রোজকার মতোই তুষার চায়ের ট্রে হাতে করে বেডরুমে এসে ঢোকে। সাইড টেবিলে ট্রে-টা নামিয়ে রেখে জানলার পর্দাগুলো সামান্য সরিয়ে দেয় ঘরে আলো ঢোকার জন্যে। জানলা দিয়ে একফালি কমলালেবুরঙা স্নিগ্ধ আলো এসে পড়ে রঞ্জনার মুখের উপর। রঞ্জনা চোখ বুজেই খাটে পাশ ফিরে শোয়। হাত দিয়ে চোখটা ঢাকার চেষ্টা করে। তুষারের মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। বিছানায় বসে রঞ্জনার চুলে হাত রাখে তুষার, ‘ম্যাডাম, উঠুন। দাস আপনার চা নিয়ে হাজির।’

তুষারের গলা শুনেও রঞ্জনার চোখ খুলতে ইচ্ছা করে না। চোখ খুললেই তো কাজের পাহাড়। যদিও সকালটা তুষারই সামলে দেয়। দেরি করে ওঠাটা রঞ্জনার অভ্যাস। তুষারের ঘুম খুব সকালে ভেঙে যায়। উঠেই চোখে মুখে জল দিয়ে বেডরুমে রাখা মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে দেয়। দু’জনেরই মিউজিক প্রিয়। হালকা করে চলতে থাকে আমজাদ আলি বা রবিশংকর। ঘরের জানলাও খুলে দেয় ভোর থাকতে যাতে কিছুটা ফ্রেশ হাওয়া এসে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে যেতে পারে তাদের শরীরে।

শুয়ে শুয়ে রঞ্জনা বুঝতে পারে তুষার পাশে বসে তার জেগে ওঠার অপেক্ষা করছে। চা এনেছে যখন না খাইয়ে ছাড়ছে না। এরই মধ্যে তুষারের কথা কানে আসে, ‘কী হল ম্যাডাম? বিছানার ওম ছেড়ে ওঠার কি ইচ্ছে নেই? সকাল সকাল তোমার সম্পাদক সাহেবের ফোন এসেছিল। কোনও একটা স্টোরির গন্ধ পেয়েছেন মনে হল, তাই তড়িঘড়ি তোমার খোঁজ পড়েছে।’

‘সম্পাদক’ শব্দটা বোধের উপর আঙুল ছোঁয়াতেই রঞ্জনা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। ‘মিস্টার সেনের কি চোখে ঘুম আসে না যে সাতসকালে ফোন করেছেন?’

‘তোমার এডিটর সাহেবটি খুব ভালো করেই জানেন যে তুমি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠো। তা সত্ত্বেও সাত সকালে ফোন করে আমার ঘুমটাও বরবাদ করেন। ‘

তুষার, রঞ্জনার হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে নিজের কাপটাতে চুমুক মারে। হাতে আর বেশি সময় নেই। ঘরের টুকটাক কাজকর্ম মিটিয়ে অফিসের জন্য বেরোতে না পারলে নির্ঘাত দেরি হবেই। সুতরাং উঠে পড়ে তুষার। দুধ নিয়ে এসে গ্যাসে ফুটতে বসিয়ে টোস্ট তৈরি করাটা তুষারের রোজকার কাজ। বাকি রঞ্জনা উঠে যা করবার করবে।

মাত্র বছর দেড়েক হয়েছে দু’জনের বিয়ের। লভ ম্যারেজ। অবশ্য দুই পক্ষের পরিবারের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছে। কিন্তু ওরা ভবিষ্যতের প্ল্যানিং ছাড়াই জীবনটা সুন্দর কাটিয়ে দিচ্ছে। সংসারের কাজটাকে দুজনে অলিখিত নিয়মে সুবিধামতো ভাগ করে নিয়েছে।

বিয়ের আগে অন্য ছেলেদের মতোই তুষার রান্নাঘরের কোনওদিন পা বাড়ায়নি। বাড়ির সব কাজ মা-ই করতেন। তুষার বড়ো হয়ে থেকে দেখে আসছে রান্নাঘরে মায়ের একাধিপত্য। আলস্য বস্তুটা মায়ের মধ্যে দেখেছে বলে তুষারের মনে পড়ে না। বাড়ির কেউ মা-কে সাহায্য করতে চাইলেও, মা সঙ্গে সঙ্গে তাকে না-করে নিতেন, বলতেন, ‘তোমরা নিজেদের কাজ করো। রান্নাঘরের কাজটা ভগবান মেয়েদের জন্যেই বেছে রেখেছেন।’

তুষারের বড়ো ভাই বিনয়, গ্রিন কার্ডহোল্ডার একটি মেয়েকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যায় বেশ কয়েক বছর আগে। বড়ো ভাইয়ের চলে যাওয়াটা মা-বাবার মনে একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। তারপর থেকেই তুষারের মনে হতো মা তাকে আগলে আগলে রাখছেন। চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার একেবারে বিপক্ষে ছিলেন মা। বাবাও চাইতেন পরিবারের ব্যাবসা-টা তুষারই দেখুক। কিন্তু তুষারের ভালো লাগত বই আর খবরের কাগজের পাতার কালো অক্ষরগুলো। রাত্তিরে বই নিয়ে শুলে, বাবা এসে পাশে বসে ব্যাবসার কথা বোঝাবার চেষ্টা করতেন। ছেলের বিরক্তি দেখে মা হেসে বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, ‘কেন শুধু শুধু ছেলেটাকে বিরক্ত করছ তুমি। পড়তে ভালোবাসে তাতে চিন্তার কী আছে? তোমারই তো রক্ত। একদিন দেখবে নিজেই ব্যাবসায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।’

কিন্তু অসীমাদেবীর এই ভবিষ্যতবাণী মিথ্যাই প্রমাণিত হয়। পড়াশোনা শেষ করে তুষার চাকরির সন্ধানে ঘুরতে থাকে। পেয়েও যায়। একটি প্রতিষ্ঠিত খবরের কাগজের দফতরে সাব-এডিটরের চাকরি। কাজের প্রতি একাগ্রতা দেখে অসীমাদেবী এবং পরিমলবাবু বুঝে যান, পরিবারের ব্যাবসার ভার ছেলে কোনওদিনই কাঁধে তুলে নেবে না।

সেদিন বিকেলে স্বামী-স্ত্রী দুজনে বসার ঘরে বসে কোনও কিছু নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, এমন সময় তুষার এসে ঘরে ঢোকে। ছুটির দিন। দুপুর থেকে তুষার বাড়িতেই রয়েছে। প্রথমটা অসীমাদেবী সামান্য আশ্চর্য হয়েছিলেন কারণ ইদানীং ছুটির দিনগুলোতেও তুষার বাড়িতে থাকত না। অফিসের কাজের অজুহাতে সারাদিন বেপাত্তা।

“যাক ভালোই হল। তোমরা দু’জনেই দেখছি এখানে রয়েছ। তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা রয়েছে। তুষারের গলা শুনে পরিমলবাবু এবং অসীমাদেবী তাকান ছেলের দিকে। কথা বলতে বলতে দুজনে কেউই খেয়াল করেননি ছেলে কখন এসে ঘরে ঢুকেছে।

“মা, কিছুদিন আগে রঞ্জনা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। মেয়েটিও জার্নালিজম নিয়ে ডিপ্লোমা করেছে। ওর বাবা নামি একটি সংবাদপত্রে সিনিয়র জার্নালিস্ট, নাম দেবরঞ্জন রায়। তোমরা নিশ্চই ওনার নাম শুনে থাকবে। রঞ্জনার মা কলেজের প্রফেসর এবং ভাই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। আমি রঞ্জনাকে বিয়ে করতে চাই।’

তুষারের মুখে হঠাৎ-ই সব শুনে পরিমলবাবু এবং অসীমাদেবী খানিক্ষণ চুপ করে থাকেন। কী বলবেন বুঝে পান না। তারা যে মানসিকতা নিয়ে সন্তানদের বড়ো করে তুলেছেন, তার সঙ্গে পুরো ঘটনাটার কোনও সাযুজ্য খুঁজে পান না। ছেলে যেখানে নিজেই মেয়ে দেখে বিয়ে স্থির করে ফেলেছে সেখানে তাদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ তে কিছুই যায় আসে না। পরিমলবাবু নিজের ভাবনার গতিবেগকে সংযত করেন, “বাঃ সে তো বেশ ভালো কথা। একটা দায়িত্ব থেকে তাহলে তুমি আমাদের নিষ্কৃতি দিলে। একটা দিন দেখে তাহলে দুটো পরিবারের মধ্যে প্রয়োজনীয় কথাবার্তাগুলোও সেরে ফেলা দরকার। তোমাদের যেদিন সুবিধা হবে মা-কে জানিয়ে দিও।’

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...