মা-দিদিমাদের সময়েই হোক অথবা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় হোক— এই দীর্ঘ সময়ের সফরে এমন বহু মহিলা আছেন, যারা শক্তি, সংঘর্ষ এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সেইসঙ্গে পরের প্রজন্মকেও সব দিক দিয়ে পুরোপুরি তৈরি করে দিয়ে গেছেন।

“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই শব্দ চয়ন মনে করায় একাকী নারীর সংগ্রামকেও। দেশভক্তির পরিচয়স্বরূপ প্রতিবাদমূলক এই গানটি কবি রচনা করলেও গানের কথাগুলো যেন একাকী নারীর সংঘর্ষের প্রতি কবির এক শ্রদ্ধার্ঘ্য।

আত্মবিশ্বাস হল সবচেয়ে বড়ো মূলধন

বিয়ের ১১ বছর পরে সোনালির Divorce হয়ে যায় এবং সন্তানের দেখাশোনা করার জন্য সে চাকরি করা শুরু করে। সোনালির কাছে বর্তমানটাই সব। রোজ ও নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করে। ডিভোর্স-এর পুরো প্রক্রিয়া আজও তার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিন্তু আজ সে বিশ্বাস করে, চাইলেও সবকিছু দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না।

ডিভোর্সের পর সে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে। টিচিং-এর সঙ্গে সঙ্গে ‘ল’ পড়ে। নিজের আত্মবিশ্বাস হারায়নি সোনলি, নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থেকেছে। লোকের সমালোচনা গায়ে মাখেনি। বাচ্চার জন্য নিজের মা-বাবা এমনকী সন্তানের পিতার কাছ থেকেও এতটুকু সাহায্য দাবি করেনি। সোনালির সব সময় মনে হয়েছে, ওর থেকেও দুঃখী আরও অনেক মানুষ আছেন। নিজের জন্য তো সকলেই বাঁচে কিন্তু সোনালি অপরের জন্য বাঁচতে শিখে গিয়েছিল।

মেয়েদের নিজেকে দুর্বল ভাবা উচিত নয়। আত্মবিশ্বাস থাকলে জীবনে অগ্রসর হতে কেউ আটকাতে পারবে না। কারও কাছে কিছু আশা করা উচিত নয় কারণ আশাপূরণ না হলে ব্যথা পাওয়া স্বাভাবিক। কঠিন সময়ে সান্ত্বনা বাক্য দিতে লোকের অভাব হবে না কিন্তু নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

একলা অভিভাবকের দায়িত্ব

আমাদের চারপাশে এমন অনেক মহিলা আছেন যারা স্বামী ছাড়াই সন্তানকে, পরিচয় নিয়ে গর্ব করার মতোই বড়ো করেছেন। রুপোলি পর্দার জগতে এমন দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি আমাদের চোখে পড়ে।

আজকাল ঘরে ঘরে Divorce-এর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলারাই সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করে, সসম্মানে এইরকম সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে সন্তান-সহ সংসারের হাল ধরছেন। বহু ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়— স্বামীর অনাদর পীড়িত শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্বও একা পুত্রবধূ বহন করতে বদ্ধপরিকর।

নারীর এই দায়িত্ববোধ ও আত্মবিশ্বাস রামায়ণের সময় থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। শ্রীরাম কর্তৃক সীতার বনবাসকালেও আত্মসম্মান ও স্বাভিমানের বিন্দুমাত্র অভাব সীতার মধ্যে দেখা যায়নি। দুই সন্তান-সহ বনবাসে একলা থেকেছেন এবং শ্রীরামের সাহায্য ছাড়াই সন্তানদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন।

সকলের থেকে আলাদা

জয়পুরে কর্মরত বিজ্ঞাপন এজেন্সির প্রোডাকশন ডিজাইনার স্বরূপা মজুমদারের সঙ্গে হওয়া কিছু কথোপকথন, “আমি অবিবাহিত এবং এখন বয়স ৪৬। বিয়ে না কারাটা সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছে এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেই পুরোনো সময় থকে চলে আসা, জোর করে মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সমাজব্যবস্থায় আমার কোনওরকম ভরসা নেই। আমি এই যুগের মহিলা এবং নিজের ইচ্ছেমতন বিকল্প আমি খুঁজে নিই। নিজের স্বতন্ত্র জীবন বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমার আছে বলে মনে করি। আমি আনন্দে আছি। আর দশটা লোক আমার সম্পর্কে কী বলল, তার আমি পরোয়া করি না।”

এরকম মানসিকতা যাদের আছে তারা নিজেদের একাকী মনে করে, চোখের জল ফেলে সময় কাটান না। বরঞ্চ সমাজের ভালোমন্দের প্রতি তারা যথেষ্ট সচেতন। সমাজ থেকে নিজেকে বহির্ভূত না রেখেও, তারা নিজের পছন্দের বিকল্প জীবনশৈলীর আনন্দ গ্রহণ করেন। এরা কিন্তু সকলেই শিক্ষিত, যথেষ্ট বুদ্ধিমতি এবং সংবেদনশীল। একা থাকতে এরা ভালোবাসেন। আগেকার দিনের অবিবাহিত মাসি, পিসিদের থেকে এরা অনেক আলাদা।

এই মানুষদের বন্ধুর সংখ্যা প্রচুর। এরা সম্পর্কেও আছেন কিন্তু অনেকের থেকেই তা আলাদা। এদের কাছে জীবনের অর্থ-ই হল আত্মসম্মান, বিশ্বাস এবং সৃজনশীলতা।

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...