( ৮ )

স্যারের কাছ থেকে স্তোকবাক্য শুনে এসেছিল বটে কিন্তু সেই একই হাসাহাসি, কথাবার্তা পড়ানোর সময় চলতেই থাকে। সেদিন অতিষ্ঠ হয়ে কস্তুরী নিজেই যায়, বাচ্চাগুলো পড়তে পারছে না। আপনারা একটু আসতে কথা বললে ভালো হয়।

দেখলি তো তোরা না সত্যি। তোদের জন্য আমাকে বকা শুনতে হল। কখন থেকে বলছি একটু গলাটা নামিয়ে..।

ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বুম্বা স্যার কথাগুলো বলছিলেন।

কস্তুরীর সঙ্গেও আলাপটা হয়েছিল সেদিনই ছুটির পরে।

তোমার ক্লাসে পড়াতে সমস্যা হলে তুমি আমাকে এসে জানাতে পারতে। একদম প্রভাস স্যারের কাছে…।

ওদের পড়তে অসুবিধা হচ্ছিল খুবই। আর আপনার সঙ্গে তো আমার ঠিক পরিচয় নেই..। কস্তুরী বলে।

পরিচয় নেই, পরিচয় হতে কতক্ষণ তাছাড়া আমাকে চেনে না এমন মানুষ খুব কমই আছে এই পাড়ায়।

ও। ছোট্ট করে একটা উত্তর দিয়ে ও বাড়ি ফিরে এসেছিল। ছেলেটা যে যথেষ্ট অহংকারী, দুমিনিটের কথাতেই বুঝেছিল। অসহ্য। নিজেকে কী মনে করে? কবে কোন সিনেমায় অভিনয় করেছে তার জন্য কস্তুরীকে গদগদ হয়ে যেতে হবে?

তারপরের, তারপরের দিনও ঠিক একই ভাবে ছলছুতোয় কথা বলত ছেলেটা। আরও বেশি করে আলাপ করার চেষ্টা করত ওর সাথে। কস্তুরীর ভালো লাগত না। একে তো ছেলেটার মধ্যে একটা হনু হনু গায়ে পড়া ভাব তার ওপর নিজের পড়াশোনার চাপটাও সাংঘাতিক ভাবে বাড়ছিল। সঙ্গে নানান দুর্ভাবনাও।

২০০৩-০৪ সাল। প্রত্যেকটা বিষয়ে ২০০ করে পেপার। সাযে্সে মাধ্যমিকে তেমন একটা মার্কস না থাকায় উপায়ান্তর না পেয়ে আর্টসের ইতিহাস, ফিলজফি, পলিটিক্যাল সাযে্স বিষয়গুলো নিতে হয়েছে। সমস্তগুলোতেই নম্বর তোলা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

স্যারের কোচিংয়ে ঢুকে সবগুলোয় মোটামুটি রেফারেন্স বই দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবে মনে করলেও ইংলিশটা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছিল। সাহিত্যে রেফারেন্স বই দেখে আর কাঁহাতক পড়া যায়। স্যারের কাছে দেখছিল বটে, তাও সেসবে স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করছিল প্রায় বর্ডার লাইনে এসে। শেষমেশ ইংলিশের ভালো সাজেশনের জন্য স্যারের কাছে কথাটা পাড়ে কস্তুরী। যদি উনি কোনও উপায় করতে পারেন এই আশায়?

তা তুমি বুম্বার কাছে তো দেখে নিতে পারো। অসুবিধার কী আছে? আমি ওকে বলে দেব। সেভাবে মাইনে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। দাঁড়াও ও আছে তো তোমার কাকিমার কাছে। ডাকছি। কী স্পেশাল রান্না করেছে, নিজের ছেলেকে রেখে আগে ওর মুখে দেবে। মারাত্মক পেটুক বুঝলে না। তাই তোমার কাকিমার ওকে খাইয়ে ভালো লাগে। অ্যাই বুম্বা কী করিস? ওসব খাওয়াদাওয়া রাখ। এদিকে একটু আয়। একটা কথা শুনে যা।

দাঁড়াও দাঁড়াও আসছি।

নিজের ভাগ্যকে নিজেরই দুষতে ইচ্ছে করছিল। সত্যি কথা বলতে কী, মাথাতেই আসেনি স্যার এমন একটা প্রস্তাব রাখবেন ওর সামনে। ভেবেছিল স্যারের কোনও পুরোনো নোটস পেয়ে যাবে। সাপের ছুঁচো গেলা অবস্থা হয়েছে। না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে। কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এখন যদি স্যারের মুখের ওপর না করে দেয় তাহলে স্যার কারণ খুঁজবেন। যথায়থ কারণ কী দেখাবে ও? এরপরও না করে দিলে স্যার যদি রেগে যান, ওর টিউশনগুলো…! মাথাটা ভেবে ভেবে দপদপ করে উঠছিল।

আমাকে ডাকছেন?

হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছিস না। আর তোর কাকিমাকেও বলিহারি। কত খাবি আর?

শোন, তোর আরেকটা দাযিত্ব বেড়ে গেল। আমার এই মা-টাকে পড়াতে হবে। এবছর উচ্চমাধ্যমিক ওর।

গ্রেট।

এই একটা উত্তরেই গা জ্বালা করছিল কস্তুরীর। ছেলেটা নির্ঘাত ভাবছে বাকিদের মতো ও তার সঙ্গে নিছক আলাপটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে…। কী দুরূহ একটা পরিস্থিতি। নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়িয়েছিল। শরীর, মন কোনও ভাবেই যেন সায় দিচ্ছিল না।

আরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? কখন পড়বে আলাপ আলোচনা করে নাও বুম্বার সঙ্গে।

ঠিক আছে স্যার। আমি ঠিক কথা বলে নেব ওর সঙ্গে আপনি ভাববেন না। উফঃ, কাকিমা আড়মাছের চপটা যা বানিয়ে না। পাগলা পুরো।

স্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি চলে এসেছিল কস্তুরী। কেন ভাগ্য এভাবে ওর বিপক্ষে যায়? কেন না-ভালোলাগাগুলো মাকড়শার জালের মতো আঁকড়ে ধরতে চায় ওকে। নিজেকে বড্ড একা, বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...