চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল অনন্যা। এতগুলো বছর পার করে ফেলল। কমদিন হল না ওর চাকরির। বাবার অবর্তমানে ছোটো ভাই বোনের দায়িত্ব ওর উপরেই এসে পড়েছিল, এক অজানা নিয়তির হাত ধরে। ভাই বোনকে উচ্চশিক্ষা দিতে গিয়ে নিজের দিকে আর তাকাবার সময় পায়নি ও। এই করেই বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। অথচ শান্তি জোটেনি ওর কপালে।
ভাইয়ের বউয়ের গঞ্জনায় মাথার উপরের ছাদটুকুও ওকে ছেড়ে আসতে হয়েছে। অবিবাহিত ননদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা ভাইয়ের বউয়ের পছন্দ হয়নি। সেখানের পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে দেখে অনন্যা নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। ভরসা তার চাকরিটুকুই। একটি বিদেশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো পদে সে কর্মরত।
দু’বছর হল হায়দরাবাদ থেকে পুণায় বদলি হয়েছে। পুণায় এসে জানতে পেরেছে তার কলেজের সিনিয়র সার্থকও এই একই কোম্পানিতে রয়েছে গত দশ বছর। কলেজে থাকতে কলেজের যে-কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্বে অনন্যা এবং সার্থক দু’জনেই থাকত আরও অনেকের সঙ্গে। এই ভাবেই বন্ধুত্ব দু’জনের। অবশ্য সম্পর্কটা বন্ধুত্বেই থেকে গিয়েছিল, গভীরতা পায়নি।
পুণায় এসে অফিস জয়েন করার প্রায় তিন-চারদিন পর লাঞ্চ টাইমে হঠাৎ সার্থককে দেখতে পেয়ে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠল অনন্যা।
অনন্যা, “আরে সার্থক না? তুমি এখানে?”
—হ্যাঁ, আমি এই অফিসেই কাজ করি কিন্তু আপনাকে ঠিক…’, সার্থক আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকাল অনন্যার দিকে! কারণ এখানে “তুমি’ সম্বোধন করার মতো এমন আপনজন কে হতে পারে। অবশ্য সার্থককেও দোষ দেওয়া যায় না। অনন্যার সৌন্দর্য এতটুকু কমে না গেলেও ছিপছিপে চেহারা আগের থেকে ভারী হয়েছে। চুল ছেঁটে কাঁধ অবধি এসেছে।
অফিসের তিন-চারজন কর্মচারীও অবাক হয়ে ওদের লক্ষ্য করছিল। ওরা নিশ্চিত ছিল অনন্যাই কোনওরকম ভুল করছে।
—সার্থক, আমি অনন্যা। জয়পুরে আমরা একই কলেজে পড়তাম। অনন্যা একটু আশ্চর্য হল, সার্থক ওকে চিনতে পারেনি দেখে! ও একটু লজ্জিত হল কারণ আশেপাশে সকলেই ওর দিকে এমন করে তাকাচ্ছিল যে ওদের চাহনি বলছিল অনন্যাই মস্ত ভুল করে বসেছে।
—সরি অনন্যা, আমি সত্যি তোমাকে চিনতে পারিনি। কলেজ ছেড়েছি প্রায় বারো-তেরো বছর হতে চলল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তিও কমছে। যদিও পঁয়ত্রিশ বছর এখনকার দিনে কোনও বয়সই নয় তবুও সার্থক কথোপকথন চালাবার চেষ্টা করল।
অনন্যার দিকে ভালো করে তাকাল সার্থক। মনে পড়ল কলেজে থাকতে লম্বা বিনুনি করে আসত। এখন কাঁধ পর্যন্ত চুল খোলা রয়েছে। চোখেও পাওয়ারের চশমা উঠেছে। কিন্তু এত কথা সাৰ্থক সকলের সামনে বলাটা সমীচীন মনে করল না।
—তুমি কবে জয়েন করলে অফিস? আসলে আমিও পাঁচদিন ছুটিতে ছিলাম। আমার বাচ্চাটা অসুস্থ ছিল, সার্থক বলল।
—আমি চারদিন হল, অফিস জয়েন করেছি। অনন্যা সার্থকের ব্যবহারে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে সার্থক ওর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নয় তো ওর সঙ্গে কথা বলার সার্থকের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। যদিও কলেজেও বন্ধুত্ব কোনওদিন খুব গভীর ছিল না দু’জনের মধ্যে। কাজ নিয়েই যা দু’জনের কথাবার্তা হতো। কিন্তু একে অপরের অপরিচিত তো ছিল না।
এতবছর বাদে একটা অচেনা শহরে এসে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়াতে অনন্যা খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েছিল, সার্থকের ব্যবহার অনন্যার সেই উৎসাহে একেবারে জল ঢেলে দিল। সার্থকের চেহারায় যে, কোনও পরিবর্তন হয়নি এমন তো নয়। আগের থেকে ওর শরীরেও মেদ জমেছে, গোঁফ রেখেছে। তাও ওকে চিনতে বিন্দুমাত্র দেরি হয়নি অনন্যার। অফিসের সহকর্মীরাও ধরেই নিয়েছিল, ওদের দু’জনের সম্পর্কটা নিশ্চয়ই পুরোনো কলেজ প্রেমের বর্তমান রূপরেখা।
পরের দিন অনন্যার মুড খারাপ দেখে সার্থকের বুঝতে অসুবিধা হল না, ওর কথা বলার স্টাইলেই অনন্যা মনে মনে আহত হয়েছে। নিজেকে খুব দোষী মনে হল সার্থকের। লাঞ্চের সময় নিজেই এগিয়ে এসে অনন্যা-কে বলল, “খুব সরি অনন্যা, আমি তোমাকে একেবারেই চিনতে পারিনি।’ হাত দিয়ে কান ধরে কলেজের দিনের মতো বন্ধুত্বের ভাষা সার্থকের মুখে শুনে অনন্যা না হেসে পারল না।
—সার্থক আমার ছোটো চুল দেখে অনেকেই আমাকে চট করে চিনতে পারে না। তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে চিনতে পারোনি।
—হ্যাঁ, কলেজে তুমি লম্বা বিনুনির জন্যই খ্যাত ছিলে আর সেই কারণেই ‘মিস কলেজ’-এর খেতাবও তোমার ঝুলিতে জুটেছিল। সার্থকের চোখের সামনে ভেসে উঠল অনন্যার চুলের সৌন্দর্যে কেমন ছেলেরা ওর জন্য পাগল ছিল।
—কী করি? অফিস জয়েন করার পর সকালের দৌড়াদৌড়িতে বিনুনি করার সময় কোথায়? তাই জন্য চুল কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছি। অনন্যার কথায় আফশোশ স্পষ্ট ফুটে উঠছিল কারণ ভারতীয় নারীর কাছে নিজের চুলের সৌন্দর্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
অনেক সময় যখন আমরা একই শহরে বা একই কলেজে পড়ি এবং সেখানে রোজই প্রায় দেখা সাক্ষাৎ হতে থাকে তখন সেখানে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলেও ঘনিষ্ঠতা বাড়বেই এমনটা হলফ করে বলা যায় না। অথচ অন্য শহরে গিয়ে হঠাৎ যদি সেই দু’জনের দেখা হয়ে যায়, তাহলে মনে হয় দু’জন খুব কাছের মানুষ বহু বছর বিচ্ছেদ কাটিয়ে আবার একত্রিত হয়েছে। সার্থক এবং অনন্যার মনের অবস্থাটাও ঠিক এমনই ছিল।
কিছুদিন কাজ করতে করতেই অনন্যা লক্ষ্য করল অফিসের মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে সার্থকের কাজ ছাড়া কোনও কথা হয় না তাও বেশিরভাগই হ্যাঁ কিংবা হুঁ— শুধু এটুকুই। অথচ পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে সার্থক খুব সহজ ভাবে মেশে এবং সবসময় তাদের সাহায্য করতে এগিয়েও আসে। এছাড়াও ঠিক ছ’টায় অফিস ছুটির সঙ্গে সঙ্গে সার্থক এক মুহূর্ত কারও অপেক্ষা না করেই একাই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়।
ক্রমশঃ