এরপর থেকেই ক্রমশ এই পরিবারের সঙ্গে তার পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে কখন পলাশ-মৌ-এর ঘনিষ্ঠতা গভীরে পৌঁছেছে তা ওরা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। পরিচয় থেকে ক্রমশ তা প্রেমে পরিণত হয়।

মৌ-এর জন্ম ও পড়াশোনা দিল্লিতেই, তাই দিল্লির রাস্তা-ঘাট ওর কাছে খুব পরিচিত ছিল। দিল্লির লোকেদের নার্ভও ওর ভালো ভাবে জানা ছিল। ওর সঙ্গে পলাশ দিল্লির বহু জায়গায় ঘুরেছে। সেসব দিনের কথা মনে পড়ে যায় পলাশের। মনে পড়ে যায় দিল্লির সেইসব সুখস্মৃতি।

মৌ-এর হাত ধরে ছুটির দিনে ইন্ডিয়া গেটের সামনে বেড়াতে যাওয়া। মনে পড়ে সেই দিনগুলো যখন লোদী গার্ডেনের বা মোগল গার্ডেনের ফুলগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকত, মনটা চলে যেত সেই স্বপ্ন-পুরীর এক অচিন রাজ্যে। ওই পুরোনো স্মৃতিগুলো তাকে আজও বড়ো কষ্ট দেয়।

সেই পুরোনো রাস্তা, লোদি গার্ডেন, ইন্ডিয়া গেট, যেখানে সে মৌ-এর হাত ধরে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছে সেগুলো যেন তাকে দেখে আজও বিদ্রূপ করে আর প্রেমের বদনাম করে বেড়ায়। হঠাৎ একটা বড়ো ভমিকম্পে মনে হল ওদের স্বপ্নের প্রাসাদটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

পলাশ দিল্লি থেকে ফেরার আগে মৌ-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ওর দেখা পায়নি। জানতে পেরেছিল ওরা সরোজিনীনগর থেকে অন্য কোথাও শিফট করে গেছে। এর

দু-একদিনের মধ্যেই পলাশকে কলকাতা ফিরতে হয়েছিল চাকরিতে জয়েন্ট করার তাগিদে। এরপরও পলাশ দুবার দিল্লি গেছে মৌ-এর খোঁজ নিতে কিন্তু মৌ-এর খোঁজ পায়নি। হয়তো মৌ-ও তাকে খুঁজে বেড়িয়েছে এদিক সেদিক।

মৌ-কে সে একদিন খুঁজে বার করবেই এই আশায় আজও সে বিয়ে করেনি। তার স্থির বিশ্বাস পলাশ একদিন মৌ-কে খুঁজে বের করবেই। কিন্তু আজ এ কী দৃশ্য সে দেখল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। একটিবার যদি মৌ-কে বলতে পারত এই আশায় আজ বুক বেঁধেছিল। মৌ-কে বলবে ঠিক করেছিল যে, এবার সে আর মৌ-কে ওর থেকে দূরে সরে যেতে দেবে না।

ও বড়ো ছেলেমানুষি করত। দরকারের থেকে বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। আনন্দ হলে বাচ্চাদের মতো খুশি হতো। ওদের বাড়ির বাগানটা ছিল খুব বড়ো, উদ্যান বলা চলে। কোথাও ফুলের কেয়ারি, কোথাও ফলের গাছ, কোথাও আবার এমনিই জংলা।

পলাশ মাঝে মাঝে বলত, মালি এনে জায়গাটা পরিষ্কার করে ভালোমতো সাজানো বাগান করার কথা। যদিও সে পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেয়নি। মৌ ওই আধ-বুনো বাগানটাকেই বেশি ভালোবাসত।

পলাশের স্পষ্ট মনে আছে, একবার ওদের বাড়ি গিয়ে দেখল, মৌ বাগানের একটা শ্যাওলা ধরা বড়ো পাথরের ওপর বসে, হাতে আচারের বয়াম নিয়ে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছে নিজের মনেই।

একবার সন্ধেবেলা পাণ্ডব কেল্লার কাছে বোটে চেপে আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল পলাশকে। খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারত। আবৃত্তি করতে করতে হারিয়ে যেত এক অচিন রাজ্যে।

একবার ছুটির দিনে ভোরবেলা বেড়াতে বেরিয়ে দুজনে খুব আনন্দ করেছিল। দিল্লির রাস্তার দুপাশে চিরহরিৎ গাছের সারি, পাতার ফাঁক দিয়ে মৌ-এর মুখে যখন সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়ত, তখন কী সুন্দরই না লাগত তাকে।

রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কোনও ভিখারি নজরে পড়লে দৌড়ে গিয়ে মৌ তাকে সাহায্য করে আসত। কখনও কখনও যে দুজনের মধ্যে মান-অভিমানের পালা চলেনি তেমন নয়। তবে নিজেরাই তা মিটিয়ে ফেলত। কখনও একজন আরেকজনকে ছেড়ে থাকতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।

একবার পলাশ মজা করে মৌ-কে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা তুমি প্রেম বলতে কী বোঝো?

তার উত্তরে মৌ যা বলেছিল, তা পলাশ আজও মনে করে নিজের মনেই হাসতে থাকে।

মৌ বলেছিল, প্রেম অনেকরকম হয়। তবে জীবনের প্রথম প্রেম সকলের কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাকে। প্রথম প্রেমের কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই। অনেকের বেলায় খুব কম বয়সে প্রথম প্রেম এসে থাকে। প্রথম প্রেম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসলে প্রেম হয় না, সেটা হয়ে থাকে ইনফ্যাচুয়েন। প্রথম প্রেম হতে পারে কোনও বাল্যবন্ধু, হতে পারে গৃহশিক্ষক বা স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষিকা, হতে পারে বয়সে বড়ো কোনও ব্যক্তি, হতে পারে কোনও ফিল্মের নায়ক বা নায়িকা, হতে পারে পাড়ার কোনও হ্যান্ডসাম তরুণী বা বড়ো দাদার বয়সি কোন লোক।

—আরেকরকম প্রেম হল Love at First Site অর্থাৎ প্রথম দেখাতেই প্রেম। এ ধরনের প্রেম অবশ্য একতরফাই হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রেম বেশি দেখা যায়। এই প্রথম দেখাটা বিয়ে অনুষ্ঠানে, শপিং মল-এ, কলেজে, ইউনিভার্সিটি-তে, কোচিং সেন্টারে, স্যারের বাড়িতে বা বন্ধুদের আড্ডা-তেই বেশি দেখা যায়। এ ধরনের প্রেমে অবশ্য বন্ধুদের বা বড়োদের সাহায্যের দরকার পড়ে। এ ধরনের প্রেমের সূত্রপাত রূপ সৌন্দর‌্য ও দৈহিক সৌন্দর‌্যের ভমিকাই বেশি।

—বাব্বা, এসব শুনে তো মনে হচ্ছে, তুমি প্রেম নিয়ে ডক্টরেট করেছ!

—আরও আছে মশাই। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। এই ধরনের প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেমিক ও প্রেমিকা দুজনেই প্রথমে বন্ধু থাকে।

এক রাতের প্রেম এগুলোকে প্রেম বললে পাপ হবে। নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে ছেলেরাই এ ধরনের প্রেমের আযোজক। দৈহিক বাসনাকে পূর্ণতা দেওয়াই এই প্রেমের প্রধান উদ্দেশ্য।

বিবাহোত্তর প্রেম এই প্রেমে শুধুমাত্র স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যা দেখা যায়। বিয়ে ঠিক পর পর প্রথম কয়েক মাস এই প্রেম প্রবল থাকে।

পরকীয়া প্রেম এটা নিয়ে আর নাই বা বললাম। এটা সবাই জানে।

না বুঝেই প্রেম সাধারণত এ ধরনের প্রেম স্কুল-পডুয়াদেরই হয় বেশি।

কর্মক্ষেত্রে প্রেম এটাও তোমাদের কাছে অজানা নয়। আজকাল তো মোবাইলেও প্রেম হয়। ইন্টারনেটে ও সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমেও প্রেম হচ্ছে। সেখানে ধোঁকাও হচ্ছে খুব বেশি।

—তুমি বরং এ নিয়ে একটা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি করে ফেলো। ভালো নম্বর পাবে।

এসব পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে মনটা বড়ো উদাস হয়ে যায়।

এখনও পলাশ মাঝে মাঝে মৌ-এর কথা ভাবতে ভাবতে প্রায়ই আনমনা হয়ে যায়। এটা অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার, অবস্তিও অনেকদিন লক্ষ্য করেছে। তাই সে একদিন পলাশকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, আচ্ছা, স্যার আপনার মনের মধ্যে মনে হয় অনেক দুঃখ জমে আছে। আপনাকে মাঝে মাঝেই আনমনা হতে দেখি। কারও সঙ্গে মনের কথা ভাগ করে নিন, নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবেন। প্রতিবারই পলাশ এর উত্তর না দিয়ে কোনও না কোনও বাহানায় এড়িয়ে গেছে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল অবস্তির ডাকে।

অবস্তি বলল, স্যার, এবার আপনি বাড়ি যান। আমি ডিনার করে ফিরেছি।

পলাশের শরীরটা কেমন যেন ভারী লাগছিল। কিছুতেই দাঁড়াতে পারছিল না। টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

অবস্তি পরীক্ষা করে দেখল পলাশের নিথর দেহটায় আর প্রাণ নেই। আচানক স্ট্রোকে একটা সুস্থ লোকের এভাবে চলে যাওয়াতে, সারা স্টেশন চত্বরে এক শোকের ছায়া নেমে এল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...