বিশাখাপত্তনম আমাদের স্বাগত জানাল। পূর্বঘাট পর্বতমালার হিমেল হাওয়া আর বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত গন্ধ মিলেমিশে একাকার।
এপিটিডিসির হরিথা পান্থশালার জানালার পর্দা সরাতেই উন্মুক্ত হল ঋষিকোন্ডা বিচ। ভারতের পরিচ্ছন্নতম বিচে, সবসময়েই পর্যটকদের আনাগোনা। কেউ সমুদ্রস্নানে, কেউ ঝিনুক কুড়োতে ব্যস্ত। সোনালি বালুতটে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় দিনের অনেকটা সময়। ঋষিকোন্ডায় দেশি-বিদেশি পর্যটকের মেলা। এখানে সাঁতার, ডাইভিং, উইন্ড সার্ফিং-সহ বিভিন্ন জলক্রিড়ায় মেতে থাকেন পর্যটকরা।
বিকেলের দিকে গিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের অফিস থেকে আরাকু উপত্যকার টিকিট বুকিং করতে গেলাম। সরকারি টুর প্যাকেজ বুক করে আরাকু ঘুরে আসাটাই সুবিবেচনার কাজ। তবে আরাকু পাড়ি দেওয়ার আগে ভাইজাগ ঘুরে নেওয়ার প্ল্যান আমাদের। সেইমতো পরদিন আমরা দেখে নিলাম সাবমেরিন মিউজিয়াম ও আরকে বিচ। ‘গাজী’ নামের একটি পাকিস্তানি সাবমেরিন, যেটিকে ভারতীয় নৌসেনা, ৭১ সালের যুদ্ধে ঘায়েল করেছিল, সেটিই এখন মিউজিয়ামের রূপ পেয়েছে। অনেকেই দেখলাম এই আরকে বিচে অর্থাৎ রামকৃষ্ণ বিচে নৌকা করে সমুদ্র ভ্রমণ করেন। আমরা অবশ্য তা না করে ভাইজাগ থেকে ৩০ কিমি দূরে ভিমানিপত্তনম সমুদ্র সৈকত বেড়িয়ে নিলাম। এখানে সপ্তদশ শতকের প্রাচীন ওলন্দাজ কলোনির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।
ভাইজাগ এসে সিমাচলম মন্দির না দেখে ফেরার কোনও মানেই হয় না। সিমহা মানে সিংহ আর আচলম মানে পাহাড়। পাহাড়ের উপরে নরসিংহ অবতার ও বিষ্ণুর মন্দির। এই পাহাড়টিকে স্থানীয়রা নরসিমাচলম নামে ডাকে। এই মন্দির, তিরুপতির পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনসম্পদশালী মন্দির হিসাবে খ্যাত।
মন্দির চত্বরে পর্যটক ও পুণ্যার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। নরসিংহের মূর্তিটি প্রায় সারা বছর চন্দনের প্রলেপে ঢাকা থাকে। কেবল বৈশাখ মাসে দেবতার আসল রূপের দর্শন মেলে। এই দর্শনকে বলা হয় চন্দনযাত্রা। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন, কেবল ঘন্টাখানেকের জন্য মূর্তিটির এই বিরলরূপ ভক্তরা চাক্ষুস করেন।
বিকেলের মুখে পৌঁছোলাম ইয়ারাডা বিচে। এটি অবশ্য একটি বেসরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকা এক সমুদ্রসৈকত। এর অদূরেই এক অসাধারণ ভিউ পয়েন্ট ‘ডলফিন নোজ’। ডলফিন হিলের শীর্ষে এই ভিউপয়েন্ট থেকে সোনালি বালিয়াড়ি আর নীল জলরাশির নিসর্গ অপূর্ব লাগে। নিরাপত্তার কারণেই ইয়ারাডা বিচে সাঁতার কাটা বা অন্যান্য জলক্রিড়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে।
আমাদের পরের দিনের গন্তব্য ছিল কৈলাসগিরি পার্ক। পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত একটি পার্ক যেখানে অপূর্ব সব গাছগাছালি আর নীচে তাকালেই বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি। পার্কে পৌঁছোনোর জন্য রোপওয়ে ব্যবস্থা। অত্যন্ত থ্রিলিং এই সফর।
পরদিন আমাদের আরাকু ভ্রমণের প্ল্যান। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে সোজা স্টেশনে। অপূর্ব এক রেলপথে ৫৮ টা টানেল ও ৮৪ টা ব্রিজ পেরিয়ে, পাহাড় ও ঝরনার শোভা দেখতে দেখতে এক স্বপ্নের সফর শেষে পৌঁছোলাম আরাকু। টুরিজম-এর রিসর্টে ফ্রেশ হয়ে আরাকু স্পেশাল ব্যাম্বু চিকেনের আস্বাদে মন ভরে গেল। আরাকুর সৌন্দর্য শুধু এর সবুজ পাহাড়ের জন্যই নয়, কফির বাগানের জন্যও এটি সমাদৃত। অর্গ্যানিক কফি খেয়ে, কিছু চকোলেট কিনে রওনা হলাম বোরা কেভস দেখতে।
অনন্তগিরি পর্বতের কোলে স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট পাথরের এই গুহা যেন এক রহস্যময়তার ছোঁয়া দেয়। বিকেলের মুখে হঠাৎই বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। উপত্যকাকে আরও সজীব সবুজ করে, আমাদের ফেরার পথকে আরও মোহময়ী করে তুলল এই বৃষ্টি। মেঘের আনাগোনা আর বৃষ্টির সিম্ফনিতে এক স্বর্গীয় সফরের শরিক হলাম আমরা।