প্রাথমিক ধাক্কার আবেগে আমি তখন ভাঙছি। আমার ভারতীয়বোধ গুঁড়ো গুঁড়ো আবিরের মতো ছড়িয়ে পড়ছে গ্লোবালাইজেশনের নিরিখে। ডিলান আমাকে ধরে ক্রুজের ভেতর বিশাল লবির একটা জানলার পাশে নিয়ে বসাল। জানলাম ডিলানের বেশ কয়েকজন ভারতীয় আর্টিস্ট বন্ধু আছে, তাই ভারতমাতা শব্দটির সাথে সে বেশ পরিচিত। ডিলান ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলে বাকিটা ইটালিয়ান ভাষা।

আমি প্রমাদ গুনলাম সর্বনাশ কীভাবে কথা বলব! হঠাৎ ক্রুজের জানলা দিয়ে দেখি লেকের ঠিক মধ্যিখানে একটা বিশাল জলের ফোয়ারা আর সেটাকে ঘিরে কম বয়সি ছেলেমেয়েদের একটা গ্রুপ স্পিডবোট নিয়ে দারুণ সব রাইড করছে। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির ফ্লেভার সত্যিই অন্যরকম। একটু অন্যমনস্ক হয়েছি ব্যথার জন্য। কোঁকড়া চুল আর নীল চোখের ডিলান দু’হাতে দুটো সুইস আইসক্রিম নিয়ে এসে উপস্থিত। আমি ইংলিশে প্রাণপণে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে খাব না। তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে কাউন্টারে গিয়ে জানলাম ক্রুজ অথরিটি স্পনসর করছে আজকের এই আইসক্রিম। সুইস আইক্রিমের অপার্থিব স্বাদ চিরকাল মনে থাকবে। আইসক্রিম, পেস্ট্রিতে আমি নির্লজ্জের মতো লোভী।

বাঁ হাতে টিস্যু পেপারে রক্ত মুছে ডান হাতে আইসক্রিম খাচ্ছি আর মনে মনে সুইজারল্যান্ডের দুধেলা গরুগুলোর তারিফ না করে পারছি না।

ক্রুজে উঠতে গিয়ে কলিশন বেশ ভালোই হয়েছে। ডান হাঁটুতে ছড়ে গিয়ে একটু ব্লিড করেছে। আমার পরিহিত ফাটা বয়ফ্রেন্ড জিন্স-এর ফাঁক দিয়ে বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে ক্ষত। সেটা দেখে ডিলান দৌড়ে গিয়ে বার কাউন্টার থেকে হ্যান্ড টাওয়েলে মুড়িয়ে আইস কিউব নিয়ে এসে পাশে বসে সোজা আমার হাঁটুতে চেপে ধরল। একটু থতমত খেলাম, প্রথমে প্রচণ্ড পেইন হলেও আস্তে আস্তে সয়ে গেল। আমি তো লজ্জায় একশেষ!

কী হচ্ছেটা কী আমার সঙ্গে যাচ্ছেতাই। বেশ কিছুক্ষণ পর ডিলান কে বললাম, “প্লিজ এনাফ ইজ এনাফ, লিভ মাই লেগ, প্লিজ।’ একটা অপরাধবোধের হাসি দিয়ে আস্তে করে আমার পা ছেড়ে দিয়ে টাওয়েল ফেরত দিয়ে এসে ডিলান আমার টেবিলের উলটো দিকে বসল। ততক্ষণে ক্রুজ চলতে শুরু করেছে। চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য, নীলপাহাড়, লেকের জলে অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপের প্রতিবিম্ব এঁকেছে।

আমার চোখের নজরের ফুট দেড়েকের মধ্যেই এক অতীব সুন্দর লম্বা ইটালিয়ান পুরুষ বসে আইক্রিম খাচ্ছে। আমি দেখছি সেও দেখছে। মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা চলছে সেই ভাঙা ইংরেজিতেই। ডিলান আমার নেক্সট ডে-র প্রোগ্রাম জানতে চাইলে আমি বললাম, রেহিইন রিভার ফলস। শুনে সে আবদার করে বসল আমি যদি কিছু মনে না করি তবে সেও যাবে আমার সাথে রেহিইন ফলস দেখতে। আমি ভাবলাম আমার এই একলা সফরে এ আবার কী গেরো! সায়ন, নীপা কী ভাববে? তারপর ভাবছি— কই আমার বেটার হাফ বাইরে গেলে তো কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এই প্রোগ্রেশনের যুগে দাঁড়িয়ে এত সংকোচ, দ্বন্দ্ব নিয়ে আমার মাত্র দুই দিনের একলা সফরকে স্পয়েল করার কোনও মানেই হয় না।

নীপাকে একটা কল করে ব্যাপারটা বললাম কারণ আপাতত ওরাই গার্জেন। ‘নীপা, শোন পেশায় প্রোফেশনাল আর্টিস্ট অ্যান্ড ফোটোগ্রাফার ইটালির ছেলে ডিলানের সাথে আলাপ হয়েছে। বয়স বুঝতে পারছি না বাট ও আমার সাথে রেহিইন (রাইন) ফলস যেতে চাইছে। সো হোয়াট টু ডু?’

নীপা হা হা করে হেসে ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলল, “একটা ভিডিও কল কর তো একটু দেখি ইটালিয়ান হিরোকে।” করলাম ভিডিও কল নীপা নিজেই কথা বলে ফাইনাল করে দিল কালকের প্রোগ্রাম। শুধু হাঁটুর ব্যাপারটা চেপে গেলাম। নীপার গলা শুনে মনে হল ও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আমার একদম একা একা রাইন ফলসে যাওয়া একটু চাপের ছিল। বললাম, ওকে ডিলান সো লেটস মুভ ফরওয়ার্ড ট্যুমরো।’

পরদিন সকালে সুন্দর হলুদ রঙের ফ্লোরাল প্রিন্টের শিফন জর্জেটের শাড়ি পরে নিলাম। নিজেকে বিদেশের মাটিতে স্বাধীন মহারানির মতো লাগছে। কারও ফুটকাটা নেই! বাবা কত্ত মাঞ্জা দিয়েছিস বলার কেউ নেই! পুরো বল্লে বল্লে।

ডিলান তো আমায় শাড়িতে দেখে এতটাই মুগ্ধ যে, চোখ সরাতে পারছে না। বলল ‘আই হ্যাভ নেভার সিন দিস টাইপ অফ ড্রেস ইন মাই লাইফ।’ বেচারা, ওর কাছে তো সবই ড্রেস! ভারতীয় শাড়ির আভিজাত্য যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই বোঝাতে চেষ্টা করলাম ডিলান কে। প্রচুর ফোটো সেশান হল। একবার নবনীতা দেবসেনের লেখায় পড়েছিলাম তুন্দ্রার তৃণ অভিযানে, উলিকট ইনারের ওপর ফিনফিনে শিফন শাড়ি পরেই তিনি তুন্দ্রায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমারও বাসনা ছিল, তুন্দ্রায় না পারি অন্তত সুইজারল্যান্ডেই পরে নিই শাড়ি। এখানকার লোকজনদের সাথে ভারতীয় শাড়ির একটু জানাশোনা হওয়া দরকার।

নির্দিষ্ট বাসে চেপে ডিলানের সাথে চলে এলাম স্যাফাউসেন-এ রাইন নদীর রেহিইন ফলস দেখতে। টিকিট কাটলাম তুমি না আমি? আমি না তুমির সংঘাতে না গিয়ে। দু’জনেই সমান ভাবে ভাগ করে দিলাম ডলার। একটা মিস্টি ওয়েদার আধা সবুজ জলরং ধরিয়েছে সবদিকে। তার মধ্যে বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব চারপাশকে আরও রোমান্টিক করে তুলেছে। সাময়িক ভাবে ভাষা একটা সমস্যা হয়ে উঠেছিল চিন্তাতে, কিন্তু আজ তো কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। দু’জনেই দিব্যি বুঝে যাচ্ছি কী বলতে বা করতে চাইছি।

টিকিট কাউন্টার থেকে দেখেছি বিশেষ লম্বা এক ধরনের মোটর বোটে করে ফলসের একদম কাছে টুরিস্টদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় আমি দ্বিতীয়বার ভাবলাম না। কাঁধের ব্যাগ জমা দিয়ে টিকিট কেটে লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। শাড়ি পরায় সবাই আমায় ঘুরে ফিরে দেখছে, কয়েকজন তো ছবিও তুলল। সেফটি সিকিউরিটির বজ্র আঁটুনি থাকার পর ‘যোশ মে হোশ খো বৈঠে’। ছিটে ফোঁটা সাঁতার না জানা আমি, ডিলানের হাত শক্ত করে ধরে বোটে উঠে পড়লাম। কিন্তু পাদানিতে পা রাখার পর একটা হিমশীতল ভয় মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল খরস্রোতা নদীটাকে দেখে।

ফিস ফিস করে ডিলানকে বললাম, ‘আই ডোন্ট নো সুইমিং অ্যাট অল।’ ডিলান কী বুঝল কে জানে এক টুসকিতে উড়িয়ে দিয়ে আধা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘ফরগেট অ্যাবাউট সুইমিং,ওয়্যার দ্যা জ্যাকেট অ্যান্ড এনজয় দ্য নেচার।’ মনের চোরাগোপ্তা ভয়কে অন্যত্র চালান করে সান্ত্বনা দিলাম— এমন সুযোগ বার বার আসে না। বোটে উঠে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলাম। আসলে গানের সুর যেমন সারা পৃথিবীর মানুষকে বেঁধে রাখে, ভ্রমণেও বাঁধা থাকে এক মানবিকতার সুর যা আমরা সময় বিশেষে টের পাই।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...