রাইনের কাছে যেতেই ফটফটে সকালের আলো মরে গিয়ে এক সবজে জলছোপের মেঘলা আবহ তৈরি করেছে। আকাশে বৃষ্টির ছিটে ফোঁটাও নেই কিন্তু রাইনের জলোচ্ছ্বাস বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। অনেক উচ্ছ্বাস চেপে রেখে একাকী সফর বৃষ্টি বিলাসী হয়ে উঠল। গোটা জীবনকাল ধরে যাজকের মতো আমার সমস্ত কনফেশন শুনেছে বৃষ্টি। রাইন নদীর মুখরতা প্রবল উচ্ছ্বলতা আবারও ভিজিয়ে দিল শ্রাবণে। ডানা ঝাপটানো সবজে জলে, এটাই কি আমার বৃষ্টি ভ্রমণ পরবাসে? ইহকাল পরকাল শরীরী জল্পনা খোলা পর্দার মতো উড়ে গেল। থেকে গেল মানব মানবীর দৃঢ় বন্ধুত্ব যা চিরকালের। যাতে কোনও ফ্যান্টাসির সেমিকোলন নেই।

স্পিড বোটের চরম দুলুনি আর জলের ঝাপটা খেয়ে ভাবুক মনকে ভিজিয়ে নিয়ে দেখলাম আমি ইষ্টিকুটুম পাখিটি হয়ে রাইনের পাথরে বসার চেষ্টা করছি। ডিলানের কথায় চমক ভাঙল, ভাঙা ইংরেজিতে আমায় দাঁড়াতে অনুরোধ করল। আমি তো পোজ মাস্টারনি আছিই! মিঠে হাসি দিয়ে হলুদ প্রজাপতি হয়ে দাঁড়ালাম এবং খিচিক। ডিলানেরও ছবি তুললাম। ডিলান আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে বুঝতে পেরেছে যে, হাত ছাড়লে আমি ছিটকে জলেও পড়ে যেতে পারি। ডিলান কিন্তু কনফিডেন্সের সাথে বোটের দুলুনি উপেক্ষা করে ক্যামেরায় ছবি তুলে তাকে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে বন্দি করে আমার হাত ধরে অপলক তাকিয়ে থাকল।

বোট এবার আস্তে করে ফলসের মধ্যিখানে ঢুকে গেল যেখানে বোটের ওপর দিয়ে জল ওভার ফ্লো করছে। অথচ আমরা ভিজলেও বোট জলে ভেসে যাচ্ছে না। হঠাৎ ডিলান বলে উঠল যার মানে এই দাঁড়ায়— ‘তোমায় জড়িয়ে ধরলে আমার কোনও ইচ্ছে জেগে উঠবে কি না আমার জানা নেই, কিন্তু আমি তোমার অবিশ্বাসের কারণ হতে চাই না!” বোটের এই প্রচণ্ড দুলুনিতে এইভাবে শুধু হাত ধরে ব্যালেন্স রাখা প্রায় অসম্ভব। মাঝের হাতখানেক গ্যাপ-কে কমিয়ে ডিলানের কাছে সরতেই বোটটা সহসা ডানদিকে হেলে গেল। সবাই হই হই চিৎকার করলেও ডিলান আমাকে সবলে জড়িয়ে ধরে নিল।

আমি যেন অজানা এক ভালোলাগায় ভেসে গেলাম। পাপপুণ্য নৈতিক অনৈতিক সহাবস্থান সব স্মৃতি থেকে ছিটকে ছিটকে খসে পড়ে গেল রাইনের জলে। ডিলানের পায়ের পাতার ওপর উঠে আমি আমার শরীরের ভার ছেড়ে দিতেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেন শূন্য হয়ে গেল। ডিলান আমার ঠোঁটের ওপর ওর ঠোঁট নামিয়ে এনে নিঃশেষে আমার নির্যাস শুষে নিল। ফিশফিশ করে কানে বলল, “ইউ আর আ ভেরি চার্মিং অ্যান্ড বিউটিফুল ইন্ডিয়ান লেডি উইথ দিস সসারি ড্রেস টিটাস!’ কথাগুলো শুনে একপলকের জন্য আমি পৃথিবীর দশটি দিকে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়লাম। সুদূর বাংলাদেশের নদী তিতাস যেন রাইনের জলে মিশে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেতেই সজোরে ধাক্কা দিয়ে ডিলানের থেকে আলগা করতে চাইলাম নিজেকে। পারলাম না বোট তখন সবে রিস্ক জোন থেকে বেরোতে শুরু করেছে।

এতক্ষণে চারপাশে তাকিয়ে দেখি যারা কাপল হয়ে এসেছে, তারা এখনও প্রকৃতির সাথে এবং প্রিয়জনের সাথে প্রেমমগ্ন হয়ে আছে। আমার শিফন শাড়ি, ব্লাউজ, চুল ভিজে গিয়ে একটা ঠান্ডা ভাব ঘিরে ধরেছে। বেসামাল আমাকে হাতে ধরে ডিলান দুলুনি বোটের একটা সিটে বসিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিল। তারপর ভিডিওগ্রাফিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু ছবিতেই কি সব ধরা পড়ে? অনুভবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে অনেক কিছু। জীবনে প্রথমবার আমার একান্ত দুই দিনের একলা বিদেশ সফর শেষ হল রোদেস্টাইনের হালকা আবছা দুপুরে।

চলে এলাম হ্রদের শহর লুজার্নে। আল্পস পবর্তমালার নেকলেস পিস দিয়ে সাজানো লুজার্ন যেন আরও মনোমহী দৃষ্টিনন্দন। হ্রদের জলে অপূর্ব রাজহাঁসের পাল পুটুস পাটুস ডুব দিয়ে একদম পাড়ে উঠে আসছে। আমরা হ্রদের ওপর দিয়ে অন্যতম পুরোনো কাঠের সেতু, চ্যাপেল ব্রিজের ওপর হাঁটা শুরু করলাম। ডিলান বেশ লম্বা তাই আমি পিছিয়ে পড়ছি বারবার আর ডিলান বলছে, ‘কাম অন কাম অন টিটাস।’ শেষে ডিলান আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলো ওর হাতে জড়িয়ে ভারসাম্য রেখে হাঁটতে শুরু করল। হেঁটে হেঁটেই আমরা শহরের ইতিকথা জানলাম। শহরের মধ্যে ঠিক খেলনার মতো এক রেলগাড়িতে চেপে সিটি টুর শেষ করলাম। একটা আস্তদিন নতুন শহর দেখতে দেখতে হালকা পায়ে দিনের ঢাল গড়িয়ে রাতের ঠিকানায় পৌঁছে গেল।

রাত্রিবাস করলাম আমার একার জন্য বুকিং করা নির্দিষ্ট রুমে। ডিলান ওই হোটেলেই অন্য ফ্লোরে অন্য রুমে। আমি সুভেনির শপ থেকে একটা গ্রিটিংস কার্ড কিনে তাতে ডিলানের তোলা আমার সেই হলুদ শাড়ি পরা ছবি এটাচ করে লিখে দিলাম— ‘লাভ অ্যান্ড সুইট মেমরি ইন রেহিইন ফলস — ফ্রম টিটাস রিভার।’

পরদিন সকালে ডিলান একটা খাম দিয়ে বলল, “প্লিজ ওপেন ইট টিটাস।’ খাম খুলেই চমকে গেলাম, —ওমা ডিলান আমার ওই হলুদ শাড়ি পড়া ছবিটাই হাতে এঁকে দিয়েছে অ্যাক্রিলিক কালারে। অপূর্ব, কী যে সুন্দর! আমি জীবনে প্রথমবার নিজেরই অবয়ব দেখে প্রচণ্ড খুশি, যেন সত্যি প্রজাপতি হয়ে গেছি। আমি হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালেও ডিলান সেই হাত ধরে আমাকে জড়িয়ে ইউরোপীয় কায়দায় একটু নীচু হয়ে আমার দু’গালে ঠোঁট ছোঁয়াল।

এক নতুন দেখা দেশে নতুন মানুষের স্পর্শ সারা জীবনের জন্য লেগে থাকল, মনের নিভৃত তাঁবুতে। জানি দেশে ফিরে কাজের চাপে ডিলানের সাথে ফেসবুকেও যোগাযোগ থাকবে কিনা সন্দেহ। তবে না থাকলেও ক্ষতি নেই। জীবনের বয়ে চলা তো এমনই। ডিলানকে আলবিদা জানিয়ে আমি সফরের অভিমুখ ঘোরালাম।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...