সামন্তকের মুখের সবকটা বাতি নিভে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। কোনও রকমে আমতা আমতা করে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি এসবের কিছুই জানতাম না।”
জানার কথাও নয়। আপনার কাকুর মতো ক্রিমিনালরা সকলকে অন্ধকারে রেখেই নিজেদের কাজ হাসিল করেন। রাগ-অভিমান এসবের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন এখন মাসিমণি। তাই সবকিছু জেনেও আপনার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানালেন না আর। শুধু এই টাকাটা দিলেন, রোগশয্যায় থাকা গুরুর প্রতি একজন শিষ্যার দক্ষিণা হিসেবে।
তন্দ্রার এগিয়ে দেওয়া খামটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিয়ে নিল স্যমন্তক। মুখে বলল, ‘আপনি না বললে এসব কথা হয়তো জানাই হতো না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আমার।’
—মাসিমণি এই কথাগুলো কাউকে বলেন না। আপনাকেও হয়তো বলতেন না। কিন্তু আমি দিনের পর দিন একজন মানুষকে কষ্ট পেতে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তাই না পেরে বলে দিলাম। দয়া করে স্নেহাংশু সরকারকে এই বাড়ির ঠিকানা জানাবেন না।
আর আমি? আমাকেও কি আসতে বারণ করছেন আপনি? তন্দ্রার চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল স্যমন্তক।
ঠোঁটের কোণে একটা দুর্বোধ্য হাসি লেগে আছে তার। গলার স্বরটাও কেমন যেন আবেগমাখা! নিরুত্তর তন্দ্রা তাকিয়ে আছে অপলক। দমকা হাওয়ায় মাথার ওপর বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে অজস্র হলুদ রঙের ফুল।
প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে লাস্ট বাসটা ধরল স্যমন্তক। ভাগ্যক্রমে একদম শেষের জানালার ধারের সিটটা পেয়ে গেল বসার জন্যে। ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে বুক ভরে শ্বাস নিল একটা। বাসটা চলতে শুরু করেছে। জানলা দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা জোলো বাতাস। পকেট থেকে সাদা খামটা বের করে মুখটা সামান্য খুলল। একবার চোখ বুলিয়ে নিল কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোটগুলোর ওপর। হাজার দশেক আছে মনে হয়। আপাতত চলে যাবে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল স্নেহাংশু সরকারকে। পরলোকে যাবার আগে একটা মোক্ষম পয়সা কামানোর উপায় বাতলে দিয়ে গিয়েছেন তিনি।
স্যমন্তককে মধুরিমার কাছে যাবার কথা বলেই চোখ বুজেছিলেন স্নেহাংশু। কী একটা ভেবে স্যমন্তকও লুফে নিয়েছিল কাকুর অন্তিম ইচ্ছেটা। ভগ্যিস নিয়েছিল। ব্যাবসাপাতির এই মন্দার বাজারে এখন মাঝে মাঝেই তাঁর নাম করে বেশ কিছু মালকড়ি হাতানো যাবে ভালো মানুষ মধুরিমার কাছ থেকে।
স্যমন্তকের জীবনে মেঘ না চাইতেই জল হিসেবে এসেছেন মধুরিমা, একসময়ের নামজাদা গায়িকা। অনেক টাকার মালিক। বছর বছর রয়্যালটি হিসেবেই ব্যাংক-এ জমে গাদা গাদা টাকা। স্নেহাংশুর সঙ্গে মধুরিমার আইনত বিচ্ছেদ হয়নি। তাই হিসেব মতো স্যমন্তকই এখন তাঁর একমাত্র রক্তের সম্পর্কের উত্তরাধিকারি।
এতদিন মৃত মেয়েকে শিখণ্ডী বানিয়ে টাকা নিয়ে এসেছেন স্নেহাংশু। এবার পালা স্যমন্তকের। ফুসফুসের জটিল রোগে ধুঁকে ধুঁকে ইহলোক ত্যাগ করা কাকুর মিথ্যে অসুখের ফিরিস্তি দিয়ে যতদিন পারা যায় টানবে আর এর মধ্যে যদি পটিয়ে ফেলতে পারে মধুরিমার পালিত কন্যা তন্দ্রাকে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। তন্দ্রার বিহ্বল চাহনি আশা জাগাচ্ছে স্যমন্তকের মনে। তার ফেলা টোপটা বোধহয় বৃথা যায়নি। আইসিইউতে চলে যাওয়া বাবার ব্যাবসাটাকে এবার একটু একটু করে সারিয়ে তুলবে সে। সাদা খামটায় আলতো করে চুমু খেয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল স্যমন্তক।
বাসের গতি বেড়ে গিয়েছে। হু হু হাওয়া এসে ঝাপটা মারছে মুখে। প্রসন্ন চিত্তে সিটের ব্যাকরেস্টে শরীর এলিয়ে দিয়েছে স্যমন্তক। মধুরিমার বিক্রি হওয়া বাংলোর দাম, বর্তমান বাড়ির ভ্যালুয়েশন, বছর বছর জমতে থাকা গানের রয়্যালটি এসবের একটা আনুমানিক হিসেব মনে মনে কষে চলেছে সে।
আধো ঘুম আধো চেতনার ঘোরেই চোখের সামনে একবার ভেসে উঠছে অনেক অনেক টাকা আর একবার তন্দ্রার মুখ। হঠাৎ পথ চলতে চলতে কোনও দামি জিনিস কুড়িয়ে পেলে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমনই একটা খুশি চলকে উঠছে স্যমন্তকের মনে।
জীবনের এবড়োখেবড়ো পথে চলতে চলতে সেও যেন আচমকাই একটা স্বপ্ন কুড়িয়ে পেয়েছে। জোর করে চোখ বুজে থাকে স্যমন্তক ফিরে ফিরে দেখতে চায় স্বপ্নটাকে…।