শিঞ্জিনির কথা শুনে এবং ওর এহেন অবস্থা দেখে সোহম সেনের মতো শক্ত মানুষেরও ভিতরটা নাড়া খেয়ে যায়। শিঞ্জিনিকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পান না সোহম সেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে তিনি বললেন, এসব তুমি কী বলছ! আজকের দিনে এমন কোথাও ঘটে না-কি! তুমি সব জেনে বুঝে চাকরি ছাড়ার জন্য পেপার ডাউন করলে কী মনে করে। তুমি একবারও ভাবলে না, এর পিছনে তোমার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তোমার কাকাদের বিশাল কোনও লেনদেনের ব্যাপার থাকতে পারে!
—আপনি মাড়োয়ারি পরিবারের ব্যাপার-স্যাপার জানেন না স্যার। শ্বশুরবাড়িপক্ষ যত বড়ো ধনীই হোক না কেন, আমার বাবার মতন একজন মানুষের কাছ থেকে বহু দর-দস্তুর করার পরে তিরিশ লক্ষ টাকার দহেজ অর্থাৎ পন ক্লেইম করেছে। এবং সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয় হল, বাবা সেই তিরিশ লক্ষ টাকা ইতিমধ্যে হ্যান্ডওভার করে দিয়েছেন তার মেয়ে বিয়ে বায়না হিসাবে। এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আমি এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলাম।
—বাবা আমার কাছে আকুতি জানিয়ে হাত-জোড় করে বলেছিলেন, তুই এই বিয়ে ভেঙে দিলে আমার মরে যাওয়া ছাড়া সামনে আর কোনও পথ খোলা থাকবে না। তোর কাকারাও আমাদের পাশ থেকে সরে দাঁড়াবে। এই বয়সে আমি এই শরীরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব বলতে পারিস! বাবা আমাকে অনেক করে বুঝিয়েছিলেন, এই টাকার অঙ্কটা ওদের কাছে কিছুই নয়। ওরা নিয়ম রক্ষার্থে এই ডাউরির টাকা চেয়েছে। উলটে ওরা নাকি এই প্রস্তাব দিয়ে গিয়েছে, ওরা আমাকে ওদের ফার্মাসিউটিকাল সফ্টওয্যার তৈরির ব্যাবসায় পার্টনার করে নেবে। একেবারে লিখিত-পড়িত ভাবে এবং সেইসব ওরা বিয়ে আগেই সেরে ফেলতে চায়।
—ভালোই তো হল! ছিলে একটা সফ্টওয্যার কোম্পানির সাধারণ একজন কর্মচারী। সেখান থেকে পদোন্নতি ঘটিয়ে একেবারে একটা সফ্টওয্যার কোম্পানির পার্টনার! এইরকম স্কাই-রকেটিং কেরিয়ার কজনের কপালে জোটে! বাবা-কাকাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে যখন ভাঙতে পারবে না, তখন আজ এত দূর থেকে ছুটতে ছুটতে এই ইন্সটিটিউটে এসেছ কী জন্য! এয়ারপোর্টে নেমে সোজা আসানসোলে যাওয়ার ভলভো ধরলেই তো ভালো করতে। রীতিমতো শ্লেষের সঙ্গে শিঞ্জিনির উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন সোহম সেন।
শিঞ্জিনি বুঝতে পারছে, স্যার ওর এই নড়বড়ে আচরণে বেজায় চটে গিয়েছেন। স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে শিঞ্জিনি। মাথা নীচু করে, চুপ করে বসে থাকে সে। কিন্তু ওর ভিতরটা চুপ করে থাকতে পারে না। নিদারুণ এক অসহায়তায় হাজার একটা কষ্ট ওর বুক বেয়ে গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠতে চায়।
শিঞ্জিনির অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে, সোহম সেন ফিরে আবার ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, এরকম ভাবে চুপ করে থাকলে জীবনে এক পা-ও এগোতে পারবে না শিঞ্জিনি। তুমি ইমিডিয়েলি বাবা-কাকাদের সঙ্গে কথা বলে, নিজে সোজা জয়পুরে চলে যাও। তোমার হবুবরের সঙ্গে, হবু শ্বশুর-মশাইয়ে সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো। নিজের চোখে, নিজের কানে সব দেখে-শুনে, নিজে একশো শতাংশ নিশ্চিত হলে, তবেই বিয়ে পিঁড়িতে বসার সিদ্ধান্ত নেবে। একটা চাকরি ছেড়েছ, মানে দ্বিতীয় চাকরি তুমি আর জোগাড় করতে পারবে না, এটা মনে করার কোনও অর্থ নেই। একটা কথা শুধু মনে রাখবে, এত ধনী লোকেরা যখন এত দ্রুত তাদের ছেলের বিয়ে ব্যবস্থা করতে চাইছে, নিশ্চয়ই তাদের ছেলের ডাল মে কুছ তো কালা রহেগাই!