সকাল সাড়ে ছটা। বদ্ধ ঘরের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে মর্নিং অ্যালার্ম এবং কলিং বেল দুই-ই তারস্বরে বেজে উঠল। যৌথ শব্দে দোয়েলের ঘুমের বারোটা বেজে গেল। রাতের পোশাক পরিবর্তন না করেই মুখে একরাশ বিরক্তি এনে বলল— ‘রবিবার ছুটির দিনেও একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না রমা। ভালো লাগে না আর।’
রমা দোয়েলের ফ্ল্যাটের কাজের লোক। বছর পাঁচ হল সে দোয়েলের ফ্ল্যাটে কাজ করছে। দরজা খুলে দিয়ে দোয়েল বলল— ‘আসুন ম্যাডাম। আচ্ছা, তুই কি রাত্রে ঘুমোস না! আকাশে মেঘ মেঘ করেছে দেখে আমি ভাবলাম দেরিতে আসবি।’
দেরি করে এলে হবে নাকি! আরও দুবাড়ির কাজ আছে।
রমার কথায় দোয়েল আর কোনও প্রতিবাদ করল না। আজকাল খুব কাজের লোকের সমস্যা। রবিবার বলে দোয়েলের কোনও ব্যস্ততা নেই। অন্যদিন তো দশটার মধ্যে তাকে অফিস বেরোতে হয়।
রমা হাতের ব্যাগটা নামিয়ে দোয়েলকে বলল— ‘তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও না। আমি ঘরের কাজ সেরে তোমাকে ডাকব।’
তোর জন্য ঘুম হবে না। আগে আমায় চা করে দে।
চা দিচ্ছি গো। তোমাকে দেখতে কিন্তু হেবি লাগছে পোশাকটাতে।
দোয়েল স্মিত হেসে টাওয়েল কাঁধে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
রমারও চোখ আছে। দোয়েল সত্যিই সুন্দরী। শর্ট নাইট ড্রেসে তাকে বেশ দেখাচ্ছিল। দুধের মতো সাদা গায়ের রং। মুখশ্রী পানপাতার মতো। বয়স সাতাশ বছর। মেদহীন ছিপছিপে শরীর। বটগাছের ঝুরির মতো পিঠে নেমে এসেছে ঘন স্টেপ কাট চুল। টানা টানা জলভরা দুটি চোখ। নাইট ড্রেসের বাইরে অনাবৃত লোমহীন দুটি পা দেখলে যে-কারওর চোখ আটকাতে বাধ্য।
রমা কিছুক্ষণ পর চা করে বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল— ‘দিদিমণি, চা তৈরি।’
দোয়েল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল— ‘আমার চা রেখে দে। তুই চা খেয়েছিস?’
রমা বলল— ‘খেয়েছি।’
স্নান সেরে নীল সালোয়ার কামিজে দোয়েলের সর্বাঙ্গে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছিল। দোয়েল একটু ধমক দিয়ে বলল— ‘পাকামি করিস না তো।’
দোয়েল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হোয়াটস অ্যাপে ফেসবুকে চোখ বুলিয়ে নিল। হোয়াটস অ্যাপে, অনিন্দ্য রায়ের মেসেজ চোখে পড়ল। অনিন্দ্য রায় দোয়েলের অফিসের বস। ভদ্রলোকটি চ্যাট করতে ওস্তাদ। অফিসে প্রায়ই দোয়েলকে শোনান, তিনি কাছের মানুষদের ছাড়া কাউকে ফোন অথবা এসএমএস করেন না। দোয়েলকে তিনি কাছের ভাবেন বলেই খোঁজখবর নেন।
অনিন্দ্যর অনেক আচরণই দোয়েল তিন বছর প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। দোয়েল কোনওদিনই অনিন্দ্যর মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। প্রথমত, দোয়েলের অফিসের বস অনিন্দ্য রায়। দ্বিতীয়ত, দোয়েলের প্রতি অনিন্দ্য রায়ের আচরণ অন্য সকল অফিস স্টাফদের থেকে আলাদা। এই আলাদা হওয়ার কারণেই অনিন্দ্যর প্রতি দোয়েলের মনে একটা সুপ্ত দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। দোয়েলের দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে, অনিন্দ্য রায় তাকে ভালোবাসে।
দোয়েল এই যুগের মেয়ে হলেও মেয়ে তো। এখনও মুখ ফুটে সে অনিন্দ্যকে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে বলতে পারেনি তার মনের কথা। তাই দোয়েল অনিন্দ্যকে সম্বোধনের সময় অনিন্দ্যদা-এর দা-টা এখনও ছেঁটে ফেলতে পারেনি।
অনিন্দ্য কাল রাত্রে দোয়েলকে ফোনে বলেছে বলো তো দোয়েল রবিবার আমাদের জীবনে কেন আসে! আই মিস ইউ। এই মিস করার কারণ দোয়েল অনুসন্ধান করতে পারে না।
কিছুক্ষণ আগে রমা কাজ করে চলে গেছে। ব্রেকফাস্ট করে নিজের অগোছালো বেডরুম গোছাতে গিয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি যেতেই দোয়েলের মেজাজ হঠাৎ পালটে গেল। সে বিরক্তিতে বিড়বিড় করে বলে উঠলজানলা খুললেই ফাটা রেকর্ডের মতো চার বছর হয়ে গেল এক লাইন মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে এক চাঁদ কা টুকরা রহতে হ্যায় শুনে যাচ্ছি। জাস্ট অসহ্য। ছেলেটিকে নেওয়া যাচ্ছে না। সে জানলা বন্ধ করে দিয়ে ল্যাপটপে অফিসের কাজ সারছিল। কাল অনিন্দ্যদাকে সব ফাইল ক্লিয়ার করে তার জমা দেওয়ার কথা। দোয়েল বলেই অনিন্দ্য বেশি সময় দিয়েছে।