ভোর হচ্ছে৷ সূর্যের নরম আলো ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। সাড়ে ৮টার মধ্যেই সবার স্নান-প্রাতরাশ সারা। জিপে চেপে প্রথমে চলেছি ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে ১৫ কিমি দূরে মহানদীর বুকে হীরাকুদ বাঁধ দেখতে। এই বাঁধ স্বাধীন ভারতের প্রথম ও প্রধান ‘রিভারভ্যালি প্রোজেক্ট’গুলির অন্যতম। ১৯৫৩ সালে ড্যাম তৈরি সম্পূর্ণ হয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু এর উদবোধন করেন ১৯৫৭ সালে। গাড়ি পৌঁছোল ড্যাম-এর কাছে। জওহর মিনারে উঠে দেখলাম পিছনে সুবিশাল হীরাকুদ জলাধার, যার দৈর্ঘ্য ৫৫ কিমি। প্রধান ড্যামের দৈর্ঘ্য ৪৮ কিমি যা বাঁয়ে লামডুংরি থেকে ডাইনে চান্ডিলিডুংরি পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। সে এক চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। ড্যাম থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জলসেচ শুরু হয় ১৯৫৬ সালে। এশিয়ার দীর্ঘতম মাটির তৈরি বাঁধ হীরাকুদ সমগ্র ভারতের গর্ব।

দীর্ঘ যাত্রায় এবার আমরা চলেছি গন্ধমাদন পর্বতে অবস্থিত নৃসিংহনাথ মন্দির দেখতে। এই গন্ধমাদন পর্বতের বিস্তৃতি ওড়িশার বড়গড় ও বোলাঙ্গির জেলাদুটির মাঝে। বক্সাইট-এর বিপুল ভাণ্ডার এই পর্বতে। রামায়ণখ্যাত গন্ধমাদন পর্বত ভেষজ উদ্ভিদের আকর। বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র রিপোর্টে ২২০টি ভেষজ উদ্ভিদ প্রজাতির উল্লেখ আছে, যদিও স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করেন কম করেও ৫০০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায় এই পর্বতে। সেই কারণে ১০০ জনেরও বেশি ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের বাস গন্ধমাদন ঘিরে, যাঁরা প্রায় ৫০,০০০ আদিবাসীর চিকিৎসা করে থাকেন। এই পর্বতের দুই প্রান্তে, বড়গড় ও বোলাঙ্গির জেলায় দুটি আয়ুর্বেদিক কলেজ ও চিকিৎসালয় অবস্থিত। স্থানীয় আদিবাসীদের অনেকেরই প্রধান জীবিকা ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করা এবং সেগুলি নামমাত্র মূল্যে বিখ্যাত কিছু ওষুধ কোম্পানিকে যোগান দেওয়া। স্থানীয় অধিবাসীদের সক্রিয় আন্দোলন গন্ধমাদনের জৈব বিবিধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজও।

সম্বলপুর থেকে নৃসিংহনাথ মন্দির প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে। নিকটতম স্টেশন বড়গড় রোড থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ১১০ কিমি। বেলা ১১টা নাগাদ বড়গড়-এ পৌঁছে ১০ মিনিটের চা-বিরতি পেলাম। এবার ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে সোহেলা পৌঁছোলাম, তারপর বাঁদিকে বেঁকে রায়পুরগামী নুয়াপাড়া রোড ধরে পৌঁছে গেলাম পাইকমল। বেলা সাড়ে ১২টা বাজে। এবার আবার বাদিকে বেঁকে ৪-৫ কিমি পথ পার হয়ে পৌঁছোলাম বহু আকাঙ্খিত নৃসিংহনাথ-এ। গন্ধমাদনের উত্তর ঢালে অবস্থিত এই মন্দির বড়গড় জেলায় অবস্থিত। মন্দিরের অনেকটা আগে থেকেই গন্ধমাদনের বহু-বিচিত্র, ছোটোবড়ো ভেষজ গাছপালার নিমন্ত্রণ মনকে ভরিয়ে দিল এক অনাবিল আনন্দে। কলকাতার উৎকল ভবন থেকে পান্থশালায় দুটি ঘর বুক করে রাখা ছিল। পান্থশালার অবস্থান মন্দিরের কিছু আগে গাছপালায় ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে। শাল, পিয়াশাল, মেহগনি, জারুল-সহ আরও নানা প্রকার বৃক্ষরাজির সমাবেশ সেখানে। আমাদের ঠাই হল দোতলায়। ঘরের পিছনে বারান্দা, আর তার পিছনেই জঙ্গল। প্রথম দর্শনেই আমাদের চোখ ও মন কেড়ে নিল সেই পরিবেশ।

গন্ধমাদন পর্বতের উল্লেখ আছে রামায়ণে, মহাভারতে, ভোগরাজের স্মৃতিকথায়, নাগার্জুন-এর পুস্তকে এবং সন্ত কবীরের লেখায়। রামায়ণে বর্ণিত আছে, রাবণপুত্র ইন্দ্রজিতের শক্তিশেলে আহত, মৃতপ্রায় লক্ষণ-এর প্রাণরক্ষার জন্য পবনপুত্র হনুমান যখন বিশল্যকরণী সমেত হিমালয়ের এক বিশাল পর্বতখণ্ড কাঁধে চাপিয়ে আকাশপথে আসছিলেন, তখন সেই পর্বতখণ্ডের কিছুটা অংশ এই অঞ্চলে পতিত হয়। সেই অংশই পরে গন্ধমাদন (গন্ধমর্দন) পর্বত নামে পরিচিতি লাভ করে। বিখ্যাত চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং এই পর্বতের এক বিশেষ স্থানকে ‘পো-লো-মো-লো-কি-লি’ (পরিমলগিরি) নামে উল্লেখ করেন। তাঁর ভ্রমণকালে এইস্থানে একটি বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাটনাগড়ের রাজা বৈজল সিংদেব নৃসিংহনাথ মন্দিরের ভিত্তিস্থাপন করেন ১৩১৩ সালের ১৭ মার্চ। ৪৫ ফুট উঁচু মন্দিরের দুটি অংশ– প্রথম অংশে নৃসিংহনাথ-এর আসন, দ্বিতীয় অংশ জগমোহন-এর জন্য নির্দিষ্ট। মন্দিরে তিনটি দরজা, প্রতিটাই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে। মন্দিরের পাথরে তৈরি দরজা এবং কষ্ঠিপাথরে নির্মিত বিগ্রহ, মার্জার কেশরী বিষ্ণু বা বিড়াল নৃসিংহ মূর্তি অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

মন্দিরের পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে পাপহরণ নালা পার গন্ধমাদনের জঙ্গলে। মন্দির থেকে চালধারা, ভীমধারা এবং সীতাকুণ্ডের দূরত্ব যথাক্রমে ৪০০, ৪২৫ এবং ৫০০ মিটার। জঙ্গলের ভিতরে ৪ কিমি ও ৭ কিমি দূরত্বে কপিলধারা ও সুপ্তধারা। এইসমস্ত ঝরনা ধারা মিলিত হয়ে মন্দিরের কাছে সৃষ্টি করেছে পাপহরণ নালা । ভক্তজনের বিশ্বাস, এই পাপহরণ নালায় স্নান করে পাপমুক্ত হওয়া যায়। জনমানসে বিশ্বাস, পঞ্চপাণ্ডব বনবাসকালে এই স্থানে কিছু সময় কাটিয়ে যান।

জঙ্গল ও পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে বিকেল সাড়ে ৪টেয় চা পান করলাম সকলে মিলে। সন্ধে নেমেছে গন্ধমাদনে। সকলে চললাম মন্দির অভিমুখে সন্ধ্যারতি দর্শনে। সন্ধে ৬টায় শুরু হ’ল আরতি। নিস্তব্ধ, পাহাড়ি জঙ্গলময় পরিবেশে দেবারতির স্নিগ্ধ আলোর ছটা এবং কাঁসর-ঘণ্টা-ঢাকের শব্দ তৈরি করল এক অচেনা মায়াময় পরিবেশ। সন্ধ্যারতি শেষ হলে কেউ কেউ পুজো দিল। পান্থশালায় ফিরলাম সন্ধে সাড়ে ৭টায়। চা-পকোড়া সহ গল্প চলল বেশ কিছুক্ষণ। রাত ৯টায় সেরে নিলাম পরিচ্ছন্ন, তৃপ্তিকর নিরামিষ ডিনার।

(চলবে)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...