কস্তুরী দিম্মামায়ের আরও গা ঘেঁষে বসেছিল। জানত এই একটা জায়গাতেই মন উজাড় করে সবটা বলতে পারে। নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে নিরাপদে। কথা বলতে বলতে জানলা দিয়ে মন বারবার চলে যাচ্ছিল মেঘের ওপারে। আকাশের সেই কালো, ধোঁয়াটে, ঘোলাটে জায়গাটায়! যেখান থেকে অঝোরধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছিল টানা একদিনেরও বেশি। কথা বলতে বলতে কখন যে-একটা দিন গড়িয়ে গেছিল বুঝতেই পারেনি। কস্তুরীর দুচোখের পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছিল গোটা একটা ছবি।

একটা অন্ধকার রাত। মিটমিটে মিশমিশে কালোয় ঢাকা একটা পাহাড়ের কোনও উঁচু অংশ। অথচ খুব অদ্ভুত ভাবেই অন্ধকারেও ওই উঁচু অংশটা চোখে পড়ছে। এমনটা প্রায়ই কোনও পার্বত্য এলাকায় চোখে পড়ে। ঠান্ডা কনকনে একটা হাওয়া পাক খেয়ে খেয়ে আঁকড়ে ধরছে ওর শরীরটা। মনে হচ্ছে কস্তুরী কোনও ঘরে নেই! বসে রয়েছে আলো নিভে আসা একটা রাতের পাহাড়ে। পথের কোনও এক বাঁকে শীত যেন ছোবল মারছে ওর পায়ে আচমকা একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ও আতিপাতি করে ওর চারপাশে গন্ধের উত্স খোঁজার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। গন্ধটা ঠিক কোথা থেকে আসছে? গন্ধটা কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য কমছে না। বরং ঝাঁঝালো গন্ধটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটা চরম মিষ্টতা। দূর থেকে এ গন্ধের সুবাস ভালো লাগলেও কস্তুরীর গা গুলিয়ে উঠতে শুরু করে। মনে হয় গন্ধের উগ্রতায় ওর চোখ নাক জ্বলতে শুরু করবে এখনই।

হঠাৎই লক্ষ করে একটা মরা আলো গাছপাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। সামান্য চাঁদের আলো, খানিকটা এসেও পড়েছে ওই উঁচু পাথুরে নিস্পন্দ অংশে। কস্তুরীর দমবন্ধ হয়ে আসছে। ও এই গন্ধটা থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কিছুক্ষণ সব থমথমে। কোথাও কোনও শব্দ নেই। একটাও রাতচরা জেগে নেই। কেন এত নিস্তব্ধ পৃথিবী? তারপরেই একটু একটু করে ছোটো বড়ো সবুজ কালোর পাতায় পাতায় তালির মতো শব্দ হতে শুরু করে। অনেকটা ছোটো শিশু দুহাতে হাততালি দিলে যেমন শুনতে লাগবে তেমনই। কিছু একটা হবে নিশ্চয়ই। ভয়ানক কিছু? তারই ইশারা গাছে গাছে, পাতায় পাতায়?

কে আসছে…? তারা এক না অনেক? কোনও একটা প্রাণের অস্তিত্ব এগিয়ে আসছে কী? সে মানুষ না জন্তু? আর তারপরেই শোঁ শোঁ করে বাতাস ফালাফালা করে একটা নীচু ধারালো শব্দ চোখের পলকে এসে গেঁথে যায় ওর পিঠে। ঝাঁকুনি দিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে কস্তুরীর গোটা শরীরটা। প্রবল একটা যন্ত্রণা। কিছু একটা নিশ্চয়ই বিঁধে আছে ওর শরীরে। উফঃ কী কষ্ট..। গলা শুকিয়ে আসছে, ঠোঁট দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আর হয়তো কোনওদিন কোনও কথা বলতে পারবে না ও…।

অসম্ভব জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মুখে প্রচণ্ড শব্দ করে ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়ে কস্তুরী। ঘামে চুপচুপে হয়ে গেছে গোটা শরীর। ঠিক পিঠের যে-জায়গাটায় কিছু একটা লেগেছিল অসম্ভব জ্বালা করছিল নিজের অজান্তেই হাতটা চলে যায় ওখানে। একটা ঘামে ভিজে ওঠা চামড়া আর রাতে পরে থাকা জামার অংশ ছাড়া আর কিছুই হাতে ঠেকে না।

স্বপ্ন? তাহলে গোটাটাই স্বপ্ন? ভযংকর। অবিশ্বাস্য!

এতটা স্পষ্ট একটা স্বপ্ন কখনও হতে পারে? কেন? কেন দেখল? সারাদিনের নানা চিন্তাই কী ওর মনের আবছা কোশে রয়ে গেছে? সেসবই অবচেতনের আড়াল থেকে নিজের স্বরূপ নিয়ে বেরিয়ে আসছে? চোখে মুখে একটা বিশ্রীভাব জেগে আছে শুধু। চারপাশে তাকিয়ে দেখল দিম্মামা কখন বিছানা ছেড়ে উঠে গেছে। পাশের বিছানার চাদরটা টানটান করা। ও এলে দিম্মামায়ের ঘরেই শোয়, ছোটোবেলার মতো।

মাথার কাছের পূবের জানলাটা দিয়ে কড়কড়ে রোদ ঘরে ঢুকতে চাইছে। বৃষ্টি কমে গেছে! শীত দিনেরবেলাতেও তার দাপট দেখাতে চাইছে। রোদের সঙ্গে সঙ্গে দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার মতো একটা হাওয়াও বইছে। দিম্মামা পর্দাটা আড়াল করে দিয়ে গেছে, যাতে ওর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। ঘাড়ের নীচে ডানহাতের আঙুল ঢোকাতেই ভেজা চুলগুলোয় বিলি কাটতে কাটতে দেখে বড়োমামা হন্তদন্ত হয়ে ওর ঘরে ঢুকছে।

তাড়াতাড়ি মুখ চোখ ধুয়ে নে। পায়ে বারবার তোকে চাইছে। সকাল থেকে কতবার যে ফোন করেছে। বড়োমামার কথা শুনে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় কস্তুরী।

একী বারোটা বাজতে যায়। এত বেলা হয়ে গেছে? কেউ ডেকে দেয়নি, ইশ। এখন? দিদি?

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...