যুবতিটির বয়স ২৯, মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষিকা। পোস্ট ডেলিভারি ডিপ্রেশনে জর্জরিত। শুধু প্রসবের পরে নয়, আগেও বারবার পেট-ব্যথা, মাথা-যন্ত্রণা আর সাময়িক ডিপ্রেশনে ভুগেছেন, কিন্তু তা কখনওই ডাক্তার দেখানোর মতো জোরালো হয়নি। স্বামী, সন্তানের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি হচ্ছে দেখে কাউন্সেলিং করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কাউন্সেলিং চলার পর, একদিন তিনি জীবনের এমন একটা ইতিহাস জানালেন যা বিগত একুশ বছর ধরে কাউকে বলেননি। আট বছর বয়সে, কোনও অপরিচিত লোক নয়, তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক নিকট আত্মীয় তাকে যৌননিগ্রহ করেন। বিষয়টা তার কাছে ছিল এমনই লজ্জার যে, কুড়ি বছরেরও বেশি তিনি মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন।

একটি সরকার নিয়োজিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই যুবতির মতোই তিপ্পান্ন শতাংশ ভারতীয় নারী জীবনকালে অন্তত একবার যৌননিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এই সমীক্ষার আরও বড়ো ভয়ংকর দিকটি হল যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিগ্রহকারী, শিশুটির আত্মীয় বা তার পরিচিত এবং তার, আস্থা ও দায়িত্বে থাকা মানুষ। বেশিরভাগ ঘটনাগুলো ভিক্টিম-এর পাঁচ থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যে ঘটেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে কাউকে জানানো হয়নি। সোসাল সাইট-এ ‘ME TOO’ প্রায় ভাইরাল হওয়ার পর স্বীকারোক্তিতে সাহসী হয়েছেন আরও অনেক নারী। এর থেকে স্পষ্ট যে, কোনও না কোনও ভাবে মেয়েরা শৈশবে যৌননিগ্রহের শিকার হয়।

৫৩% ভারতীয় নারী জীবনকালে অন্তত একবার যৌননিগ্রহের শিকার হয়েছেনবেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিগ্রহকারী, শিশুটির আত্মীয়

যেমহিলারা জীবনে একবারও যৌননিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তাদের জীবনের কতগুলো দিক নিয়ে সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা প্রবল

  • অনুভূতি প্রকাশের দিক : হয় অকারণে অতি অনুভূতিপ্রবণ হয়ে পড়েন অথবা সঠিক মাত্রায় অনুভূতি প্রকাশই করতে পারেন না
  • আচরণের দিক : হয় অতিমাত্রায় উদ্বেগপ্রবণ, সর্বদা যেন চড়া সুরে বাঁধা, সবসময়ে নার্ভাস বা অতি-উত্তেজিত হয়ে পড়েন
  • নিজের সম্পর্কে ধারণার দিক : লো- সেলফ এস্টিম, কনফিডেন্সের অভাব
  • যৌনজীবনের দিক : নানান যৌনসমস্যা
  • শরীরস্বাস্থ্যের দিক : মানসিক কারণ জনিত নানা শারীরিক সমস্যা, ক্রনিক ব্যথা ইত্যাদি নিয়ে বারবার ডাক্তার দেখানো
  • ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক : সম্পর্ক বজায় রাখায় সমস্যা, অতি পরনির্ভরতা, অত্যন্ত বায়না ও নানান দাবি, অতি নমনীয়তা
  • সামাজিক দিক : অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেলামেশা পছন্দ করেন না কারণ আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের ওপর আস্থার অভাব।

এই ধরনের মানসিক আঘাতের ঘটনাগুলো যেহেতু কখনওই আলোচিত বা প্রকাশিত হয় না, তাই এর শিকার যারা তারা এর কবল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে সার্বিক সাহায্যের প্রয়োজন– তা কখনওই পায় না। দেখা গেছে এই ধরনের মহিলারাই পরবর্তী জীবনে সাইকো-সোমাটিক সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে বার বার ছুটে যান।

যে- উপসর্গগুলো সাধারণ ভাবে দেখা দেয় :

  • ক্রনিক তলপেট-ব্যথা
  • পেটের গোলমাল
  • অস্থি-পেশি সমস্যা
  • খাওয়া নিয়ে সমস্যা
  • ঘুমের সমস্যা/ ইনসমনিয়া
  • যৌন জীবনে সমস্যা
  • অ্যাজমা/ শ্বাসকষ্ট
  • নেশা
  • ক্রনিক মাথাযন্ত্রণা
  • ক্রনিক পিঠে ব্যথা
  • ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটি
  • পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার
  • নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা
  • আত্মহত্যার প্রবণতা
  • মিথ্যে বলার প্রবণতা
  • জন্মনিরোধক পদ্ধতিতে অনীহা
  • কম্পালসিভ যৌন আচরণ
  • সোমাটাইজিং ডিসঅর্ডার
  • ঘনিষ্ঠতার প্রতি অসহিষ্ণুতা
  • একাধিক যৌনসঙ্গী
  • অকালমৃত্যুর আশঙ্কা
  • যৌনমিলনে অনীহা

শুধুমাত্র লক্ষণগুলো জেনে কিছু না করে চুপ করে বসে থাকাটা অর্থহীন। নিজে যদি কখনও এরকম যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়ে থাকেন অথবা কোনও বন্ধুকে জানেন এরকম সহ্য করেছেন– তাহলে ভয় কাটিয়ে উঠে কোনও বিশ্বস্ত বন্ধু বা কোনও সাইকোলজিস্টের কাছে সব খুলে বলুন। তার সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো পরামর্শ মেনে সমস্যার সমাধান করুন।

১) নিজেকে একটি চিঠি লিখে জানান কীভাবে ওই সেক্সুয়াল ট্রমা আপনাকে মানুষ হিসেবে বদলে দিয়েছে। আপনি তার থেকে কী শিক্ষা পেয়েছেন? কী হারিয়েছেন? কীসের জন্য মনস্তাপ করেন?

২) কোন কোন কাজ আপনি পছন্দ করেন তার একটা তালিকা বানান এবং বিষণ্ণবোধ করলেই সে সব করা শুরু করে দিন। জোর করে নিজেকে আরও বেশি সামাজিক, আরও বেশি কর্মঠ করে তুলুন।

৩) আপনি কোন কোন জিনিসে ভয় পান তার একটা লিস্ট বানান। শুরু করবেন সবচেয়ে কম ভয়েরটা দিয়ে এবং ওপরে উঠতে উঠতে শেষ করবেন সবচেয়ে বেশি ভয়েরটায় এসে।

৪) কোনও সাইকোথেরাপিস্টের সাহায্য নিয়ে রিল্যাকসেশন টেকনিকগুলো শিখে নিন। আপনার বেশি পছন্দেরগুলো তার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে রোজ প্র্যাকটিস করতে থাকুন। মনে রাখবেন অতীতে যা ঘটে গেছে তা তো আর পালটাতে পারবেন না কিন্তু ওই বাজে অভিজ্ঞতার জন্য প্লিজ সেই সুন্দর মানুষটাকে পালটে যেতে দেবেন না যা আসলে আপনি। লড়াই করুন একটি সুখী স্বাস্থ্যোজ্জ্বল জীবনে প্রবেশ করার জন্য। নিজেকে ভালোবাসুন, নিজের যত্ন নিন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...