আজ শনিবার। অবন্তীর সেবালয়-মঠে যাওয়ার দিন। মেডিটেশনের ক্লাস আছে। মাঝেমধ্যে আধ্যাত্মিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে কিছু লেকচারও শোনে। অনেক কঠিন বক্তব্য সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় সেখানে। যেমন একদিন শুনছিল, পৃথিবীর সব কিছু যেমন সোনা, লোহা, গাছপালা সব প্রাণী এমনকী মানুষ-ও প্রটোন, নিউট্রন, ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি। তা-ও কত হানাহানি, মারামারি, কত লড়াই, ছলচাতুরী। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সেই কণাতেই সব কিছুর চির সমাপ্তি। সময় বলে কিছু নেই। মহাকাশে তা সব অসীম, অনন্ত। বেশ লাগে অবন্তীর।

ফাল্গুনী বরাবরই ভালো বক্তা। আবৃত্তিও ভালো করত। পড়াশোনায় বেশ ভালো। পদার্থবিদ্যা ওর বিষয় ছিল। তবে মঠে আসার পর যেটা হয়েছে, সেটা হল শরীরের জৌলুস। একটা আলাদা দীপ্তি। গোধূলির আকাশে যে আভাটা দেখা যায়। গেরুয়া বস্ত্রে গাল দুটো মনে হয় আবির মাখা দুধে-আলতা। সত্যিই যেন ভগবানবুদ্ধ।

আজ একটু গঙ্গার ধারে বসতে ইচ্ছে করছে অবন্তীর। কারণ আজ রাখিপূর্ণিমা। ওইদিন প্রথম, জীবনে প্রথম ফাল্গুনীকে অপমান করেছিল অবন্তী। তখন ওর গানের সাথে বিকেলে তবলা বাজাতে আসত মৈনাক। চালাক ধূর্ত মেয়েপটানোর মাস্টার। দেখতে সুন্দর না হলেও একটা চটক ছিল। আর ছিল জামা-কাপড়, সাজের বাহার।

ফাল্গুনী মাঝেমধ্যে আসত অবন্তীর কাছে কিছু বাংলা লেখা নিয়ে সেটা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, মূল লক্ষ্য ছিল দেখা করা। বাড়িতে ঢোকার ছাড়পত্র হল অবন্তীর দাদা অতনুর বন্ধু ছিল ফাল্গুনী। সেদিন গানের রেওয়াজ করার সময়ে ফাল্গুনী উপস্থিত। অবন্তী ইচ্ছে করেই হারমোনিয়াম নিয়ে মৈনাকের পাশে বসল। ফাল্গুনীর দিকে মিষ্টি হেসে ওকে আটকে রাখল।

ফাল্গুনীর মনে তখন সমগ্র পৃথিবী আর অবন্তীর মধ্যে বাছতে বললে ও অবন্তীকেই বেছে নেবে। ভরা শ্রাবণে গান শুরু হল শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনীরে…। রাগ পিলু-মল্লার। তখন অবন্তী একাদশে পড়ে। বয়স সতেরো হবে। গানটির তাল ত্রিতাল। ষোলো মাত্রার তাল। বেশ কঠিন। তালের ঠেকা, ধা ধিন ধা। ধা ধিন ধিন ধা। না তিন তিন না। তেটে ধিন ধিন ধা।

অবন্তী সেদিন পরেছে লাল টুকটুকে টপের নীচে জাম রঙের গাঢ় স্কার্ট। একটু উঠে আছে জঙ্ঘার ওপর। ফাল্গুনী আড়চোখে দেখল মুলতানি মাটির মতো কোমল উন্মুক্ত সেই ত্বকের ওপর তবলা থামিয়ে মৈনাক হাত দিয়ে তালটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। মৈনাকের হাতটা ঊর্ণনাভর মতো অবন্তীর জানুর বেশ খানিকটা ওপরে খেলা করছে। আর ফাল্গুনীর মনে হল অবন্তীর ধানের তুষের মতো অদৃশ্য সোনালি রোমগুলো শিহরিত হচ্ছে।

হিসাব মিলছে না ফাল্গুনীর। ফাল্গুনী বুঝল অবন্তীর প্রশ্রয় আছে। মনের কোণে যে-কষ্টের ধূমযোনি জমল, তা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হতে লাগল। অঙ্ক বিজ্ঞান সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ও আর থাকতে পারল না। বাধ্য হয়ে বলে ফেলল, এবার উঠি।

অবন্তী মুচকি হেসে বলল, দাঁড়াও রাখিটা পরে যাও।

ফাল্গুনীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তা-ও মৈনাকের সামনে নিজেকে সামলে নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল। দুবছর ধরে চুটিয়ে প্রেম করছে অবন্তী আর ফাল্গুনী। এই দুবছরে, গত বছর বিজয়া দশমীর দিন ছাদের ঘরে অবন্তী প্রণাম করার পর, ফাল্গুনী শুধু কপালে একটা চুমু খেয়েছিল। উত্তরে অবন্তী ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, যাবে না কিন্তু, মিষ্টি খেয়ে যাবে।

ফাল্গুনী হেসে উত্তর দিল, এরপরে আবার মিষ্টি! মুখ নষ্ট হয়ে যাবে তো।

—ধ্যাৎ, অসভ্য!

সেদিন বোধহয় একটু অসভ্য হতে বলেছিল ফাল্গুনীকে। আসলে অবন্তী ভীষণ ভালো মেয়ে সুন্দরী সরল এক সাদাসিধে মেয়ে কোনও জটিলতা ওর চোখে নেই। ফাল্গুনী চায় ওকে রাজার মতো আদর করতে। গোপনে লুকিয়ে নয়। তাই সবকিছু হৃদয়ে গোপন প্রকোষ্ঠে তুলে রাখতে চায়। সেটা অবন্তী বোঝে। প্রেমের সততা মেযো বুঝতে পারে। তাই ফাল্গুনী তার প্রাণের থেকেও প্রিয়। কষ্টিপাথরে ফেললে দুজনেই খাঁটি সোনা। তবুও সেদিন অবন্তী ওইরকম করল কেন? সেই গল্পই আজকে বলব।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...