দিন-রাতের শেষ ট্রেনটা যখন চন্দনপুর স্টেশন ছেড়ে চলে গেল তখন একটা হাঁফ ছেড়ে বৈদ্যনাথবাবু দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালেন— রাত ন’টা বেজে পাঁচ মিনিট। বহুদিন পরে ট্রেনটা প্রায় ঠিক সময়ে স্টেশন ছেড়ে গেল। বৃষ্টিটা কমেছে এখন। সারাদিন ধরে আজ ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল।

পয়েন্টস ম্যান হারান মণ্ডল কেরোসিনের সিগনাল ল্যাম্প-টা হাতে নিয়ে ঢুকল। ‘বৃষ্টিটা একটু ধরেছে মাস্টারবাবু; চলুন এবার বন্ধ করুন দোকানপাট।’

—হ্যাঁ, চল, বলে খাতাপত্র বন্ধ করলেন বৈদ্যনাথবাবু। ম্লান হেসে চশমার কাচ পরিষ্কার করলেন শার্টের আস্তিনে। আজ মেল- টা লেট করেনি অনেকদিন পরে।

ঘাড় নেড়ে সামান্য হেসে হারান মণ্ডল বলল, ‘হ্যাঁ আজ ঠিক সময়ে চাট্টি গরম ভাত ভাগ্যে জুটবে।’

হারান ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করল। পিছনের দরজা দিয়ে কোয়ার্টারে চলে যাবে। মাস্টারবাবুর কোয়ার্টারেরই একটা ঘরে থাকে হারান। বৈদ্যনাথবাবু লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘বাইরের লাইটটা জ্বলছে তো?”

ঘাড় নাড়ল হারান মণ্ডল৷

—চল, বলে এগিয়ে গেলেন বৈদ্যনাথবাবু। এমন সময় প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজায় মৃদু টোকা পড়ল।

বিরক্ত হল হারান। এই অসময়ে আবার কে এল? অবাক হয়ে বাইরের দিকে তাকালেন বৈদ্যনাথবাবু।

হারান মণ্ডল দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই বাইরে থেকে ভরাট গলায় আওয়াজ এল, ‘দয়া করে দরজাটা খুলুন।’ বৈদ্যনাথবাবু ইশারা করলেন।

দরজা খুলতেই দেখা গেল আগম্ভক মাঝবয়সি, প্রায় ছ’ফুট লম্বা সম্ভ্রান্ত সুপুরুষ। হালকা ফ্রেমের অন্তরালে উজ্জ্বল একজোড়া চোখে সাগরের গভীরতা।

—ভিতরে আসতে পারি? দরজায় ভারী গলার আওয়াজ।

বৈদ্যনাথবাবু দু’পা এগিয়ে এসে আমন্ত্রণ জানালেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন।’

আগন্তুক কোনও ভণিতা না করে ভিতরে ঢুকে বললেন, ‘আপনাদের অসুবিধায় ফেলার জন্য ভীষণ দুঃখিত! ঠিক জানা ছিল না, গাড়িতে এক ভদ্রলোক বললেন এখানে নামলে বলরামপুর কাছে পড়বে আর বাস বা অন্য গাড়ি পেয়ে যাব। কিন্তু এখন দেখছি এখানে কোনও গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যাবে না।’ বৈদ্যনাথবাবু আগন্তুককে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

—এখান থেকে বলরামপুর কাছে বটে কিন্তু আগের জংশন স্টেশনে নামলে ওখান থেকে রাতের বাসটা বা হয়তো শেয়ারের ট্যাক্সিও পেয়ে যেতেন।

পকেট থেকে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটি সিগারেট নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে, প্যাকেটটা বৈদ্যনাথবাবুর সামনে এগিয়ে ধরলেন। বৈদ্যনাথবাবু হাতজোড় করে স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন, ‘আমার চলে না।’

আগন্তুক সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে হাত জোড় করলেন, ‘আমি অমিয়নাথ গাঙ্গুলি, যাব বলরামপুর। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তা নাহলে রাতটা প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতেই কাটিয়ে দেওয়া যেত।’

বৈদ্যনাথবাবু লজ্জা পেয়ে জিভ বের করে বলে উঠলেন, “আরে না না, তাতে কী হয়েছে, পেছনেই আমার ডেরা। চলুন ওখানেই কষ্ট করে রাতটা না হয়…!’

—খুব খারাপ লাগছে। আপনাদের অযথা কষ্ট দিলাম। আন্তরিক বিনয়ের সঙ্গে বলে অমিয়নাথ কাঁধের ছোটো ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

—ছি ছি এমন করে বললে সত্যি সত্যিই নিজেকে অপরাধী বলে মনে হবে! বৈদ্যনাথবাবু জিভ কাটলেন।

গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে কয়েক পা হেঁটেই স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টারে চলে এলেন, ‘আসুন স্যার’ বলে একটা নড়বড়ে হাতভাঙা চেয়ার এগিয়ে দিলেন বৈদ্যনাথবাবু। পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি বৈদ্যনাথ দে৷ এই পাণ্ডববর্জিত স্টেশনের চাকুরে, পরিবারের অন্যান্যরা কলকাতায় থাকে, তাই ওই হারান মণ্ডলই আমার সেবক, পাচক, মালি আবার স্টেশনের পয়েন্টসম্যান। তাই ও যেমন ‘অল ইন ওয়ান’ আমিও তেমনি ‘ওয়ান ইন অল।” নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলেন বৈদ্যনাথ দে।

ছোটো কোয়ার্টারের ততোধিক ছোটো রান্নাঘর থেকে কেরোসিন স্টোভের সোঁ সোঁ আওয়াজ আসছিল। হারান রান্না চাপিয়েছে।

—পঁচিশ বছরে বিশেষ পরিবর্তন দেখছি না এখানের। জানালার বাইরে তাকিয়ে মন্তব্য করল অমিয়।

বৃষ্টিটা ততক্ষণে বেশ জোরে পড়তে আরম্ভ করেছিল, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা বাইরে ছুড়তেই ছ্যাঁত করে আওয়াজ তুলল।

জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে খুব আলতো করে বলল অমিয়, ‘বলরামপুরের গাঙ্গুলিদের নাম শুনেছেন?

—না, মানে আমার তো এখানে বেশিদিন হয়নি। আমতা আমতা করতে লাগলেন বৈদ্যনাথবাবু।

হঠাৎ হারান রান্নাঘর থেকে প্রায় দৌড়ে এসে হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে বলে উঠল, ‘অপরাধ মাফ করবেন! কত্তা কি জমিদার বাড়ির বড়ো ছেলে? যিনি …’ ইতস্তত করতে লাগল হারান।

ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অমিয়নাথ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমিই জমিদার শঙ্করনাথ গাঙ্গুলির বড়ো ছেলে অমিয়নাথ। বাবার সঙ্গে মতের অমিল হওয়াতে বাড়ি আর দেশ দুটোই ছেড়েছিলাম।’

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...