—এই রে ওরা এসে গেল মনে হয়। কী গো কোথায় গেলে? দ্যাখো না বেরিয়ে শৈবাল ঠিক করে গাড়িটা গ্যারেজ করতে পারছে কিনা। শাশুড়ি চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
—দিদি তুমি একটু এদিকটা দেখো না। হয়ে গেছে সব। আমি চট করে শাড়িটা চেঞ্জ করে আসি।
শ্রেষ্ঠা তড়তড়িয়ে দোতলায় উঠে গেল। বাড়ির গলি থেকে বাকিদের হাসিঠাট্টার আওয়াজ পাচ্ছে। ওরা এসে গেছে। নিজের দিকে তাকানোর সময় কোথায়? রান্নাঘরে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছিল। দুপুরের শাড়িটাও পালটাতে পারেনি। এখন আর সে সময়টা নেই। নীচে ওর ঘর। লোকজন এলে সোনামুখে যে-অবস্থাতেই থাকুক না কেন রিসিভ করতে হয়। কোনওরকম ওজর আপত্তি চলে না। ও সেটা চায়ও না। কিন্তু রান্নাঘরে যদি একটু সুযোগ পেত তাহলে অন্তত রান্নাটা শিখে নিতে পারত। ওতো শিখতে চায়।
কই বড়ো বউমা গেলে কোথায়? কাকুর গলা।
ড্রযিংরুমে একে একে সবাই এসে বসে। ও থাকলে ভালো হতো কস্তুরী মনে মনে ভাবে। শনিবার, আইটিদের ছুটি থাকলেও ওদের অফিসে নেই।
যাও যাও ওদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও। এসিটা চালিয়ে দিও কিন্তু। শাশুড়ি বলেন।
আরে তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আমরা তো এই সবে এলাম। বসছি তাড়া কীসের? তা তোমার বড়ো ছেলে কখন আসবে? রূপা কাকিমা, বিমলকাকুর স্ত্রী বলেন।
ছেলের আসতে আসতে একটু রাত হয় গো। শ্রেষ্ঠা তোমাদের জন্য একটা স্পেশাল পকোড়া করেছে। মেয়েটা যা ওস্তাদ রান্নায়। ওর বাবা আর আমি জানোই তো হালকা পাতলা খাই, ঝাল মশলা আমাদের পেটে সহ্য হয় না। লোক আসার অপেক্ষায় থাকে মেয়েটা। যখন থেকে শুনেছে তোমরা আসছ আমাকে পাগল করে মারছে, মা কী রান্না করব। আর মা কী রান্না করব বলেই চলেছে। ওর বাবা তো বলল তোমার যা ইচ্ছে।
সত্যি শেলি তোমার শ্রেষ্ঠা তো একেবারে রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী।
হ্যাঁ গো লক্ষ্মীবারে আমার ঘরে এসেছে। দুধ একেবারে উথলে গেছিল। আর ওর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরই তো আমার ছোটোটার মতিগতি ফিরল। সরকারি চাকরি তো পেল। বড়োটার তো তাও হল না।
মা, কাকিমাদের একটু শরবত দিই? জিজ্ঞেস করে কস্তুরী।
ওমা শুধু শরবত দেবে কেন? পাকোড়াগুলো গরম করতে হবে তো। দাঁড়াও দাঁড়াও শ্রেষ্ঠা নামুক ওই করে দেবে। এসিটা অন করেছ?
করেছি মা। ঘাড় নেড়ে বলে ও।
তুমি বরং এদিকটা একটু পরিষ্কার করো তো। এক্ষুণি লক্ষ্মী কাজে আসবে।
ঘর রান্নাঘর গুছিয়ে শুতে শুতে বারোটা বেজে গেছিল। লোক এলে এমনটাই হয়। রান্নার খুব একটা অনুমতি না থাকলেও রান্নাঘর পরিপাটি করার অধিকারটুকু ওর আছে। বিমলকাকুরা নটা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায়। তমালের সঙ্গে ওদের দেখা হয়নি। তমালের বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে নটা বাজে। সবাই শ্রেষ্ঠার পকোড়ার প্রশংসা করেছে। ওর নিজের যে-হিংসে হয়েছে কথাটা ঠিক তা নয়। কিন্তু ওকে সবকিছু থেকে এতটা দূরে রাখা হয় কেন বুঝতে পারে না কিছুতেই। যে-জায়গাটা ওর আগে প্রাপ্য, যা ওর ন্যায্য সেটাতেও অদ্ভতভাবে শ্রেষ্ঠাকে যেন অনায়াসেই শ্রেষ্ঠ করিয়ে দিচ্ছে বাড়ির সবাই।
তমাল সব শোনে। মাঝে মাঝে ধমকও দেয় ওকে। বলে, বাইরে তো চাকরি করতে বেরোতে হয় না, বুঝবে কী করে কতটা হ্যাপা পোহাতে হচ্ছে রোজ? চুপ করে যায় কস্তুরী। উলটোদিকে পিঠ ফিরিয়ে শুকনো বালিশে উগরে দেয় নিজের যাবতীয় কষ্ট। মনে মনে পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবে। নিজেকে ভালো রাখবার চেষ্টা করে।
তমাল বিয়ে আগে বলেছিল, দেখবে মা ঠিক তোমায় মাথায় নিয়ে থাকবে। পাড়ায় পাড়ায় বলবে আমার বউ এমএ পাশ। একসঙ্গে বুকের তিতিরপাখিগুলো ডানা ঝাপটিয়ে উঠেছিল আনন্দে। এই পরিবার, এই বাবা-মা নতুন করে সবকিছু গড়ার স্বপ্নে মশগুল ছিল এতদিন। কিন্তু ভুল পুরোটাই।
এ বাড়িতে আসার পর বুঝেছে সরস্বতী নয়, লক্ষ্মীর প্রাযোরিটি আগে। বাড়িশুদ্ধু সবাই লক্ষ্মী চায়। সরস্বতী না হলেও চলবে।
যে-বইগুলো বাপের বাড়ি থেকে বয়ে এনেছে সঙ্গে, মনে হয় ওগুলো বদলে ও যদি তাকভর্তি গয়না আনতে পারত তাহলে ওই রান্নাঘরের নির্দিষ্ট জায়গাটা শ্রেষ্ঠা নয়, ও-ই পেত।
আসলে মানুষ চায় সে নিজে কতটা পেল। জ্ঞান বিদ্যা বুদ্ধি হলে সেটা তো ওর মধ্যেই থাকবে। সেটা আর বাইরের লোককে বলে শান্তি পাওয়া যাবে না। বরং টাকাপয়সার ওজন বলার আরামই আলাদা। শ্রেষ্ঠার ফুলশয্যার পরের দিন শাশুড়ি, স্বামীকে বলেছিলেন, এতদিনে আমাদের ব্যাংকের লকারটা একটু ভারী হল বলো। শ্রেষ্ঠার বাপের বাড়ির গয়নাগুলো কী ভারী।
আর কত শুনতে হবে। আর কতটা সহ্য করতে পারবে ও। দুপুরে যখন যে-যার কাজে ব্যস্ত থাকে, ছুট্টে হরিণের মতো পালিয়ে যেতে মন চায় ওর।
গোঁ গোঁ করে মোবাইলটা ভাইব্রেট হচ্ছিল।
অ্যালার্ম।