সুরের ঝরনাধারায় মন ভরিয়ে দিয়ে দেয়ালঘড়ি জানিয়ে দিল সাড়ে চারটে বাজে। ফাইলে ডুবে থাকা পল্লব, মুখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। কুশলের আসার সময় হল। স্টোরের চাবি জমা দিয়ে সে ক্লাসরুমের জানলা-দরজা বন্ধ করবে তারপর ওয়ার্কশপের গেটে তালা লাগাবার মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে পল্লব, রওনা দেবে ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটবাড়ি সুঠাম আবাসন-এর দিকে।

আর মাত্র ষোলোটা মাস বাকি। তারপর এই চেয়ার-টেবিল এইসব ফাইলপত্রের ভার ইন্সট্রাকটর নবীনকে সমর্পণ করে তার ছুটি। ফোরম্যানের ভূমিকায় সমস্ত কর্তব্য পালন করলেও তাকে ফোরম্যান করা হয়নি। এই ঝঞ্ঝাট সামলানোর দায় আর তার থাকবে না। শুনতে হবে না প্রিন্সিপাল বলরাম বোসের অসূয়াযুক্ত কটূক্তি- টেবিলের ফাইলে ডুবে করোটা কী! তুমি তো বসে বসে কবিতা-গল্প লিখে লিখে পাঠাও তারপর প্রিন্টেড কপি এনে অফিস স্টাফদের পড়িয়ে বাহবা কুড়োবার চেষ্টা করো। বেতনের টাকাটা তো গুনে গুনে নাও অথচ কাজের কাজ কিছুই হয় না!

অবশ্য এই কটূক্তিতেই থেমে থাকেননি তিনি। তাঁর টেবিলের সমকোণে ছিল বহুদিনের পুরোনো ফোরম্যানের টেবিল, সেটিও ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরা ওই বলরাম বোসের সমর্থনে দখল করে নিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রের সূত্রপাত হয়েছিল অনেক আগেই। তবে সেই যুদ্ধে জিতে মাথা উঁচু করে সে যে বিদায় নিতে পারছে, এইটুকুই তার চাকুরি জীবনের সবচেয়ে বড়ো অ্যাচিভমেন্ট।

তার স্ত্রী সঞ্চারি বলেছিল, তোমার নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে অস্ত্র করে লড়াই করছ তুমি! অভিমন্যুর মতো তোমায় সপ্তরথী ঘিরে ধরলেও তুমি তাদের হারিয়ে ঠিক বেরিয়ে আসতে পারবে। একদিন তারাই হাতে হাত মেলাতে ছুটে আসবে, মিলিয়ে নিও! সেই ঘটনাই ঘটে চলছে এই সময়, কেউ এসে আবার তার বুক পকেটে গোলাপও গুঁজে দিয়েছে।

ডক্টর বি সি সেন ছিলেন দূরদর্শী মানুষ। হিজলপুরের কুড়ি বিঘা জমিতে সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে ষাটের দশকের শুরুতেই তিনি তৈরি করেছিলেন এই ব্রাইট বয়েজ আকাদেমি। আবার পঠন-পাঠনের সঙ্গে কারিগরি প্রশিক্ষণের চিন্তাভাবনাও তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তখন কারিগরি প্রশিক্ষণও খুব প্রযোজন হয়ে পড়েছিল। তাই ওই একই জমিতে সরকারি অনুমোদনক্রমে ব্রাইট বয়েজ টেকনিক্যাল সেকশন গড়ে উঠেছিল। কুড়িজন ছাত্রের প্রশিক্ষণের জন্য ফোরম্যান, ইন্সট্রাকটর-সহ দশজন স্টাফ নিয়োগের অনুমতি মিলেছিল সেই সময়ে। চালু হয়েছিল একবছরের ফিটিং-কার্পেন্টরি কম্বাইন্ড কোর্স।

পল্লব যখন ইন্সট্রাকটর পোস্টে ইন্টারভিউ কাম টেকনিক্যাল স্কিল টেস্টে ডাক পেয়ে আসে, তখন তার প্রতিযোগী ছিল ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরার ভাই শ্রীনাথ হাজরা। ছিল আরও বারোজন প্রতিযোগী। অবশেষে শেষ হাসি হেসেছিল পল্লব। শ্রীনাথ হাজরা দাঁড়াতেই পারেনি, ক্লিন বোল্ড হয়ে ফিরে গিয়েছিল। তাই পল্লবকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না ভূতনাথ। গোটা ব্রাইট বয়েজ আকাদেমির বেশ কিছু স্টাফের মন ক্রমে ক্রমে বিষিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

পঁচিশ বছর আগে যখন পল্লব ইন্সট্রাকটরের চাকরিতে যোগ দিয়েছিল, তখন ফোরম্যান ছিলেন শিরীষ বোস। ভদ্রলোক ছিলেন অকৃতদার, হাসিখুশি অথচ সেই মানুষটা যে ভয়ানক সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-এ ভোগেন এই বছর সেপ্টেম্বরের টিচার্স ডে পালনের আগে পর্যন্ত পল্লব বুঝতেই পারেনি। ততদিনে যাদের সঙ্গে তার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তারা সবাই তার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিল। তাদেরই অনুরোধে সেই বছর টিচার্স ডে উপলক্ষে পল্লব প্রথম কবিতা পাঠের সুযোগ পায় আর তারপরই শিরীষ বোসের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে।

তখন চাকরির সবেমাত্র এক বছর পূর্ণ হয়েছে, আরও এক বছর পার হলে তার প্রবেশন পিরিয়ড শেষ হবে। তবেই স্থাযী পদে নিযুক্ত হবে সে। টেকনিক্যাল সেকশনের ফিটিং-শপের সামনে একটি ছ’ফুট বাই বারোফুটের টেবিলে পুরো ব্রাইট বয়েজ আকাদেমির মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এক নামি শিল্পী। মিড-ডে মিলের ঘর, খেলার মাঠ, ছোটো ছোটো জলাশয়, কারিগরি প্রশিক্ষণ ভবন, বিদ্যালয় ভবন, লাইব্রেরি– সব মিলিয়ে আকাদেমির পুরো চিত্রটা সেই টেবিলে উপস্থিত ছিল। তখন অবশ্য মিড-ডে মিল রুম না বলে টিফিন রুম বলা হতো।

শিক্ষক দিবস পার হওয়ার দু’-তিনদিন পর একদিন ফোরম্যান বোস বলে বসলেন, শোনো পল্লব, এই টেবিলের নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে ড্রিল করা আছে, যেমন ধরো টিফিন রুম, প্লে-গ্রাউন্ড, স্কুল বিল্ডিং এইসব আর কী! প্রত্যেক ড্রিলড হোলের মধ্যে তার গলিয়ে হোল্ডার পরিয়ে পুরো টেবিলটার নীচে ইলেকট্রিক ওয়্যারিং কমপ্লিট করে রাখবে তুমি, বুঝেছো নিশ্চয়ই?

পল্লবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ইলেকট্রিক সার্কিট সম্বন্ধে সে অভিজ্ঞ নয় তাই বলল, সে কী! আমি তো মেকানিক্যাল গ্রুপের, ওয়্যারিং করিনি কখনও! আমাদের তো একজন ইলেকট্রিশিয়ান আছেনই, আমি বরং তাঁকে সাহায্য করব। নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল পল্লব।

—টুনি-বাল্ব, সুইচ-বোর্ড সে লাগাবে, ফিনিশিং টাচ দেবে সে। ইনিশিয়াল ওয়্যারিং কমপ্লিট করবে তুমি।

—কিন্তু আমার থিওরি, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলোও তো রয়েছে!

—তার বাইরে অনেক সময় পাও তুমি! অফ পিরিয়ডে কবিতা না লিখে কাজ করে দেখাও দেখি! তারপর রীতিমতো হুমকির সুরে বলেছিলেন, এখনও প্রবেশন পিরিয়ড কাটতে গোটা একটা বছর বাকি, জানো তো নিশ্চয়ই!

ততক্ষণে কারণটা প্রাঞ্জল হয়ে গেছে পল্লবের কাছে। সে বুঝতে পারল টিচার্স ডে উপলক্ষে তার কবিতার প্রশংসার পুরস্কার হিসেবে, তার জন্য এই বংশদণ্ডের ব্যবস্থা করেছেন বোস। শাস্তি হিসেবে টেবিলের তলায় ঢুকে মশার কামড় খাওয়ানোটাকেই উপযুক্ত মনে করেছিলেন তিনি।

স্টোরকিপার মনোজ দাসকে পল্লব মনাদা নামেই ডাকত। ওয়্যারিং-এর প্রাক্কালে স্টোর থেকে এনে হ্যামার, স্ক্রু-ড্রাইভার, সোল্ডারিং আয়রন এসব টেবিলের নীচে সাপ্লাই দিত সে। চটাস-পটাস শব্দে মশা মারতে মারতে বাধ্য হয়ে ওয়্যারিং-এর কাজ করতে হতো পল্লবকে। একদিন তার মনাদা ফাঁকা পেয়ে বলল, এসব বাঁজা লোকেদের নিজেদেরই ঠিক নেই আবার অন্যের বিচার করে!

—মানে! কৌতূহলের দৃষ্টিতে পল্লব তাকিয়েছিল তার মনাদা-র দিকে।

—মানে বুঝলে না তো! এই যে চাকরি পেয়ে বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিয়ে-থা সেরে ফেললে বোসের চোখ টাটাবে না!

—কিন্তু ফোরম্যান উনি! মোটা মাইনের চাকরি করেন, বিয়ে করেননি কেন?

—আরে বাঁজা তো!

—সে আবার কী! মেয়েদের ছেলেমেয়ে না হলেই তো বাঁজা বলে!

—দূর কিছুই জানো না তুমি! ছেলেদেরও দোষ থাকলে ছেলেপুলে হয় না। মেয়েরা এদের বিয়ে করে সুখী হয় না। ডিভোর্স হয়ে যায়, দ্যাখোনি! ওই বোসেরও সেই দোষ আছে। ও হল গিয়ে বাঁজা ব্যাটাছেলে! তাই ভয়ে বিয়ে করেনি।

যে-চার বছর শিরীষ বোস ছিলেন, তাকে খুব জ্বালাতন করেছিলেন। ডক্টর স্নেলের সূত্র উদ্ধৃত করে একটা দৃষ্টিশক্তির চার্ট বানিয়েছিল পল্লব। শিরীষ বোস সেটিকে দেখেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, সূত্র ধরে চার্ট হয়! এই লেখাপড়া শিখেছ!

তিনি তাঁর ইচ্ছামতো চার্ট-পোস্টার লাগাতেন ওয়ার্কশপের বিভিন্ন জায়গায়। তাঁর রিটায়ারমেন্টের পর পল্লব যখন দায়িত্ব নিল, সেও বোসের লাগানো সমস্ত কিছু দূর করে দিয়ে নিজের মতো করে শপফ্লোরের দেয়াল সাজিয়ে তুলল।

শিরীষ বোস বিদায় নিলেও ভূতনাথ হাজরার হাতে তখনও বেশ কিছুকাল সময় ছিল। নতুন প্রিন্সিপাল হলেন বলরাম বোস। ভূতনাথ তাঁর কান ভারী করা শুরু করে দিলেন।

এদিকে আর এক বিপত্তি শুরু হল। ফিটিং-কার্পেন্টরির এক বছরের কম্বাইন্ড কোর্সটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অফিস থেকে শুরু করে অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আর মান্যতা দিতে অস্বীকার করল। প্লেসমেন্ট অফিসার চঞ্চল তালুকদার দেখলেন ভারি মজা! তিনি প্রিন্সিপালকে জানিয়ে দিলেন— এই কোর্সের কোনও ভ্যালিডিটি নেই। খোলনলচে বদলাতে হবে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ভোকেশনাল ট্রেনিং বা এনসিভিটি-র অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন কোর্স চালু না হলে, এই কোর্স চালিয়ে কোনও লাভ হবে না। ছেলেরা চাকরি পাবে না। আমারও কিছু করার নেই।

চাকরির সুযোগ কমে যেতেই ছাত্রের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করল। কুড়ি থেকে কমে কমে চার-পাঁচজনে এসে ঠেকল। চতুর্দিকে সমালোচনার ঝড় উঠতে লাগল। অবশ্য আড়ালে ছিল ভাইস-প্রিন্সিপাল ভূতনাথ হাজরার উসকানি। চার-পাঁচজন ছাত্রের জন্য দশজন স্টাফ। নড়ে-চড়ে বসল রাজ্য-প্রশাসন। মিড-ডে মিল থেকে শুরু করে সবরকম সুযোগ-সুবিধে কমতে শুরু করল। ছাত্রদের সঙ্গেও ঠাট্টা-তামাশা শুরু হল। তাদের নাম দেওয়া হল কম্বাইন্ড। স্কুলে প্রার্থনার সময় অতি উৎসাহী এক শিক্ষক বলে ফেললেন, কেউ আছো কম্বাইন্ড?

তিনজন ছাত্র সেদিন উপস্থিত ছিল। তারা হাত তুলতেই হেসে তিনি বললেন, এই তো কম্বাইন্ড আছে এখনও, একেবারে নিল হয়ে যায়নি!

মিড-ডে মিল খেতে গিয়ে একটি ছাত্র দু’-হাতা ভাত বেশি চেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, কী করতে এই মরা কোর্সটা করতে যে আসিস তোরা, বুঝি না! নে খেয়েদেয়ে বছরটা কাটিয়ে দে। তারপর তো সেই বাড়িতেই বসে থাকবি।

যে-নদী হারিয়ে পথ চলিতে না পারে… দশম শ্রেণিতে পড়া সেই ভাবসম্প্রসারণটাই মনে পড়ে যায় পল্লবের। কলকাতার সল্টলেকের কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে যোগাযোগ শুরু করে পল্লব। তখন অবশ্য নতুন প্রিন্সিপাল বলরাম বোস সাহায্য করেছিলেন তাকে, কিন্তু সেটির পিছনে ছিল তাঁর নিজের স্বার্থ। সেখানে যাতায়াত করতে করতেই নতুন একটা দু’বছরের কোর্স তৈরি করে ফেলে সে। সেখানকার এক অফিসারই এই কোর্সের নাম দেন ফিটিং-কাম মেশিনিং কম্বাইন্ড কোর্স।

ভূতনাথ হাজরা অতসব বোঝেন না, ডিসট্যান্স- এ এমএ করে অনেক তৈলমর্দন করে ভাইস-প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। তিনি অন্যদের উসকানি দিতে লাগলেন ওই পল্লববাবুর ছোটাছুটিই সার, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। মনে মনে প্ল্যান করতে লাগলেন কীভাবে পল্লবকে নাস্তানাবুদ করা যায়।

দীর্ঘ বৈঠকের পরও কোর্সটি তখনও পাস হয়নি। সরকারি ফিতের ফাঁস সহজে আলগা হয় না, একথা ভূতনাথও জানতেন। তিনি তলে তলে চঞ্চল তালুকদারকে হাত করলেন। বললেন, এই যে বসে-শুয়ে গান গেয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কোর্স চালু হয়ে গেলে, সব নষ্ট হয়ে যাবে। ছুটোছুটি করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, যদি সত্যি সত্যিই এনসিভিটি-র নতুন কোর্স চালু হয়ে যায়! তাই পল্লব বিশ্বাসের কনফিডেন্স লেভেল মানে আত্মবিশ্বাসের মেরুদণ্ডটাই যদি ভেঙে দিতে পারি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

—এক্ষুনি রাজি। কী করতে হবে বলুন তো দেখি! বলে ওঠেন চঞ্চল তালুকদার।

—কিচ্ছুই নয়, শুধু আমার সঙ্গে থাকুন। যেমনটি বলব ঠিক তেমনটাই করবেন, ব্যস তাহলেই কেল্লা ফতে! বলে ক্রূর হাসি হাসলেন ভূতনাথ।

সেদিন টিফিনের পর নবীন তখন ক্লাস নিচ্ছে, অফিস রুমে বসে কাজ সারছিল পল্লব। হই-হই রবে সেই ঘরে এসে ঢুকে পড়লেন ভূতনাথ হাজরা, চঞ্চল তালুকদার আর দু’জন কার্পেন্টার। পল্লবের টেবিলকে পাস কাটিয়ে তার টেবিলের সমকোণে থাকা ফোরম্যানের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে একজন কার্পেন্টারের উদ্দেশ্যে ভূতনাথ বললেন, দ্যাখো তো, এই টেবিলটাকে কেটেকুটে নতুন একটা টেবিল বানিয়ে দিতে হবে। পারবে তো? আমার নতুন কম্পিউটার বসবে এই টেবিলেই… হয়ে যাবে নিশ্চয়ই!

পল্লব লাফিয়ে উঠল, এসবের মানে কী? আমার ঘর থেকে টেবিল নিয়ে যাবেন কেন?

—আর ঘর! সেকশনটাই উঠে যাবে আজ নয় কাল! প্রিন্সিপালকে জানিয়ে এসেছি, চাইলে ফোন করে যাচাই করে নিন। ভূতনাথ হাজরার কণ্ঠে উষ্মা ফুটে উঠল।

চোখের সামনে দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা ফাইল-পত্র ফেলে ছড়িয়ে ওরা টেবিলটাকে বলির পাঁঠার মতো টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল। মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল পল্লবের। নাহ্ এই অপমানের যোগ্য জবাব দিতেই হবে! তবে সেটা ঠান্ডা মাথায়, তাড়াহুড়ো একদম নয়। পল্লব শপথ নিল এর শেষ দেখেই সে ছাড়বে!

সল্টলেক অফিসের তিনজন টপ ক্লাস অফিসারই পল্লবের কাজে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তার এই হার না মানা লড়াই-এর অংশীদার হলেন তাঁরাও। জানালেন তার তৈরি দু’বছরের কোর্সটিকে চেন্নাই অফিস ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু অন্তত আরও একটি কোর্স না হলে নতুন আইটিআই চালু হবে কীভাবে?

পল্লবের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। তাদের আকাদেমির এয়ার কন্ডিশনড কম্পিউটার রুমটিকে তো মাল্টিপল ওয়ার্কিংয়ে লাগানো যায়! ওই রুমে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর এক বছরের কোর্সটি চালু করলে আরও দশজন ছাত্র যোগ দিতে পারে। আর নতুন আইটিআই তৈরির পথের বাধাও দূর হয়।

কম্পিউটার রুম নিজের দখলে রেখে মেন কম্পিউটার-এ পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে রাখতেন ভূতনাথ হাজরা। এবার সেই অনধিকার চর্চা বন্ধ করার সুযোগ স্বযং এসে উপস্থিত হয়েছে। ভূতনাথ তার অফিসের টেবিল কেড়ে নিয়েছেন, এবার তাঁর দখলে থাকা কম্পিউটার রুমটাই কেড়ে নেবে সে!

যথাসময়ে ইন্সপেকশন টিম এসে পুরো ওয়ার্কশপ ঘুরে ঘুরে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে সবুজ সঙ্কেত দিতেই, প্রিন্সিপাল বলরাম বোস পুরো ওয়ান এইট্টি ডিগ্রি ঘুরে পল্লবের পাশে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। কারণ স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি ততক্ষণে পল্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন।

দু’-দুটি কোর্স নিয়ে নতুন প্রাইভেট আইটিআই-এর উন্মেষ ঘটল। নামি একটি দৈনিকের পক্ষ থেকে দু’জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী এসে ছবি তুলে সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়ে গেলেন।

সাংবাদিক পল্লবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘নতুন আইটিআই-এ আপনার অনুপ্রেরণার মূল উৎস কী?’

নিজের অজান্তেই পল্লব উত্তর দিয়েছিল— ফোরম্যানের টেবিল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...