॥ ২ ॥

তখন ক্লাস নাইনে পড়ে অবন্তী। শরীর বাড়ছে চন্দ্রকলার মতো। আর তত সুন্দর হচ্ছে প্রতিদিন। শ্রাবণের পুকুর টইটুম্বুর হয়ে উঠছে। সন্ধেবেলা স্কুল থেকে এসে স্নান সেরে গান নিয়ে বসলে জ্যোত্স্না গড়িয়ে পড়ে গা বেয়ে।  ফাল্গুনী ছোটোবেলা থেকেই ওদের বাড়ি যায়। অতনুর বন্ধু হিসেবে। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা হয় অবন্তীর সাথে। কোনওদিন বসে গানও শোনে। তবে আগের মতো আর পিছনে লাগে না। যেমন লাগত ছোটোবেলায় ক্যারাম খেলার সময়।

ইদানীং ফাল্গুনীর, অবন্তীর সামনে এলে একটা জড়তা আসে। সব কাজ, কথা, অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সব কিছুই ভেবেচিন্তে সুন্দর করে বলতে চায় বা করতে চায়। যাতে অবন্তীর ভালো লাগে। ফাল্গুনী বোঝে না এটা কী প্রেম না পূর্বরাগ?

এর মধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোল। প্রথম একশো জনের মধ্যে জায়গা হল ফাল্গুনীর। চোখধাঁধানো রেজাল্ট। অতনু ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। ফাল্গুনী পরেরদিন অতনুদের বাড়ি গেল। অতনুর বাবা-মা তো ভীষণ খুশি। জিজ্ঞেস করল, এবার কী নিয়ে পড়বে?

—যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়রিং-এ চান্স পেয়েছি, তবে আমি প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স নিয়ে পড়ব।

অতনুর ঘরে ঢোকার মুখে সিঁড়ি আর বারান্দার মাঝামাঝি অবন্তী হঠাৎ হাতটা চেপে ধরল। শাসনের সুরে বলে উঠল অনেকটা মায়েদের মতো, চান্স পেয়ে ইঞ্জিনিয়রিং পড়বে না কেন?

—অপদার্থরা পদার্থ নিয়ে পড়ে।

—সবসময় ফাজলামি। আড়ি যাও, কথা বলব না।

ওরা দুজনেই বুঝল না, সেইদিন ওদের ভাব হওয়া শুরু হল। ধীরে ধীরে দুটো পবিত্র মন কাছাকাছি আসতে লাগল। দিনটা ছিল দোলের দিন। অতনুর কেমিস্ট্রি অনার্স। বিদ্যাসাগর কলেজ। ওরা একসাথে অঙ্ক করছে অতনুর দোতালার ঘরে। ফাল্গুনীর খুব ইচ্ছে করছে একবার অবন্তীকে দেখতে। অনুকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। অবন্তী ইচ্ছে করেই এ ঘরে আসছে না। হঠাৎ অতনু বলল, যাই নীচে থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসি। বলে বেরিয়ে গেল।

সুযোগের অপেক্ষায় ছিল অবন্তী। হাতে আবিরের থালা নিয়ে ঢুকল। ফাল্গুনীর দুগালে আবির মাখিয়ে দিল। তারপর চোখের এত ছোটো মৃদুকম্পনে বোঝাল আবির মাখানোর আবদার, সেটা বিশেষ সম্পর্ক না থাকলে বোঝার উপায় নেই। ফাল্গুনী আবির নিয়ে ওর মাথায় মাখিয়ে দিল। অবন্তী দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। একদৌড়ে আয়নার সামনে। এই প্রথম অবন্তীর নিজেকেই আয়নার ভেতর থেকে বার করে খুব আদর করতে ইচ্ছে করল। প্রেমের দেবতা বোধহয় জীবনের কোর্টে খেলা শুরু দিলেন। মনে মনে বললেন লভ অল। আসলে তা শূন্য-শূন্য। বছর দুই গুছিয়ে প্রেম করল ওরা।

॥ ৩ ॥

অবন্তীর এখন ক্লাস ইলেভেন। গরমের ছুটি। হঠাৎ একদিন পেটের নীচের দিকে অসহ্য ব্যথা। কিন্তু পিরিয়ডের ডেট তো এখনও হয়নি। ভাবল গ্যাস অম্বল। সবাই যা ভাবে, কিন্তু ব্যথাটা বাড়ছে।

সন্ধেবেলা ডাক্তার দেখাতে গেল। ফাল্গুনীর আজ পড়ায় মন বসছে না। রাতে একটা অঙ্কের ছুতো নিয়ে গেল অনুদের বাড়ি। গিয়ে শুনল, একটা ইউএসজি করতে দিয়েছে। আর ব্যথা কমার ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। একটা ওষুধ খাবার পর ব্যথা অনেক কম। নিশ্চিন্ত হল ফাল্গুনী। দুদিন পর ধরা পড়ল অ্যাপেন্ডিসাইটিস। এই বয়সি মেয়েদের সাধারণ রোগ। আজকাল ফাল্গুনীরর অবন্তীকে তুই বলতে মুখে বাধে। আবার সবার সামনে তুমি বলতেও লজ্জা লাগে। কারণ সেটা আশির দশক। আজ ওসব সমস্যা নেই।

নার্সিংহোমে ভর্তি হল অবন্তী। সবরকম পরীক্ষা হবে, তারপর অপারেশন। জানে ছোটো অপারেশন, তাও ওইদিন টেনশন হচ্ছিল ফাল্গুনীর। অপারেশনের পর বেডে দিল অবন্তীকে। প্রসাধনহীন গোলাপি ওষ্ঠ, ঈষৎ পীতাভ ফরসা চিবুকে চোখের কোণ থেকে বেয়ে আসা শুকনো একটা জলের রেখা। অজ্ঞান হবার আগের মুহূর্তে কষ্টের প্রকাশ। ফাল্গুনীর বুকে একটা মোচড় দিল। সবাই রয়েছে, তাও হাতটা নিশপিশ করে উঠল, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার জন্য। নার্স এসে সবাইকে বার করে দিল। ভিজিটিং আওয়ারে একজন করে আসতে বলল।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...