পালঘর তালুকের ছোট্ট এক সৈকত ঘেঁষা গ্রাম Kelva। পালঘর ও সাফালে দুটি রেলস্টেশন থেকেই দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। “কেলভা’ শব্দটির বুৎপত্তি ‘কারদালিবহ’ শব্দ থেকে। ফলত মনে করা হয় প্রাচীনকালে ইতিহাস ও পৌরাণিক গাথার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে এই স্থানটির। নারকেল, আম, জাম, কলা, সুপুরি, তাল এবং চিকুর ফলন এখানে প্রচুর। বিশেষত সতেজ রসালো উন্নতমানের চিকুর ফলনকে মান্যতা দিয়ে প্রতিবছর ‘চিকু উৎসব’ পালিত হয়।
নানা ধরনের মানুষজনের বসবাস এখানে। কয়েকটি মন্দির ছাড়াও রয়েছে দুটি মসজিদ ও একটি চার্চ। রয়েছে খোলা বাজার, মাছের আড়ত, নুনের ক্ষেত্র। যাওয়া-আসার পথে বেশ কিছু অভিজাত শৈলীর বসতবাড়ি নজরে পড়ল। প্রতিটি বাড়ির উঠোনেই সুদৃশ্য কাঠের কারুকাজ করা, লোহার শিকলে বাঁধা দোলনা রয়েছে। তাতে সুন্দর গদি ও তাকিয়া ঠেশ দিয়ে রাখা। গৃহস্থের আরামদায়ক আয়োজন। শৌখিন ওই দোলনায় বসার লোভ হয়। কল্পনায় দোল খাই। এখানে প্রায় প্রত্যেকের ঘরেই মহার্ঘ্য চার চাকা ও হাল ফ্যাশনের দু’চাকা মজুদ।
এমনিতে গ্রাম হলেও কেলভার কেতাদুরস্ত সাজপোশাকে মহিলারা প্রায় সবাই স্কুটার বাহক। চুলে বার্গান্ডি রং ও বাহারি ছাঁটে চুল কাটা। পুরুষরাও যাতায়াত করছেন নামিদামি মোটরবাইকে। বরং সাধারণ সাইকেল আরোহী চোখে পড়ল না মোটেই। Kelva বর্ধিষ্ণু গ্রাম হলেও স্থানীয় বাসিন্দারা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
হৈমন্তিক দুই রাতের ঠাঁই আমাদের জন্য বরাদ্দ আরিয়ান ফার্মহাউস-এ। আসন্ন অগ্রহায়ণকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে কেলভার প্রকৃতি। সৌজন্যমূলক প্রাতরাশে পোহা, ডিমসেদ্ধ, পাও ও ফিল্টার কফি। ফার্মহাউস থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছোলাম কেলওয়া সৈকতে। এ পথে কোনও সওয়ারি গাড়ি চোখে পড়ল না। পরিচ্ছন্ন গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চারপাশের দৃশ্য কেমন পালটে যেতে থাকে। কোথাও কলাবাগান, কোথাও নারকেল বাগান, সুসজ্জিত ফুলবাগান, বাড়ির দাওয়ায় শৌখিন দোলনা, মিহি করে ছাঁটা ঘাসের লনের মধ্যে দোতলা একতলা বাড়িগুলো দেখে উপলদ্ধি হয়, একটা আঁকা ছবির সামনে যেন দাঁড় করিয়ে গেছে কেউ!
সৈকতে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি পাঁচ টাকা। হলুদরঙা ‘করাবদল পাবতী’ অর্থাৎ প্রবেশমূল্য টিকিটের গায় মরাঠি হরফে লেখা ‘গ্রাম পঞ্চায়েত কেলভা ক্ষেত্র সুরুবাগ-সাগরী কিনারা’। যেখানে প্রতি টিকিটে স্বচ্ছতা কর বাবদ তিন টাকা ও ‘সুরুবাগ’ তথা ঝাউবন কর বাবদ দুই টাকা ধার্য। মূল লোহার গেট প্রবেশপথ থেকে সৈকতকিনারা পর্যন্ত যাত্রাপথের দু’ধারে প্যাকেটবন্দি ১০০ টাকা ডজন সতেজ তালশাঁস, ডাব, ভেলপুরি, পানিপুরি, মকাইদানা, মসলা-মাখা লাল কুল, কাঁচা আম ফালি করে কাটা, নুন-মাখা কামরাঙা, ইডলি-বড়া, বড়া-পাও, বরফগোলা ইত্যাদি হরেক খাবারের স্টল। এছাড়াও শিশুদের খেলনা, মহিলাদের নানাবিধ প্রসাধনী সরঞ্জাম, দেওয়ালি উৎসবের মাটির দিয়া, রঙ্গোলি আবির— সব এন্তার বিকোচ্ছে। দোকানিরা ডাকাডাকি করছে— ‘তাই’ আমার দোকানে আসুন। মহারাষ্ট্রে দিদিকে ‘তাই” বলে সম্বোধন করা হয়।
রোদ্দুরের প্রতিচ্ছায়া সাগরজলে। ঢেউয়ের লহরিতে কাঁপে তার রৌনক। সোনালি মিহি বালুতট আট কিলোমিটার বিস্তৃত। বহুসংখ্যক বিনোদিনী জলক্রীড়ার ব্যবস্থাও মজুদ। ওয়াটার স্কুটি, কায়াকিং, প্যারাসেলিং, ওয়াটার স্কি, বানানা বোট ইত্যাদি। বালুতটে রয়েছে ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি, হাওদা লাগানো সওয়ারি উট, রিমোটচালিত তিন চাকার মোটরযান, ট্রাই সাইকেল, প্যারাগ্লাইডিং ইত্যাদি কত না আমোদবিহার। সাগরের কোমর জলে নেমে খানিক হুল্লোড় করে সেই আনন্দ মুহূর্তের কিছু ছবি তুলে রাখি। শাঁসওলা ডাবের জলটুকু পান করে ভেতরের নরম শাঁস, ডাবের খোলের চামচ দিয়েই চেটেপুটে খেয়ে নিই ফিরতি পথে।
Kelva বাজার রোডে, শীতলাদেবী নাকার কাছে প্রায় ২,৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে আরিয়ান ফার্মহাউস। আমাদের হৈমন্তিক অবসরের আপাত ঠেক। মাথার ওপর করোগেটের চাঁদোয়া দেওয়া বিশাল উঠোন। একধাপ উঁচুতে ছোটো অনুষ্ঠান উপযোগী মুক্তমঞ্চ। চত্বরে ছড়ানো দুটি দোতলা ভবনে ১৬টি ঘর। মাঝারি আকারের সুইমিং পুল, গোটাকয়েক দোলনা, বসার জায়গা, ক্যারামবোর্ড, ফলের বাগিচা।
বাথরুমে গিজার না থাকলেও বাগানের পরিত্যক্ত কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে, সেই ধিকিধিকি আঁচ বাইরের মোটা পাইপের সাহায্যে জলের বড়ো গামলায় প্রাকৃতিক রূপে গরম হচ্ছে, স্নানের জন্য। চারদিকে প্রচুর গাছপালা থাকায় নানাধরনের জংলা পোকামাকড়ের উৎপাত খুব। মধ্যাহ্ন আহারে সম্পূর্ণ মহারাষ্ট্রিয়ান ব্যাঞ্জন পরিবেশিত হল। স্থানীয় চাষের চালের একমুঠো ভাত, গ্রিন স্যালাড, সেঁকা ফুলকা, পনির কোলিওয়ারা, সুরমাঈ মচ্ছি ফ্রাই, মুর্গ লসুনী, পাঁপড় ও শ্রীখন্ড।