সন্তান আপনার। তাই, তাকে সুস্থ রাখার দায়িত্বও নিতে হবে আপনাকেই। নবজাতকের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে শুরু থেকেই। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। কারণ, খালি চোখে দেখা যায় না এমন রোগজীবাণু ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। একটু অসতর্ক থাকলে যা বাসা বাঁধতে পারে ছোট্ট শিশুর শরীরে। অতএব, আপনার ছোট্ট শিশুটি যাতে সর্বদা জীবাণুমুক্ত থাকে, তার জন্য আপনাকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

হাত ধুয়ে বাচ্চাকে কোলে নিন

নবজাতকদের ইমিউন সিস্টেম খুব স্ট্রং হয় না, তাই সংক্রমণের ভয় থাকে সব সময়। সুতরাং বাচ্চাকে স্পর্শ করার আগে ভালো করে হাত ধুয়ে নিন অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। সেইসঙ্গে, অপরিষ্কার হাতে বাচ্চাকে ধরতে কাউকেই অনুমতি দেবেন না।

মাথা এবং ঘাড়ে সাপোর্ট দিন

যখনই বাচ্চাকে কোলে নেবেন, ঘাড়ে এবং মাথার নীচে হাত রাখুন যাতে ঘাড় এবং মাথার পিছনে সাপোর্ট থাকে। বাচ্চাকে শোয়াবার সময়ও একই নিয়ম মেনে চলুন। বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে ট্রাভেল করলে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে যাত্রাপথ খুব রাফ বা বাউন্সি না হয়।

বেশি নাড়াচাড়া নয়

অনেক সময় বাচ্চা কাঁদতে থাকলে, বাচ্চাকে হাসাবার জন্য কিংবা নিছকই খেলার ছলে বাচ্চাকে শূন্যে ছুঁড়ে আবার ধরে নেন অনেকে। কিন্তু বাচ্চাকে অতিরিক্ত ঝাঁকানো একেবারেই অনুচিত। এতে শিশুর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলতে তাকে ঝাঁকাবার দরকার নেই বরং পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিন বা গালে আঙুল দিয়ে আলতো করে টোকা দিন।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন

বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার যে, ডায়াপার ব্যবহার করবেন নাকি কাপড়ের ন্যাপি। যাই ব্যবহার করুন না কেন, দিনে অন্তত দশবার ন্যাপি বদলাবার দরকার পড়ে। সুতরাং মজুত রাখা দরকার পরিষ্কার ডায়াপার। কাপড় ব্যবহার করলে ডায়াপার পিনস, ডায়াপার ক্রিম এবং একটি পাত্রে হালকা গরমজল এবং মোছার নরম সুতির পরিষ্কার কাপড় এবং তুলো রাখা দরকার।

বাচ্চাদের প্রায়ই ডায়াপার র‍্যাশ হতে দেখা যায়। সেই ক্ষেত্রে হালকা গরমজলে বাচ্চাকে পরিষ্কার করে ভালো করে সেখানে ক্রিম লাগিয়ে রাখতে হবে এবং ডায়াপার ছাড়া বাচ্চাকে কিছুটা সময় রাখতে হবে।

৩ দিনের মধ্যে র‍্যাশ না সারলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ ফাংগাল সংক্রমণের কারণেও এমনটা হতে পারে।

স্নানের নিয়ম

নবজাতককে স্পঞ্জ বাথ দেওয়া বাঞ্ছনীয়, যতদিন না আমবিলিকাল কর্ডটা পড়ে যায় এবং নাভি সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ বার বাচ্চাকে স্নান করালেই যথেষ্ট, কারণ বাবাবার স্নান করালে বাচ্চার ত্বক ড্রাই হয়ে যায়। বাকি দিনে স্পঞ্জ বাথ দিন বাচ্চাকে।

খাওয়ানো এবং ঢেঁকুর তোলানো

সাধারণত খিদে পেলে তবেই খাওয়ানো উচিত বাচ্চাকে। খিদে পেলে বাচ্চা নয় কাঁদবে কিংবা মুখে হাত ঢুকিয়ে আঙুল চুষতে থাকবে। বাচ্চাকে ফিডিং করাবার সময় অনেকবার হাওয়া গিলে নেয় বাচ্চা, ফলে পেটে ব্যথা হয় এবং বাচ্চা কাঁদতে থাকে। এই সমস্যা যাতে না হয়, তার জন্য মাঝেমধ্যেই খাওয়াবার মাঝে বাচ্চাকে পিঠের উপর ফেলে ঢেঁকুর তোলানো খুব জরুরি।

ঘুমের অভ্যাস

নবজাতক সাধারণত ১৬ ঘণ্টা বা তার বেশি ঘুমোয়। কিন্তু টানা এক ভাবে নয়। ২ থেকে ৪ ঘণ্টা টানা ঘুমোয় বাচ্চা। ৪ ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চা ঘুম থেকে না উঠলে, বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে ফিড করানো দরকার। বাচ্চারা নিজেরাই একটা ঘুমের প্যাটার্ন তৈরি করে নেয়। সাধারণত ৩ মাস বয়স থেকে বাচ্চা ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা টানা ঘুমোয়। যদি সেটা নাও হয়, ভয় পাওয়ার কোনও দরকার নেই। যদি দেখেন বাচ্চার ওজন বাড়ছে এবং দেখে মনে হয় সুস্থ, তাহলে ৩ মাস বয়সে পুরো রাত না ঘুমোলেও চিন্তার কোনও কারণ নেই।

সব মিলিয়ে নবজাতকের দেখাশোনার জন্য মা-বাবা এবং বিশেষ করে মা-কে সবসময় সজাগ থাকতে হয়। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক নিয়মেই শিশু বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখতে থাকে এবং তার জীবনযাত্রা ছন্দে ফিরতে আরম্ভ করে। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত শিশুকে সাবধানে রাখা মা-বাবার কর্তব্য।

শিশুর সঙ্গে বন্ডিং

নবজাতকের যত্নে, মা-বাবার সঙ্গে বন্ডিং হওয়াটা খুব জরুরি। বাচ্চার সঙ্গে ফিজিক্যাল ক্লোজনেস, ইমোশনাল কানেকশন বাড়ায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে অ্যাটাচমেন্ট, বাচ্চার ইমোশনাল গ্রোথ হতে সাহায্য করে এবং শারীরিক ডেভেলপমেন্ট হতেও সাহায্য করে। বন্ডিং-এর শুরু হয় বাচ্চাকে যেই নিজের কোলে নিচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে তার সারা গায়ে হাত বুলোচ্ছেন। ব্রেস্ট ফিড করাবার সময়ও মা ও সন্তানের ত্বকের সংস্পর্শে বাচ্চা এবং মা উভয়ের মনেই আনকন্ডিশনাল ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয়। বাচ্চারা গলার স্বর শুনতে ভালোবাসে, সুতরাং বাচ্চার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলুন, গান শোনান।

সামগ্রিক যত্ন

মানব শরীরের অঙ্গগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয় হাত। এই হাত প্রতি মুহূর্তে অন্যান্য উপাদানের সংস্পর্শে আসে এবং ওইসব উপাদানে থাকা জীবাণু আশ্রয় নেয় হাতে। তাই, নবজাতককে কোলে নেওয়ার আগে কিংবা খাওয়ানোর আগে, নিজের হাত সাবান দিয়ে ভালো ভাবে ধুয়ে নেওয়া প্রয়োজন। বাইরে থাকলে স্যানিটাইজার হাতে নিয়ে তারপর বাচ্চাকে খাওয়ান।

শিশুর হাইজিন মেনটেইন করতে হলে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদেরও জীবাণুমুক্ত থাকতে হবে। অর্থাৎ, বাইরে থেকে ঘেমো গায়ে বাড়িতে ঢুকেই শিশুকে কোলে তুলে নেবেন না। এতে আপনার দ্বারা বাহিত জীবাণু শিশুর শরীরেও সংক্রমিত হতে পারে। তাই বাইরে থেকে বাড়ি ঢুকে, প্রথম নিজে মেডিকেটেড লিকুইড সোপ দিয়ে হাত ধুয়ে এবং সম্ভব হলে সম্পূর্ণ স্নান সেরে তবেই সন্তানকে কোলে তুলুন। এই অভ্যাস আপনার এবং আপনার সন্তান উভয়ের পক্ষেই লাভজনক হবে।

এছাড়া, মাঝেমধ্যে ছোট্ট শিশুকেও বেবি সোপ দিয়ে সম্পূর্ণ স্নান করিয়ে দিন। ব্র্যান্ডেড বেবি সোপ শিশুর চোখে গেলেও, জ্বালা কিংবা ক্ষতি করবে না। অবশ্য শিশুকে শুধু হ্যান্ডওয়াশ কিংবা বডিওয়াশ-ই নয়, শিশু যাতে ময়লা কিংবা ক্ষতিকারক কোনও উপাদান হাত দিয়ে না ধরে কিংবা মুখে না তুলে নেয়, এ বিষয়েও মা-বাবাকেই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, শিশুর সুস্থতার জন্য এই সতর্কতা ভীষণ জরুরি।

এছাড়া, বাচ্চারা মল-মূত্র ত্যাগ করার পর, জলে সামান্য জীবাণুনাশক তরল ফেলে বাচ্চার রেচনাঙ্গ ধুয়ে দেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, শুধু বাহ্যিক নয়, শিশু যেন সম্পূর্ণ (অভ্যন্তরীণ) সুস্থ থাকে। আর এই সম্পূর্ণ সুস্থতার জন্য শিশুকে উপযুক্ত পরিমাণে শুদ্ধ জলও খাওয়াতে হবে। কারণ, মূত্রের মাধ্যমে শরীরের অনেক বর্জ্য এবং রোগজীবাণু বাইরে বেরিয়ে যায়।

শিশুদের স্নান করানোর জন্য ব্যবহৃত জলে সামান্য গরমজল মিশিয়ে নিলেও ভালো। এতে চট করে যেমন ঠান্ডা লাগবে না, ঠিক তেমনই স্নানের জন্য ব্যবহৃত জলকেও জীবাণুমুক্ত রাখা যাবে। কখনও যদি শিশু বৃষ্টিতে ভিজে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হালকা গরমজলে তোয়ালে ভিজিয়ে শিশুর গা মুছে দিন। এতে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে থাকা জীবাণু সংক্রমিত হবে না শিশুর শরীরে।

রাতে যদি বাচ্চাদের ন্যাপি পরিয়ে রাখেন, তাহলে মল-মূত্র ত্যাগ না করলেও ন্যাপি বদলে ফেলুন। কারণ, দীর্ঘ সময় হাওয়া না ঢুকলে ন্যাপিতে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। বাচ্চার জন্য ব্যবহৃত বিছানা এবং জামাকাপড় সাবান দিয়ে ভালো ভাবে কেচে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিন। এতে বিছানা এবং জামাকাপড়ে জীবাণু বাসা বাঁধতে পারবে না। যে-বোতলে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ান, সেই বোতল প্রতিদিন অন্তত কুড়ি মিনিট গরমজলে ফুটিয়ে নিন। কারণ, ঠান্ডা জলে দুধের বোতল ধুলে, তা পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত হয় না। এভাবেই হাইজিন মেনে চললে আপনার বাচ্চা শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকবে এবং দীর্ঘজীবন লাভ করবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...