় রঞ্জন এক্সপোর্ট পারমিট পেয়ে গেল। বাড়িতে বাবাকে বলতে খুব খুশি। তিনিই মনে করিয়ে দিলেন, ‘তোমার বোনের বিয়ের গুরুদায়িত্ব কিন্তু তোমার। তুমি ব্যাবসা করছ, দাদা চাকরিজীবী। তাই এখন তোমার ওপর আমার, দাদার অনেকটাই ভরসা।’

শ্বশুর মশাইয়ের এই ধরনের আশাভরসার কথা অসীমার মন কিন্তু সোজাভাবে নিল না। সে চেয়েছিল ব্যাবসার প্রথম লাভের টাকাটায় রঞ্জন একটা গাড়ি কিনুক। ইনস্টলমেন্টে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শ্বশুর মশাইয়ের কথায় যেন অসীমার বাড়া ভাতে ছাই পড়ল। সে চাইল সবাই যা টাকা দেবে, তার স্বামীও তাই দেবে। এই নিয়ে অশান্তি। রঞ্জন বাবা-দাদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে গেলে এক ঝটকায় অসীমা থামাল তাকে, ‘কার পয়সায়, কার সাহায্যে ব্যাবসা করছ? আমার এফডি, বাবার যোগাযোগ না থাকলে তুমি পারতে আজ এমন কাজ করতে?’

অসীমার গলার স্বর বেশ উঁচু পর্দায় ছিল। ভাসুর-শ্বশুর সবই শুনতে পেল। তারাই রঞ্জনকে আলাদা ডেকে এনে কি পরামর্শ দিল কে জানে, একমাসের মধ্যে হঠাৎই রঞ্জন বাড়ি বদল করল, উঠে এল ভাড়া বাড়িতে। অসীমা খুবই অবাক হয়েছিল, বিরক্তও। কেন রঞ্জন বাড়ি বদল করছে এবং ভাড়াবাড়িতে যাচ্ছে এ নিয়ে বহু বার জিজ্ঞাসা করলেও কোনও সদুত্তর পায়নি। নিজেদের বাড়ি, নিজেদের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে যেতে অসীমার যথেষ্ট আপত্তি ছিল কিন্তু রঞ্জনের কঠিন মুখ, কঠোর ব্যবহার, অসীমার কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল, এ রঞ্জনকে সে চেনে না। সে চুপচাপ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল। আসার সময় সবাই প্রাণহীন পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিল। অসীমা-রঞ্জন আলাদা ভাড়া বাড়িতে উঠে এল। রঞ্জনের জন্যই অসীমা ভাড়া বাড়িতে এসে স্বপ্ন দেখত নিজেদের বাড়ির। রঞ্জনের পরিবারের অন্যান্য লোকেরা কষ্ট পেয়েছিল অসীমার আচরণে। রঞ্জনের মা কিছু বুঝতে না পেরে অসীমাকে বলেছিলেন, ‘ছোটো বাড়ি মা, একদিন এতটা ছোটো মনে হবে না। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। একটা ঘর ফাঁকা। তোমার যদি মনে হয় তুমি ওই ঘরটাও ব্যবহার করতে পারো। এভাবে চলে যেও না। সবাই একসঙ্গে থাকো, আনন্দে থাকো।’ কিন্তু অসীমা তখন অন্য জগতের মানুষ। দর্পে মাটিতে পা পড়ছে না।

অসীমা-রঞ্জন আলাদা সংসার পাতল। নতুন ভাড়া বাড়িতে যাওয়ার তিন-চার মাসের মধ্যে অসীমার বাবার স্ট্রোক হল। বাবা প্রতিমাসে মেয়েকে একটা থোক টাকা দিতেন, সেটা ঝপ করে বন্ধ হয়ে গেল। অসীমা মানিয়ে নিল, রঞ্জনের টাকাতেও তাদের দুজনের সংসার হেসেখেলে চলে যাচ্ছিল। রঞ্জন মা-বাবাকেও প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিল। ওনারা সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সে যাই হোক, রঞ্জন-ললিত মিলেমিশে উদ্যোগী হয়ে কাপড়ের ব্যাবসাটা ভালোই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে দুই বন্ধু নিজেদের পরিবার নিয়ে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, ডিনার করা। বেশ কাটছিল। ললিতের মেয়েটা দারুণ ছটফটে। ললিতের বউ মেধা। বেশ নরম স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু রঞ্জনের কথা অনুযায়ী খুব বুদ্ধিমতি ও হিসেবি। অসীমা নিজে বিএ পাশ। তাই প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল। মেধা বেশিদূর পড়েনি, স্কুলের গন্ডিও পেরোয়নি। একসাথে মেলামেশায় মেধা বুঝতে পারত অসীমা খুব অহংকারী। তবু অল্প সময়ের জন্য একসঙ্গে থাকা তাই খুব পছন্দের না হলেও মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত হাসি মুখে। এই বন্ধু জায়াকে রঞ্জন কিন্তু বেশ পছন্দ করত।

রঞ্জন-ললিতের ব্যাবসা বেশ তরতর করে এগিয়ে চলছিল। কারও জীবনে কোনও ছন্দপতন নেই। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে একসময় সব কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। দোকানটা সাধারণত সামলাত রঞ্জন। ললিত যেত অর্ডার আনতে। টাকা আনতে। এমনই কোনও একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক বিদেশি অর্ডার নিয়ে মনের আনন্দে স্কুটারে দোকানের দিকে আসছিল। হঠাৎ একটা ট্রাক ব্রেকফেল করে ললিতের স্কুটার আর একটা গাড়িকে পুরো পিষে দিয়ে ধাক্বা মারল দেয়ালে।

মেধার কান্না, বিলাপ খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রঞ্জনের কান্নাও যে চোখে দেখা যায় না। বন্ধুর জন্য এত হাহাকার। বারবার একই কথা, ‘ললিত, তুই প্রমিস করেছিলি দুজনে একসঙ্গে থাকব, পাশাপাশি বাড়ি বানাব, দুজনে ছোটো দুটো গাড়ি কিনব সব মিথ্যে, তুই মিথ্যুক ললিত। আমায় না বলে তুই চলে যেতে পারলি!’ দোকান বন্ধ করে রঞ্জন চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকে। অসীমা অনেক বোঝায় কিন্তু কিছুই হয় না। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল রঞ্জনের বন্ধুশোক ভুলতে। বাস্তবে ফিরে আসতে গিয়ে প্রথম ধাক্বা খেল রঞ্জনের এক্সপোর্ট বিজনেসে। ললিত যে-অর্ডারটা নিয়ে স্কুটারে আসছিল তা ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল দুসপ্তাহের মধ্যে। তা হয়নি। বিদেশি অর্ডার। অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছে কোম্পানি। বেশ বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল রঞ্জনের। বিদেশিদের কাছে একবার ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেলে পরবর্তী কাজ পাওয়া দুষ্কর। ললিতের কাজের দায়িত্ব এখন একাই বহন করতে হচ্ছে রঞ্জনকে, সে দিশাহারা।

এরপরেই রঞ্জনের ব্যাবসায় শুরু হল শনির দশা। দোকান কর্মচারীদের হাতে দিয়ে সারাদিন বাইরে থাকা। ক্ষতির পর ক্ষতি। লজ্জার মাথা খেয়ে বাবাকেও বলেছিল দোকানে বসার জন্য। উনি রাজি হননি। ফলে যা হবার তা হল। কর্মচারীরা সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দিল অল্প দিনের মধ্যেই। ললিত-রঞ্জনের সংসারে নেমে এল অন্ধকারের ছায়া। দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল।

বেশ বেলা হয়ে গেল, তবু অসীমা বাইরে এসে জলখাবার দিয়ে গেল না। রঞ্জন কয়েকবার হাঁকাহাঁকি করেও সাড়া পেল না, নিজে উঠে ভেতরে গিয়ে অবাক, রান্না ঘরেও নেই। গেল কোথায়! শোবার ঘরে গিয়ে দেখে অসীমা বিছানায়। চোখের কোনে জল, রঞ্জন অসীমার পাশে গিয়ে বসল। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সীমা ওঠো, কখন আমায় আর গোপালকে জলখাবার দেবে। আজ প্রথম ও আমাদের বাড়িতে এসেছে, কী ভাবছে বলোতো। ঠিক আছে তুমি শুয়ে থাকো, আমি আর গোপাল সামনের দোকান থেকে কচুরি-তরকারি খেয়ে নিচ্ছি। তোমার জন্যও নিয়ে আসব।’ হঠাৎ অসীমা রঞ্জনের দিকে ঘুরে বসল, ‘আমি এই বাড়িতে আর থাকব না।’

‘কোথায় যাব? এত অগোছালো অবস্থায় রয়েছি আমরা। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। যে-বাড়ি ছেড়ে মা-বাবাকে দূরে ঠেলে আমরা দুজনে চলে এসেছি, সেখানে কি আর ফিরে যাওয়া যায়!’ রঞ্জন কথাগুলো বলে কপালে হাত দিয়ে নিরাশ ভঙ্গিতে বসে পড়ল। অসীমা বলে, ‘তুমি জানো না,  ছেলেমেয়েরা যতই অন্যায় অবুঝ কাজ করুক না কেন, মা-বাবা দুঃখ পেলেও তাদের কখনওই মন থেকে দূরে ঠেলে না। প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনাই করে। তুমি মা-বাবার কাছে যাও। আমরা ওই বাড়িতেই ফিরে যাব।’

‘তা হয় না সীমা। যেদিন আবার আমার ব্যাবসা ঠিকঠাক চলবে, আমরা হইচই করে সেদিন আবার ও বাড়ি যাব। অসীমা কিছু না বলে একটু মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল। রঞ্জন শুনতে পেল, ‘যার বাড়ি ভাড়া তিন মাস বাকি, সে আবার দোকান চালানোর স্বপ্ন দেখে, বড়ো ব্যবসাদার হবে। কিচ্ছু হবে না।’

রঞ্জন কেমন যেন চুপ মেরে গেল। জীবনের প্রতিকূল সময়ে তার সীমা আজ কোথায় তাকে সাহস জোগাবে তা না, আরও নিরাশ করে দিচ্ছে। রঞ্জনের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। সে তো এমনটা চায়নি। সে অসীমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কত বছরের প্রেম, বড়োলোকের মেয়ে। রঞ্জন সবার সঙ্গে মিলেমিশেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু যেদিন অসীমা একবাড়ি লোকের সামনে উঁচু গলায় টাকার কথা বলেছিল, সেদিনই তো বাবা তাকে ডেকে নিয়ে আড়ালে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘সবার আগে সম্মান, শান্তি। এই বাড়িতে সবাই আমরা শান্তিতে সম্মান নিয়ে বাঁচি। এমন কথা কেউ কোনওদিন বলেনি যাতে অন্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। হ্যাঁ, ঝগড়া হয় তবে তা মনে দাগ কাটার মতন নয়। ওটা তো বাসনে বাসনে ঠোকাঠুকির মতন। কিন্তু আত্মসম্মান বোধে আঘাত দিয়ে কথা এ বাড়িতে কেউ কাউকে বলে না। আজ বউমা যা বলল, তুমি যদি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাও, বউমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাও কারণ ওর দায়িত্ব তোমারই। আমরা তোমার ভালো চাই। তুমি আমাদেরই সন্তান। তোমার মঙ্গল হোক।’ বাবার এই কথার পর রঞ্জন একটা কথাও বলেনি। ও বাড়ি বদল করেছিল।

পরের দিন রঞ্জন সকাল-সকাল উঠে স্নান করে নিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ গোপাল এসে ডাকতেই রঞ্জন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল, অসীমাকে কিছুই বলল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’বন্ধু গেল ব্যাংকে। গোপালের জানাশোনা। গোপাল ছোটোবেলার বন্ধু। যোগাযোগ ছিল না, গত মাসেই হঠাৎ দেখা তারপর কত গল্প, স্মৃতিচারণ, কেউ কাউকে ছাড়তেই চায় না। কথায় কথায় গোপাল জানাল ও কাপড়ের ব্যাবসা করে। সোজাসুজি আহমেদাবাদ থেকে কাপড়ের রিল আনায়, তারপর ব্লিচ করে বিভিন্ন দোকানে রঙিন থান শাড়ির অর্ডার সাপ্লাই করে। বেশ ভালো লাভজনক ব্যাবসা। রঞ্জন ইতস্তত করে গোপালকে তার দুরাবস্থার কথা, ব্যাবসায়ে ক্ষতির কথা জানাল। গোপাল কথা দিয়েছিল রঞ্জনকে সে সাধ্যমতন সাহায্য করবে। এজন্যই তাদের আজ ব্যাংকে আসা।

সকালবেলাই রঞ্জন কোথায় গেল, ভাবতে গিয়ে অসীমার সব কাজে বেশ দেরি হল। চা বানিয়ে নিয়ে বসতে গিয়েই শুনতে পেল দরজায় ধাক্বার শব্দ, সঙ্গে কথা বলারও আওয়াজ। অসীমা বুঝল রঞ্জনের সঙ্গে কেউ আছে কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখল, চমকে গেল, মেধা। ভিতরে আসতে বলল। মেধাকে বেশ রোগা লাগছে, মুখটা শুকনো। অসীমা ওদেরকে চা দিল, মেধা চা নিয়ে অল্প হেসে অসীমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’  অসীমা শুকনো গলায় বলল, ‘দেখতেই পাচ্ছ। থাকা আর না থাকা সমান। নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।’ রঞ্জন দুজনের এই কথোপকথনে মাথা হেঁট করে বসে চা খেতে লাগল। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে রইল।

সবাই চা শেষ করলে অসীমা চায়ের কাপ নিয়ে উঠতে উদ্যোগী হতেই মেধা নীরবতা ভাঙল। ‘ললিত চলে যাওয়াতে শুধু আমরা নই, তোমরাও বেশ অসুবিধার সামনে পড়ে গেছ। মনে হয় সবাই মিলে যদি এই ব্যাবসাটাই আবার অন্যভাবে শুরু করি।’

অসীমা রঞ্জনের দিকে তাকাল। ওরা দুজনেই ভেবেছিল মেধা হয়তো ললিতের ভাগের টাকাটা চাইতে এসেছে। কিন্তু মেধার উদ্দেশ্য শুনে দুজনেই চুপচাপ। মেধা আবার বলতে শুরু করল, ‘নিজের খরচ কমালেও বাচ্চাটার খরচ তো কমানো যায় না। তাই ভাবছি আমার তো তিনটে ঘর, যদি একটা ঘরে একজন সেলাই জানা লোক রেখে কাজ করাই আর কাঁচামাল তো রঞ্জনদাই আনবে, তাহলে বোধহয় দুটো সংসারেই সাশ্রয় হবে।’ রঞ্জন বা অসীমা কেউ-ই মেধাদের কথা ভাবেনি। নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু মেধার চিন্তা ভাবনা ওদের দুজনের মাথা হেঁট করিয়ে দিল। গোপালের সঙ্গে ব্যাংকে গিয়ে মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়েছে। তাছাড়া গোপালও বলেছে যদি যৌথ ব্যাবসায় উদ্যোগী হয় তারা দুজনে মিলে। মেধার ভাবনাচিন্তা রঞ্জনকে আরও বেশি উসকে দিল কাপড়ের ব্যাবসার দিকে। রঞ্জন-গোপাল-মেধা আর যদি অসীমাও তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এই কাজে তাহলে আর বাইরে থেকে লোক রাখতে হয় না। কথামতন কাজ, রঞ্জনের উৎসাহ সব থেকে বেশি। রঞ্জন হঠাৎই ভাবল, কেন অসীমা এমনভাবে ভাবল না! মেধা ললিতের পথে হাঁটতে অর্থাৎ ব্যাবসা করতেই আগ্রহী। আর অসীমা, উৎসাহ তো দেয়ই না উলটে রাগ ঝগড়া। রঞ্জনের মধ্যে এক দোলাচল শুরু হয়। মেধা জানে, ভালোবাসা মানে সবসময় পাশে পাশে সশরীরে থাকতে হবে তার কোনও মানে নেই। তার অবর্তমানেও তারই ধ্যানধারণা নিয়ে চলাই ভালোবাসা। জীবনের সঠিক জীবনসঙ্গী সে-ই, যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ললিত আজ নেই তবু মেধা চলতে চাইছে ললিতেরই স্বপ্নকে বাস্তব করতে।

রঞ্জন মেধাকে বলল, ‘অসীমাও তোমার সঙ্গে কাজের দেখভাল করবে। তিনজনে মিলে আর গোপালের সাহায্যে আমরা আগের মতন গড়ে তুলব। আমাদের ব্যাবসা ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।’ তাকিয়ে দেখল অসীমা হাসছে, চোখে জল।

অসীমা এতদিনে বুঝতে পারল শুধু টাকা-সম্পত্তি জীবনের শেষ কথা নয়। মানুষের জন্য মানুষের এগিয়ে আসা, দুঃসময়ে তার পাশে থাকা, মানবিকতার হাত এগিয়ে দেওয়াতেই চরম সুখ। অল্পশিক্ষিত মেধার যে সহজাত বুদ্ধি ও তৎপরতা আছে, কলেজ পাঠ শেষ করা অসীমার মধ্যে সেই বোধের অস্তিত্ব ছিল না এতদিন। অসীমা আজ নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...