সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ সেরকম না হলেও সমস্যা হল মায়ের প্রশ্নেই। সিদ্ধার্থ একটা ছোটো চাল খাটানোর চেষ্টা করলেন, “ইচ্ছাপুরের হরিশের পৈতৃক বাড়ি থাকবে কুসুমের নামে। যে তাঁর দেখভাল করবে ওটা সেই পাবে, সেই সঙ্গে কুসুমের নামে রাখা টাকাও।”
নিলু তির্যক হেসে বলল, ‘বড়দা বোধহয় ও-ঘর থেকে আপনাকে শিখিয়ে এনেছে। আমার অত লোভ নেই কাকু। আমি অল্পতেই সন্তুষ্ট। মায়ের নামের জিনিস আমি কেন নিতে যাব?’ সেয়ানা আর কাকে বলে! ইঙ্গিতটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল। সিদ্ধার্থ তাকালেন তপনের দিকে।
তপন বলল, ‘আমার ওসব কিছু লাগবে না। পরিস্থিতি একটু ঠিকঠাক হলে আমি এমনিতেই মাকে নিয়ে যাব। আমার একটু সময় চাই। বড়দা তো মুখের কথায় বিশ্বাস করছে না। ভাবছে কেটে পড়ব।’
নীপা বলল, ‘আমি দায়িত্ব নিতে পারি। কিন্তু দাদারা থাকতে মা আমার কাছে গিয়ে থাকলে সেটা কি ভালো দেখাবে? তাছাড়া আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এখনও জীবিত। মা কি ওভাবে থাকতে পারবে?”
সিদ্ধার্থ বললেন, ‘সেটা হয় না। তবে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থাই কর। তোদের মা শক্ত সমর্থ মানুষ। এখনও চলাফেরা করতে সক্ষম। এমন একটা মানুষকে নিয়েই যদি টানাহেঁচড়া হয়, তাহলে অশক্ত হলে কী অবস্থা হবে সহজেই অনুমেয়। বৃদ্ধাশ্রমই ওঁর জন্য ভালো জায়গা। অচেনা মানুষ অবহেলা করলে তবু মেনে নিতে পারবেন।’
চাল সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এরা যেমন লোভী তেমনি সেয়ানা। জানে সবাই, এই সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলে ঘুরেফিরে ওদের কাছেই ফিরে আসবে আবার। বহুকাল আগে পড়া একটা গল্প মনে পড়ে গেল, নোনাজল। মনে মনে হাসলেন সিদ্ধার্থ। কিছু কিছু জিনিস হাজার চেষ্টা করেও আটকানো যায় না৷ এরা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়েই ছাড়বে। সেটাই বোধহয় কুসুমের নিয়তি। এদের কাছে সম্পর্কের কোনও মূল্য নেই। আর মূল্যহীন সম্পর্ক অচল পয়সার মতন, থাকা না থাকা সমান।
শেষ হুমকিটা দিলেন সিদ্ধার্থ, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি তোদের মাকে আমার কাছে নিয়ে রাখতেই পারি। কিন্তু সেটা কি ভালো দেখাবে? লোকে তোদের বদনাম করবে। আমারও। কিন্তু আমি পরোয়া করি না। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। বৃদ্ধাশ্রমে কেউ মন থেকে যায় না, পাঠানো হয়। একটা বড়ো গাছকে শিকড় টেনে তুলে অন্য জায়গায় পুঁতলে সেটা হয়তো মরে না কিন্তু সে কেমন বাঁচে সহজেই অনুমান করা যায়। আর কিছু বলার নেই আমার। এবার কী করবি তোরা বোঝ। তবুও তোদের মায়ের সঙ্গে আলাদা করে একটু কথা বলব, শুনব তিনি কী বলেন।”
এবার আক্রান্ত হল সিদ্ধার্থের আধপাগল ভাই মতি৷ ছোঁয়াচে রোগ, পাগল বলে তো আর কাউকে ক্ষমা করবে না। রাস্তা ঘাটে নিয়মনীতি না মেনেই বেরিয়ে পড়ত। কতক্ষণ আর পাহারা দেওয়া যায়? ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠিক বেরিয়ে যেত। ধরে নিল মারণ ভাইরাস। পজিটিভ রিপোর্ট আসার পরেই হসপিটালে শিফট করে দিলেন সিদ্ধার্থ। কোভিড হসপিটালে বেডের সমস্যা থাকলেও অনিমেষের সহায়তায় একটা বেড জোগাড় হয়ে গেল৷ প্রাক্তন ছাত্র অনিমেষ সরকারি আমলা, ওর অনেক হাত। নিয়ম অনুযায়ী সিদ্ধার্থ ও রামের মায়েরও টেস্ট করাতে হয়েছে। দুজনেরই নেগেটিভ।
চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখলেন না সিদ্ধার্থ। তবুও বাঁচাতে পারলেন না ভাইকে। এই পৃথিবীতে রক্তের যোগসূত্রে একমাত্র এই ভাই-ই ছিল। ভাইয়ের দেখাশোনা, নিজের চাকরি, পড়াশোনা— এসব করতে গিয়ে বিয়েটাই আর করা হয়ে ওঠেনি। ভাই মারা যাওয়ার পর তাঁর জগৎটা হঠাৎ করে শূন্য হয়ে গেল। নিজেকে মনে হল শূন্যে ভাসমান এক নরদেহ মাত্র, যে-নরদেহের অস্তিত্বের আভাসটুকুও আর থাকবে না, দেহ বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে।