শৈশব বড়ো মায়াময়। ওদের ছোট্ট হাতের স্পর্শে জাগে অনন্য অনুভূতি। আধো-আধো বোল বড়োই শ্রুতিমধুর। অমলিন মুখের হাসি বড়োই তৃপ্তিদায়ক। ওদের সান্নিধ্য জীবনের সব দুঃখ মোচন করে। অবশ্য এসবের বিনিময়ে নিষ্পাপ শিশুরাও নিজেদের অজান্তেই কিছু চায় মা-বাবার কাছে। পার্থিব জিনিসের পাশাপাশি, ওরা চায় ভালোবাসা, নিরাপত্তা, সুশিক্ষা আর স্বাধীনতা। কিন্তু ওরা সকলেই কি সবকিছু পায়? পায় না। যে পায় সে সুন্দরভাবে বিকশিত হয়। আর যে পায় না, সে পরিবারের, সমাজের, দেশের তথা সারা পৃথিবীর কাছে ‘বোঝা’ হয়ে দাঁড়ায়।
আসলে অবিবেচক মা-বাবা সন্তানের শৈশবেই যদি তার প্রতি অবিচার শুরু করেন, তাহলে ভষ্যিতে এর কুফল ভোগ করতে হয় সবাইকেই। অতএব সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য এবং মা-বাবা হিসাবে ভবিষ্যতে গর্ববোধ করার জন্য, সন্তানের শৈশবের ভিতকেও শক্ত করতে হবে। কিন্তু তা করেন না অনেকেই। এ কথা যেন বুঝেও বোঝেন না যে, বর্তমান যুগের বাচ্চারা বয়সের তুলনায় সব বিষয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। পারিপার্শ্বিক চাপে তাদের শৈশব চুরি হয়ে যাচ্ছে। যখন তাদের হেসেখেলে বেড়ানোর সময়, তখনই তাদের পিঠে বইয়ের বোঝা। বাবা-মায়ের প্রবল চাপ– ‘তোমাকে প্রথম হতেই হবে।’ শুধু লেখাপড়াই নয়, বাচ্চার আগ্রহ থাক বা না-থাক, নাচ, গান, বাজনা, ছবি আঁকা, ক্রিকেট, ফুটবল-সব ক্ষেত্রেই যেন পারদর্শী হয়ে ওঠে সন্তান– এমনটাই চান অভিভাবকরা। এ তো নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছে সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। এখন তো আবার বাচ্চাদের টিভি-স্টার বানানোর হিড়িক চলছে। রিয়ালিটি শো-এ অংশ নিতে পাঠিয়ে মা-বাবারা গর্বিত হচ্ছেন। অথচ মজার বিষয় হল, ওইসব রিয়ালিটি শো-এ কোনও রিয়ালিটি নেই। হার-জিত, হাসি-কান্না সবই পূর্বপরিকল্পিত এবং সাজানো, যা শিশুমনে কু-প্রভাব ফেলতে বাধ্য। ক্ষতি হচ্ছে লেখাপড়ারও। তাই শুরু থেকেই কয়েকটি বিষেয়ে সতর্ক হওয়া ভালো।
কম বয়সে বাড়তি বোঝা
– বয়সের তুলনায় বাচ্চাদের লেখাপড়ার চাপ এখন অনেক বেশি। তার উপর আছে রিয়ালিটি শো-এ অংশ নেওয়ার হাতছানি। অভিভাবকরাও অবিবেচকের মতো সন্তানের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন এই বাড়তি বোঝা।
– শৈশবের স্বাভাবিক আচার-আচরণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কচিকাঁচারা। এরজন্য দায়ী বাচ্চাদের অভিভাবকরা এবং টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত রিয়ালিটি-শো কর্তৃপক্ষ। কারণ রিয়ালিটি শো-গুলিতে বয়সের তুলনায় বেশি চটকদারি কথা বলানো হচ্ছে বাচ্চাদের দিয়ে এবং শিশুমনে এর কু-প্রভাবও পড়ছে। আর এসব জেনেশুনেও যে-সব অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ওইসব শো-এ অংশ নিতে বাধ্য করছেন, তারা পরবর্তী সময়ে এর খারাপ ফলও ভোগ করছেন।
– শিক্ষাক্ষেত্রের মতো অন্যান্য গুণপনায় প্রতিভাবিকাশের ক্ষেত্রেও প্রবল প্রতিযোগিতার মনোভাব এসে যাচ্ছে বাচ্চাদের। ‘তোমাকে প্রথম হতেই হবে’: সন্তানের উপর অভিভাবকদের এমন চাপ ব্যাপক ক্ষতি করছে বাচ্চাদের।
বাচ্চাদের মানসিক সমস্যা
– খুব ছোটোবেলায় যদি হাতে টাকা (পারিশ্রমিক) এসে যায়, তাহলে বড়ো হয়ে উপার্জনের মেশিনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে সুকুমার বৃত্তিগুলি নষ্ট হতে থাকে।
– ছোটোরা যদি হঠাৎই স্টার হয়ে ওঠে, আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করে সমাদর পেতে শুরু করে, তখন ওদের মনে অহংকারের জন্ম হয়।
– লেখাপড়ার চাপ যদি প্রতিভা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, বাচ্চারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
– প্রতিযোগিতায় অসাফল্যের রেশ থেকে যায় মনে। আর সফল হলে, অসফল বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে পারে না। ফলে একাকিত্বে ভোগে বাচ্চারা।
– বাচ্চাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কিছু করতে বাধ্য করলে ওদের মনে রাগ এবং অবসাদ তৈরি হয়, যা মোটেই শুভ ফলদায়ক নয়।
জরুরি পরামর্শ
– বাচ্চারাই দেশের ভবিষ্যত। তাই তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে সাহায্য করতে হবে। বাড়তি বোঝা চাপিয়ে শৈশব ‘চুরি’ হতে দেওয়া যাবে না।
– বয়সে ছোটো হলেও, ওদের ইচ্ছে অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য শখ পূরণে স্বাধীনতা দিতে হবে বাচ্চাদের।
– মা-বাবার অপূর্ণ ইচ্ছে সন্তানের মাধ্যমে পূরণ না করাই ভালো। এতে হিতে বিপরীত হবে।
– বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া, মারামারি কিংবা জটিল কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন না। ওদের সামনে যতটা সম্ভব আনন্দে থাকার এবং ওদের আনন্দে রাখার চেষ্টা করুন।
– হিংসা কিংবা প্রতিযোগিতার প্রবল মনোভাব যেন তৈরি না হয় বাচ্চাদের মনে।
– বাচ্চাদের আচার-আচরণ, গতিবিধি নজরে রাখতে হবে। ওদের মন কোনওভাবে যাতে কলুষিত না হয় সে বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
– ক্যুইজ কিংবা শিক্ষামূলক শো ছাড়া, বাচ্চাদের টিভি দেখার নেশা বন্ধ করাতে হবে।
– লেখাপড়ার কারণে বাচ্চাদের খেলাধুলো থেকে বঞ্চিত করবেন না, কারণ শরীর ও মন ভালো রাখতে খেলাধুলোরও প্রয়োজন আছে।
– উপযুক্ত শিক্ষার পাশাপাশি, পুষ্টিজাতীয় খাবারও দিতে হবে বাচ্চাদের। এতে ওরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে।
– শ্রদ্ধা, সততা, কর্মনিষ্ঠতা, দায়িত্ববোধ এবং মানবিক মূল্যবোধের বিষয়েও সু-শিক্ষিত করে তুলতে হবে একেবারে কুঁড়ি অবস্থা থেকেই।