আমাদের শরীর ও মন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত৷ একটিকে ছাড়া অপরটির পরিচয় দেওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি এদের একটি কখনওই ভালো বা সুখী থাকতে পারে না অপরটি না হলে। অর্থাৎ শরীর ভালো না থাকলে মন কখনওই ভালো থাকতে পারে না এবং এর বিপরীতটাও ঠিক।
যে-অসুখে শরীর ও মন দুই-ই জড়িয়ে থাকে তাকে বলে সাইকো-সোমাটিক ডিসঅর্ডার। এই অসুখ সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে । প্রথম ধরনটিতে কোনও ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক দু’রকমেরই রোগ হয় এবং একে অপরের লক্ষণগুলি ও চিকিৎসা জটিল করে তোলে।
যেমন ধরুন কোনও মহিলার ওসিডি (অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার) আছে, তিনি সারাক্ষণ জিনিসপত্র ধোওয়া-মোছা না করে থাকতে পারেন না। আবার তারই আথ্রাইটিস আছে। দ্বিতীয় ধরনটিতে রোগীর কোনও শারীরিক রোগের বা তার চিকিৎসার সরাসরি ফলস্বরূপ, কোনও সাইকিয়াট্রিক রোগ দেখা দেয়। ক্যানসার বা তার চিকিৎসার ফলে যেমন ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে।
তৃতীয় ও শেষ ধরনের সাইকো-সোমাটিক অসুস্থতার নাম সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডার, যেখানে মানসিক অসুস্থতার প্রকাশ দেখা যায় কোনও শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ রোগের শারীরিক লক্ষণগুলির কারণ আসলে মানসিক ফ্যাক্টর, শারীরিক নয়। সাইকো-সোমাটিক অসুখগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়ংকর।
শুরুতেই কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানাই। এক মহিলা, মুখের ভেতরে আলসার নিয়ে বহু বছর ভুগেছেন। তিনি রোগটি সারানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অসংখ্য ডাক্তার দেখিয়েছেন এবং তাদের ট্রিটমেন্ট ভালো ভাবে ফলো করেছেন, কিন্তু কোনও ফল পাননি। ধীরে ধীরে তার ব্যাক-পেইন দেখা দিল যার জন্য তাকে বহু রকম টেস্ট করাতে হয়েছে। রোগের কোনও শারীরিক কারণ ধরা না পড়ায় তাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করা হল। তিনি সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডার ট্রিটমেন্ট করার ফলে তার পিঠে ব্যথা এবং মুখের আলসার, দুটোই সেরে গেল।
নানা ধরনের সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডার
১. বডি সিসমর্থিক ডিসঅর্ডার— শরীরের খুব সামান্য অথবা একেবারে কাল্পনিক কোনও খুঁত নিয়ে প্রচণ্ড বাতিক দেখা দেয়, যেমন ধরুন মুখের ত্বকের কুঞ্চন যাকে রিংকলস বলে বা ছোটো স্তন অথবা শরীরের যে-কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাপ বা গঠন নিয়ে মানসিক বিকারের ফলে দেখা দেয় সিভিয়ার অ্যাংজাইটি এবং রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে স্বাভাবিক কাজকর্মের ব্যাঘাত ঘটে।
২. কনভালশন ডিসঅর্ডার— এক্ষেত্রে রোগীর এমন কিছু নিউরোলজিকাল সিম্পটম দেখা দেয় যার কোনও শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো দেখা যাবে শরীরে খিঁচুনি, অন্ধত্ব বা এমনকী প্যারালিসিস হয়ে যাচ্ছে কোনও শারীরিক কারণ ছাড়াই।
৩. হাইপোকনড্রিয়াসিস— কোনও সিরিয়াস অসুখ হওয়ার ভয় নিয়ে বাতিক বা বিকার। এই অসুখের রোগীরা শরীরের সাধারণ কোনও প্রক্রিয়া বা খুব সামান্য কোনও রোগের লক্ষণগুলিকেও ভীষণ গুরুতর কিছু বা জীবনহানিকর বলে ভেবে স্থির বিশ্বাস করতে শুরু করে দেন। যেমন ধরুন এই ধরনের কোনও রোগীর বাঁধাকপি খেয়ে তাৎক্ষণিক গ্যাস হওয়ার কারণে পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে, কিন্তু তার স্থির বিশ্বাস যে তার কোলন ক্যানসার হয়েছে।
৪. সোমাটাইজেশন ডিসঅর্ডার— এই অসুখে রোগীর মাথার যন্ত্রণা, পেটখারাপ বা প্রিম্যাচিওর ইজ্যাকুলেশনের মতো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় যার কোনও শারীরিক কারণ নেই।
সোমাটোফর্ম ডিসঅর্ডারগুলির প্রকৃত কারণ এখনও আমাদের কাছে অজানা বললেই চলে। হয়তো এর কারণ কোনও জোরালো অনুভূতি যেমন উদ্বেগ, শোক, কষ্ট, আঘাত, অপব্যবহার, চাপ, অবসাদ, ক্রোধ বা অপরাধবোধ। রোগী কিন্তু বুঝতে পারে না যে এই অনুভূতিই তার শারীরিক সমস্যার কারণ। তাই বাড়ির লোকের বোঝা প্রয়োজন যে উনি এই শারীরিক সিম্পটমগুলি ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি করছেন না বা বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন না। এগুলি বাস্তব কিন্তু ঘটছে মানসিক কারণে।
সোমাটোফর্ম সিম্পটমগুলির মধ্যে রয়েছে হজমের সমস্যা, মাথাব্যথা, যন্ত্রণা, অবসন্নতা, মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকের সমস্যা এবং সেক্সুয়াল অসুবিধা। বছরে বছরে এর তীব্রতার হেরফের হতে পারে কিন্তু কোনও একটা সময় দেখা যায় সিম্পটম নেই। এমন ঘটনা বিরল। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যাদের সেক্সুয়াল, ইমোশনাল বা ফিজিকাল অ্যাবিউসের অথবা শৈশবে কঠিন অসুখের হিস্ট্রি আছে অথবা যাদের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা খুবই সীমিত তারা এই রোগে আক্রান্ত হন সবচেয়ে বেশি।
সাইকো-সোমাটিক ডিসঅর্ডার ট্রিটমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে দৈনন্দিন জীবনযাপনের বহু দিক ব্যহত হয়ে পড়ে। কাজের ক্ষতি হয়, সম্পর্কগুলোর ক্ষতি হয়, লাইফের কোয়ালিটি কমে যায়, বড়োসড়ো ডিপ্রেশন হতে পারে, আত্মহত্যার ভাবনা বা প্রচেষ্টা দেখা দেয়— তাই আবার বলছি ট্রিটমেন্ট খুবই প্রয়োজনীয়। আপনার কোনও ভালোবাসার, কোনও কাছের মানুষকে এরকম সিম্পটমে ভুগতে দেখলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোনও ডাক্তার বা সাইকোলজিস্টকে দেখাতে অবশ্যই অনুরোধ করবেন।