( ২ )
চোখ বুজে থাকলেও বাপির চলে যাওয়া টের পেয়েছিল। ওনাকে কী বলবে? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে হয়ে বাবাকে কোন লজ্জায় বলবে?
ও জানে সেই ছবছর বয়সে যখন সবকিছু বুঝে ওঠার ক্ষমতাই হয়নি। বাপি ঠিক বারোটায় নিজের ট্যাক্সি গ্যারেজ করে রোজ চোখে মুখে জল দিয়ে কস্তুরীকে জাগাত, পড়তে বসাত। মায়ের কাছে কখনও পড়তে বসত না ও। মা যে বরাবর বলত, ওর আদপেই কিছু হবার নেই।
কোনওদিন ভুলতে পারবে না দিনগুলোর কথা। শাখাওয়াত মেমোরিয়ালের ভর্তির মৌখিক পরীক্ষায় যখন ও দুবারের চেষ্টায় বিফল হয়, বাপিই শক্ত হাতে হাল ধরেছিল। অন্য স্কুলে ফর্ম তুলেছিল। রাতে কোনও কোনওদিন বলতেও শুনেছে বাপিকে, দেখো আমি ঠিক পাশ করাব মেয়েটাকে। বড়োটাকে পেরেছি ছোটোটাকে পারব না?
মায়ের আশা ছিল না। তবু বাপি দিনরাত এক করে এমনকী আগের দিন ফুটে শুয়ে ভোরে উঠে লড়াই করে মাল্টিপারপাস স্কুলের ফর্ম তুলে, ৩০০ নম্বরের লেখা পরীক্ষায় পাশ করিয়েছিল ওকে। কিন্তু তারপর…। তারপর কেন সব এলোমেলো হয়ে গেল একে একে? কেন একের পর এক পরীক্ষা, পড়াশোনার বিফলতা কস্তুরীকে পায়ে বেড়ি পরিয়ে পরিবার থেকে শত শত দূরে নিয়ে গেল?
রাত বাড়ছিল। জানলার পাশের কদম গাছটায় কোনও একটা নিশাচর রাত-চেরা ডাক ডেকে যাচ্ছিল। কী পাখি ওটা? মাঝে মাঝে খসখস খটখট করে একটা শব্দ হচ্ছিল, বড়ো ভয় হচ্ছিল কস্তুরীর। তলপেটের কাছটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে রক্তশূন্য মনে হচ্ছিল। দিদি পাশে শুল। ও যে জেগে আছে এটা যেন দিদি কিছুতেই বুঝতে না পারে। নিঃসাড় কাঠ হয়ে থাকে কস্তুরী। মনে জোর আনার চেষ্টা করে, দিদিকে একদিন ঠিক বলবে ও। কিন্তু আজ নয়।
( ৩ )
—আজ তোমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না। শ্রেষ্ঠা সব সামলে নেবে।
—আমি আলুটা একটু কুটে দিই মা? ওর হাতে হাতে একটু হেল্প তো হবে।
—শ্রেষ্ঠা বলে দাও তো কেমন করে কাটবে আলুটা।
—উফঃ দিদি তুমি একটু আলুও কাটতে পারবে না? সত্যি! বেঁকা হেসে কস্তুরীর দিকে তাকায় শ্রেষ্ঠা। সমস্ত উত্সাহ যেন হাতুড়ি মেরে পেছন হাঁটতে থাকে। এগোতে পারে না।
কত ছোটো শ্রেষ্ঠা ওর থেকে, বছর ছয় সাতের তো হবেই। কস্তুরী ওর বড়ো জা। ওকে কথাগুলো বলার সময় মেয়েটার এতটুকু দ্বিধাবোধ নেই! শ্রেষ্ঠা এই বাড়িতে এসে থেকেই কতটা সহজ ভাবে দোষটাকেও ঠিক বলে চালিয়েছে। চালাচ্ছে। কিন্তু ও? সবসময় মনে হয় ভুল করে ফেলবে না তো? এটা করলে কেউ যদি কিছু মনে করে, ওটা করলে কেউ যদি কিছু ভাবে…। দোষ হলে সব কিছুর দায়ভার চিরকালের মতো ওকেই নিতে হবে যে।
আজ বিমলকাকুরা আসবে। মানে পারিবারিক বন্ধু ও তার পরিবার। পুরোনো কলকাতার ও-দিকটায় থাকে। ওরা প্রায়ই আসে। বিমলকাকুর ছেলে ওর হাজব্যান্ডের সমবয়সি। তাই ওদের আলাদা করে একটা বন্ধুত্ব আছে। মাঝে মাঝে এর-ওর বাড়ি আসা যাওয়াও হয়। বিশেষ করে কস্তুরীর বিয়ে হবার পর থেকে নতুন বউকে দেখতে ওরা প্রায়ই আসে।
কস্তুরীদের বাপের বাড়ি এদেশীয়। ছোটোবেলা থেকেই বিশেষ উত্সব অনুষ্ঠান ছাড়া আত্মীয়-স্বজনের তেমন একটা চল ছিল না। কিন্তু তমালদের বাড়ি উলটোটাই। ওরা ওপার বাংলার লোক। কথায় কথায় লতায়পাতায় জড়ানো সম্পর্কগুলোও কাছাকাছি হতে দেখেছে এই কয়েকটা বছরেই। রোজ সন্ধেবেলাতেই কোথা থেকে না কোথা থেকে ঠিক কেউ না কেউ চলে আসে
শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে গল্প করতে, চা-মুড়ি খেতে।
মন্দ লাগে না ওর। ছোটোবেলায় মামারবাড়িতে সবার সঙ্গে মিশে মিশে ওর মনটা অমন করেই তৈরি হয়েছিল। বাপি মা কাছে এলেই মনে হতো, এ যেন এক কয়েকঘর। নিজে কম কথা বললেও হাসি কথা গল্প শুনতে ওর ভালো লাগে। ঘরে বেশ একটা জমজমাট ভাব থাকবে, তবেই না। নাহলে যে ঘরে মানুষ আছে বোঝাই যায় না।
নতুন মানুষগুলোর জন্য একটা কিছু অন্তত রান্না করতে ইচ্ছে করছিল। কস্তুরী একটু একটু করে কাচের গেলাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, শরবতটা করি?
—হ্যাঁ করো। আমাদের এখন হাতে একদম সময় নেই। তোমাকে দেখাতে পারব না। দেখো কোনও ভুলচুক করে ফেলো না কিন্তু।
কোথা থেকে জলগুলো ভিড় করে আসছিল চোখে। ঝাপসা চোখে রান্নাঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে আমপান্নার স্কোয়াশ গেলাসে ঢালতে শুরু করে।