এবার বেড়াতে চলেছি মুর্শিদাবাদ, যা ছিল ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে স্বাধীন বাংলার শেষ রাজধানী। ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত এই শহরের নামকরণ হয় বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ান তথা সুবাদার, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-এর নাম থেকেই। ১৭১৭ সালে মুর্শিদাবাদকে করা হয় বাংলার রাজধানী। ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ হয় ১৭৫৭ সালে এবং ব্রিটিশরা কলকাতায় রাজধানী স্থানান্তর করে ১৭৭৩ সালে।

কলকাতা স্টেশন থেকে সকাল ৬টা ৫০ মিনিটের হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস, গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ঠিক সময়েই যাত্রা শুরু করে দিল। একে একে ব্যারাকপুর, রানাঘাট ছাড়িয়ে ট্রেন কৃষ্ণনগর সিটি জংশনে পৌঁছোল। সকাল সাড়ে ১০টার আগেই এসে পৌঁছোলাম বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে। প্লাটফর্মের বাইরে এসে আমরা একটা টোটোয় চড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পঞ্চাননতলায় অবস্থিত আমাদের নির্দিষ্ট হোটেলে।

দুপুরে লাঞ্চ করে, একটি অটো নিয়ে দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। স্থানীয় যুবক ড্রাইভার আকবর জানাল, আমাদের প্রথম গন্তব্য তাপেখানা, জলঙ্গী রোড ধরে চলেছি। মুর্শিদাবাদ শহরের এক মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কাটরা মসজিদ এবং সেখান থেকে মাত্র আধ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে নবাবের তাপেখানা বা আর্টিলারি পার্ক। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত ‘জাহানকোষা’ কামান, যার অর্থ পৃথিবী ধ্বংসকারী। ১৮ ফুট দীর্ঘ সাত টন ওজনের ওই বিশাল কামানের নির্মাতা ছিলেন তৎকালীন ঢাকা শহরের দক্ষ কারিগর জনার্দন কর্মকার। কামানের ওপর খোদিত লিপি থেকে জানা যায়, সম্রাট শাজাহানের রাজত্বকালে সুবাদার ইসলাম খাঁর আদেশে ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে ওই কামান তৈরি হয়।

পরের গন্তব্য নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র সমাধিস্থল ‘কাটরা মসজিদ’। ৫৪ মিটার উঁচু বর্গাকার স্তম্ভমূলের উপর দণ্ডায়মান ইটের তৈরি ওই মসজিদ দ্বিতলবিশিষ্ট গম্বুজাকৃতি কক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত। সামনে প্রশস্ত অঙ্গন। বর্গাকৃতি মসজিদ প্রাঙ্গণের চার কোণে নির্মিত হয়েছিল চারটি বিশাল, আটকোনা মিনার— যাদের মধ্যে কেবল দুইটি (উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে) মিনার আজও অক্ষত। পূর্ব দিক থেকে আগত ১৪টি সিঁড়ির নীচে শায়িত মুর্শিদকুলি খাঁ-এর পার্থিব শরীর সমাধিস্থ করা হয় ১৭২৭ সালে। কাটরা মসজিদ প্রাঙ্গণে ৭০০ জন একসঙ্গে কোরান পড়তে পারে। মসজিদের ভিতরে একই সময়ে ২০০০ জন নমাজ পড়তে পারে। কাটরা মসজিদ সত্যিই দেখার মতো এক সৌধ।

একটা কথা প্রায়ই মনে হচ্ছে, মুর্শিদাবাদ এসে সেই নগরের স্রষ্টা ও রূপকার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-এর সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাঠকদের না জানালে এই লেখা সঠিক রূপ পাবে না। তাঁর জন্ম তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের বেরার প্রভিন্স-এর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। দারিদ্র্যের তাড়নায় তাঁকে হাজি সফি নামে এক পারসিক ব্যবসায়ীর কাছে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। হাজি সফি তাঁকে ইরানের ইস্পাহান শহরে নিয়ে যান এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। ব্রাহ্মণ বালকের নতুন নাম হয় মহঃ হাদি। হাজি সফি ক্রীত বালককে নিজ সন্তানের মতো সুশিক্ষিত করে তোলেন। হাজি সফির মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীরা মহঃ হাদিকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন।

দাক্ষিণাত্যে এসে তিনি বেরারের দেওয়ান হাজি আবদুল্লার কাছে কাজ নেন। সেখানে হিসেবরক্ষার কাজে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সম্রাট ঔরংজেবের কানে আসে মহঃ হাদির কথা। সম্রাট তখন মহঃ হাদিকে হায়দরাবাদের দেওয়ান নিযুক্ত করেন। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে কপর্দকহীন ঔরংজেব হাদিকে বাংলার দেওয়ান করে পাঠান এবং তাঁকে করতলব খাঁ উপাধি দেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...