( ১৫ )
ওমা এই তো কর্তা-গিন্নি দু’জনে ঠাসাঠাসি চলছিল? এসব আবার কী? একসঙ্গে দু-দুটো বউই…? আমি পারব কী করে?
আপনার তো খুশি হওয়া উচিত মাসিমা। বাড়িতে জোড়া বংশধর আসছে। দুটো বউমাই গর্ভবতী। এ কী যার তার ভাগ্যে হয়?
ভাগ্যবতী না ছাই। বড়োজন মোটেই সুবিধার নয়। মুখ বেঁকায় শেলীদেবী।
তবে একটা কথা ভালো ডাক্তার দেখান। আপনার বড়ো বউমার হিমোগ্লোবিনটা কমের দিকে। পরের দিকে ওনার সমস্যা হতে পারে।
নিকুচি করেছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা প্রদীপদার হাত থেকে প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্টটা বিরক্তিসহকারে নিয়ে ঘরে ঢুকে আসে তমালের মা।
ঘর টপকে সমস্ত কথাগুলোই কস্তুরীর কানে আসছিল। মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালোলাগা তিরতির করে উঠছিল। সত্যিই ও ঠিক শুনছে? ও মা হতে চলেছে? নতুন একটা প্রাণ, সম্পূর্ণ নতুন প্রাণের জন্মদাত্রী হতে চলেছে ও? এখন থেকে আর বাঁজা শব্দের ট্যাগটা বয়ে বেড়াতে হবে না? নিস্তেজ শরীরটায় বল এনে ফোনটাকে কাছে টেনে নিতে চায় ও। ওকে ফোন করতে হবে। এতদিনের পিছলে যাওয়া আনন্দটুকু যেন একটু একটু করে ফিরে আসছে। কী যে ভালো লাগছে।
ফোনটা হাতে তুলে নেয় কস্তুরী।
বিপ্… বিপ্…। একটা মেসেজ ঢুকল।
কী হল উত্তর দিলে না জানেমন। শৈবালদা।
নাহ আর এক মুহূর্ত চুপ করে থাকা যাবে না। এতদিন অনেক সহ্য করেছে, সবার সম্মানের কথা ভেবে। ওকে জানাতেই হবে। কস্তুরী তো কোনও অন্যায করেনি। তাহলে এই অন্যাযটাকে মেনে নেবে কেন? কী কারণে? সব প্রমাণ তো ওর হাতেই আছে। উনি লুকিয়ে ওর ঘরেই কীভাবে কখন ক্যামেরা রেখে গেছিলেন আজও মাথায় আসছে না কস্তুরীর। এও কী সম্ভব? বন্ধুর মতো, দাদার মতো একটা মানুষ এতটা আগ্রাসী, তত অমানুষ কীট হতে পারে কী করে? আর এই মানুষটাকেই তমাল আপন মনে করে মনের যাবতীয কথা…।
কস্তুরী এখন থেকে জীবনের এই কালোগুলোকে দুহাত দিয়ে সরিয়ে দেবে। নতুন একটা পৃথিবী ওকে ডাকছে যে। সেদিন ভিডিওগুলো দেখার পর পরই কেমন যেন অবশ হয়ে কস্তুরীর শরীরটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। এই দুদিন এতটাই দুর্বল লাগছিল কিছুতেই উঠতে পারেনি বিছানা থেকে, তাই নিয়ে কম তানাও শুনতে হয়নি ওকে। শ্বশুড়বাড়ির ফ্যামিলি ফিজিসিযান এসে কয়েকটা টেস্ট লিখে দিয়ে গেছিলেন আর তারপরই ইউরিন টেস্টের রিপোর্ট পজেটিভ।
ভাগ্য, ভবিষ্যৎ এসব তাহলে মিথ্যে নয়? সেই যে ছোটোবেলার জ্যোতিষী বলেছিল ওর নাকি ৩৪-৩৫ বছর বয়সে সুদিন আসবে? মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। তাহলে এটারই ইঙ্গিত? সামনের বছর জুনেই তো কস্তুরীর চৌত্রিশ বছর পূর্ণ হবে। ভয়, ভাবনা, ঘৃণা কেটে অনাবিল এক দেহ-মনোচিত সুখ ঘিরে ধরে ওকে।
তুমি কি খুশি নও? কথা বলছ না কেন বু?
আজ ঠিক কতগুলো বছর পর তমালকে এই নামে ডাকল জানে না কস্তুরী। সময়ে জাঁতাকলে সম্পর্কেও দূষণ জমছে যেন। কিন্তু তবুও কস্তুরী জানে এই ভালোবাসার মানুষটাই ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছিল আলোর ধারে। রঙিন স্বপ্ন দেখিয়েছিল দুচোখ ভরে। ঠিক এই মানুষটাই একটা সংসার করার সাহস দিয়েছিল। তবে কেন, কেন ভুল বোঝাবুঝি, কেন এত দূরত্ব? হাত ধরে চলার শুরুতে ভয় ছিল, শঙ্কা ছিল কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির এমন ফাঁক তো ওরা দুজন রাখতে দেয়নি।
উচ্চমাধ্যমিকে পিছিযে পড়া ফলাফল ওকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। আর তাতেই ভযানক সেই সিদ্ধান্ত…। মেট্রোর সিঁড়ি দিয়ে নেমে দুরন্ত গতিতে ট্রেনের সামনে লাফিযে পড়ার আকুতি… কোনও সম্পর্ক, কোনও বাঁধন-ই কস্তুরীকে সেদিন ফিরে আসতে বলেনি। কেবল ছোট্ট একটা না অসীম নিঃশব্দের দিকে আকর্ষণ করছিল। ভরা নেশালু এক পাত্রের মুখ থেকে চলকে চলকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল অতীতের কিছু জ্বালাময় গরল।