—হ্যাঁ। তোর লজ্জা লাগে না দাদা। মা অসুস্থ, তা সত্ত্বেও তুই…
—বেশি বাহাদুরি তোর! এবার কোথায় যাবি? মেরে আজ হাড়গোড় ভেঙে দেব।
—আমি আবার থানায় যাব।
—কথাগুলো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই অর্পিতার ডান গালে একটা থাপ্পড় এসে পড়ল। মাথাটা ঝনঝনিয়ে উঠল। কিছু বোঝার আগেই আরেকটা থাপ্পড়। পাশের ঘর থেকে মেজদি বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “দাদা!”
অর্পিতাও আচমকা দাদাকে লক্ষ্য করে সটান হাত চালিয়ে দিল। হাত পড়ল দাদার গালে। চমকে উঠল দাদা। ‘তবে রে’ বলেই অর্পিতাকে আবার মারতে গেল। অর্পিতা সরে গেলেও টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ল রান্নাঘরের মেঝেতে। দাদাও নিজেকে সামলাতে না পেরে সটান গিয়ে পড়ল ছোটবোনের ওপর। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জামাইবাবুও এলোপাথাড়ি লাথি মারতে আরম্ভ করল। বড়দি আর বউদি চেপে ধরে রইল মেজদির মুখ, হাত।
ঘুমের ওষুধ খেয়ে বিছানাতে পড়ে থাকা মা টলমল পায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। বুঝতে পারল না ঠিক কী করা যেতে পারে? রান্নাঘরের মেঝেতে তখন অর্পিতার শরীরের ওপর শুয়ে নিজের শক্তি প্রয়োগ করছে দাদা, দুটো পা ধরে আছে জামাইবাবু। অন্ধকার শুষে নিচ্ছিল সম্পর্ক, নিস্তব্ধতা শুষছিল গোঙানি।
মা জোরে বলে উঠল, ‘বাবু! একি করছিস তুই, ও যে তোর ছোটো বোন!”
ততক্ষণে দাদার ঘামের সঙ্গে মিশে গেছে ছোটবোনের চোখের জল। মায়ের গলা শুনেই দাদা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বাগানে নামল, পিছনে একে একে নেমে গেল জামাইবাবু, বউদি, বড়দি। কারওর মুখে কোনও কথা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার গাড়ির আওয়াজটা শোনা গেল৷
মেজদি, বউদিদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েই অর্পিতার কাছে গিয়ে জলের ঝাপটা দিল। তার জামাকাপড় অবিন্যস্ত। কিছুটা ঠিক করে, দরজার কপাট ধরে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে ধরে ধরে বিছানাতে বসিয়ে বাগানে বেরিয়ে জোরে জোরে চেল্লাতে আরম্ভ করল, ‘বাঁচাও… বাঁচাও!’
আরও অন্ধকার নেমে এলেও বাগানে লোকজনের ভিড় বাড়তে লাগল। কেউ কেউ বলল, ‘আমরা ভাবছিলাম এমনি ঝামেলা হচ্ছে। ছেলেটা তো এর আগেও কয়েকবার এসেছিল। কিন্তু শেষকালে যে নিজের বোনকে এমন করবে! ছিঃ ভাবতে পারা যাচ্ছে না।’
খোঁড়াদাও ভিড়ের মধ্যে এসে সোজা ঘরের ভিতর চলে এল। অর্পিতা তখনও রান্নাঘরের মেঝেতেই অর্ধ অচৈতন্য হয়ে শুয়েছিল। পাড়ার কয়েকজন বউদি কাকিমা ধরাধরি করে অর্পিতাকে ভিতরের ঘরে শুইয়ে দিয়ে এল। মেজবোনেরও ঠোঁট, গাল কেটে গেছে। একজন মহিলা ওষুধ লাগিয়ে দিল। পাড়ার একজন নেতা গোছের লোক অর্পিতার মায়ের কাছে এসে বলে, ‘কাকিমা মানে পুলিশে কি খবর দেব, নাকি মিটিয়ে…’
ওনাকে মাঝখানেই থামিয়ে অর্পিতার মা কাঁপা গলায় বলে ওঠে, ‘না, পুলিশ ডাকো। আমার নিজের ছেলে এই বাড়ি হাতানোর জন্যে আমার ছোটো মেয়ের সর্বনাশ করছিল। আমি চুপ থাকলে সবার ক্ষতি হয়ে যাবে।’
কথাগুলো শেষ করেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিল। বাকি চোখগুলো আর কেউ দেখতে পায়নি, পাবেও না।
সমাপ্ত