এবার গাড়ি চলেছে সম্বলপুরগামী জাতীয় সড়ক ধরে। রাউরকেলা থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বেলা ১টা নাগাদ আমরা এসে পৌঁছোলাম সম্বলপুর-এ। মহানদীর তীরে অবস্থিত এই জেলাশহর দোকান-বাজার-হোটেল, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি, কোর্ট- পোস্ট অফিস-ব্যাংক নিয়ে বেশ ব্যস্ত ও জমজমাট। আমাদের গাড়ি এসে থামল একেবারে সমলেশ্বরী মন্দিরের কাছে।

মন্দিরে পূজিতা মা সমলেশ্বরী (সামালাই মা) পশ্চিম ওড়িশা এবং প্রতিবেশী রাজ্য ছত্তিশগড়-এ এক প্রভাবশালী ধর্মীয় শক্তি। প্রাচীনকাল থেকেই মা সমলেশ্বরী পূজিতা জগৎজননী, আদিশক্তি, মহালক্ষ্মী এবং মহাসরস্বতী রূপে। গ্রানাইটের মতো শক্ত পাথরে তৈরি মন্দিরের দুটি অংশ। ১২টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে ১০ ফুট চওড়া আচ্ছাদিত প্রদক্ষিণস্থল এবং বর্গাকৃতি গর্ভগৃহ চার-সিঁড়ি নীচে। গর্ভগৃহের বাহির দেয়ালে ১১ জন পার্শ্বদেবীর মূর্তি খোদিত। মা সামালাই দেবীর মূর্তি গঠিত এক প্রানাইট প্রস্তরখণ্ডে যা থেকে বেরিয়ে এসেছে শুঁড়ের মতো অংশ। বরাহরূপী মা সমলেশ্বরী স্থানীয় ভক্তজনের কাছে পরম আরাধ্যা।

গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা পৌঁছোলাম পান্থনিবাসে। দুটি ঘর বুক করা ছিল আমাদের নামে। দুপুর দেড়টা বাজে। হাত-মুখ ধুয়ে সবাই ছুটলাম ডাইনিং রুমে। খিদের মুখে ভাত-ডাল-তরকারি এবং মাছের ঝালকে অমৃত সমান মনে হল। ড্রাইভার সন্তোষও লাঞ্চ সারল আমাদের সঙ্গেই। যাত্রার পরিশ্রম ছিল না তেমন। তাই দুপুর আড়াইটে বাজতেই আবার আমরা জিপের সওয়ারি হলাম। উদ্দেশ্য, ২৮ কিমি দূরে হুমা গ্রামে মহানদীর তীরে অবস্থিত বিমলেশ্বর মহাদেব মন্দির দর্শন। গাড়ি শহর ছাড়াতেই রাস্তার দু’পাশে ধূসর সবুজের আহ্বান। ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে প্রায় ৫ কিমি যাবার পর ডানদিকে বেঁকে রাজ্য সড়ক ধরে আরও প্রায় ২০ কিমি এগোলাম। গাড়ি আবার ডানদিকে বাঁক নিয়ে গ্রাম্যপথে ৩-৪ কিমি এগোতেই পৌঁছে গেলাম হুমা-য়।

হুমার বিমলেশ্বর মহাদেব মন্দির অতি প্রাচীন। এই মন্দিরের নির্মাণ নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প, উপকথা এবং অস্পষ্টতা। তবে অলিপিবদ্ধ ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মন্দির প্রথমে নির্মিত হয় চৌহান বংশীয় প্রথম রাজা বলরাম দেব দ্বারা এবং সবশেষে ১৬১৭-১৬৫৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে, সম্বলপুরের রাজা বীর বালিয়ার সিং দ্বারা মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। মহাদেবের দৈনন্দিন পুজো ও ভোগ-এর ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজা নিকটস্থ কয়েকটি গ্রাম (হুমা, পুলপুতঙ্গা, মাহেল, ধাতুকাপালি, গঙ্গাধরপালি, ভৈরোপালি)-এর স্বত্ব দান করেন গ্রামের হোতা ব্রাহ্মণ পরিবারকে। বিশেষজ্ঞদের মতে হুমার বিমলেশ্বর মন্দির উত্তর-পূর্ব দিকে ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি হেলে দাঁড়িয়ে আছে। ২৫ ফুট উঁচু মন্দিরের চারিপাশে তৈরি করা হয়েছে ভারবহনকারী দালান তার আরও হেলে যাওয়া আটকাতে।

মন্দিরের হেলানো-গঠনের সঠিক কারণ আজও অজ্ঞাত প্রকৃত গবেষণার অভাবে। তাই এ ব্যাপারে বহুমত। কেউ কেউ বলেন, মন্দির তৈরির পরেই নাকি বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায় এবং তারপর থেকেই মন্দির হেলে যায়। অন্যেরা বলেন, মহানদীর তীব্র জলস্রোতের কারণে মন্দির উত্তর-পূর্ব দিকে হেলে যায়। মাটির গঠনকেও মন্দির হেলে থাকার কারণ বলে মনে করেন অনেকে। মন্দিরের বিমলেশ্বর মূর্তিটির বিশিষ্টতা লক্ষ্যণীয়। মন্দিরের পিছন থেকে এক বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে মহানদীর কাছে— তার নাম মাচিন্দ্রা ঘাট। বড়ো বড়ো পাথরে পূর্ণ নদীখাত, অন্যপাড়ে সবুজ বনানী — সব মিলিয়ে এক মনোরম দৃশ্য। হুমার হেলানো মন্দির মনে করিয়ে দেয় ইতালির বিখ্যাত হেলানো মিনার ‘পিসা’-র কথা।

সন্তোষ ততক্ষণে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে। এবার আমরা চলেছি চিপলিমায় ‘মা ঘণ্টেশ্বরী মন্দির দেখতে। সম্বলপুর থেকে চিপলিমার দূরত্ব প্রায় ৩৩ কিলোমিটার। মহানদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দিরে দূর দূর থেকে পূণ্যার্থীরা আসেন। মানত (ইচ্ছা) পূর্ণ হলে তাঁরা ঘণ্টা বেঁধে দিয়ে যান। অসংখ্য ছোটো বড়ো ঘণ্টার সমাবেশ মন্দির চত্বরে। বহুপূর্বে নাবিকদের তৈরি এই মন্দিরকে বলা হতো ‘আলোকহীন লাইটহাউস’। কারণ অসংখ্য ঘণ্টাধ্বনি নাবিকদের জানিয়ে দিত আসন্ন ঝড়ের সংকেত। চিপলিমা হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট মন্দিরের কাছেই নদীতীরে। নদীবুকে লম্বা, সরু সেতু পেরিয়ে পৌঁছোতে হয় মন্দিরে, বেশ অন্যরকম পরিবেশ মা ঘণ্টেশ্বরী মন্দির চত্বরে।

সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। আমরা দ্রুত ফিরে আসছি রাত্রিবাসের আস্তানা, সম্বলপুর-এর পান্থনিবাস-এ। সন্ধে সাড়ে ছ’টার পর আমরা ডেরায় ফিরলাম৷ সারাদিনের যাত্রাজনিত ক্লান্তির অনেকটাই দূর হল গরম চা-এ। রাতে গরম রুটি ও পনির-মশালায় ডিনার সেরে সবাই সটান বিছানায়।

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...