ইন্টারভিউ দিতে এসে কেমন যেন গা-টা পাক দিচ্ছে ঋতমের। একটু বাড়তি-ই টেনশন হচ্ছে আজ তার। এর আগেও তো বারকয়েক ইন্টারভিউ সে দিয়েছে। কোনওরকম ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তবু আজ যে কী হল ওর! হয়তো মার কথা ভেবে স্নায়ুর চাপ খানিক বেড়ে গেছে। হাসপাতালে ভর্তি। ঠিক করে যে চিকিৎসা চালাবে সে ক্ষমতাও নেই তার। আশ্রমের গুরুজির দয়ায় চিকিৎসা চলছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ডাক পড়ল, নেক্সট… ঋতম রায়। নামটা শুনেই উঠে দাঁড়ায় সে। খানিক মনোবল সঞ্চয় করে। আস্তে আস্তে ইন্টারভিউ রুমে ঢুকে পড়ে।
‘মে আই কাম-ইন স্যার?’
‘ওহ্, ইয়া ইয়া।’
‘প্লিজ সিট।’
বসে ঋতম। অ্যাকাডেমিক ফাইলটা বাড়িয়ে দিতে যাবে এমন সময় ইন্টারভিউয়ার-দের মধ্যে থেকে এক মহিলা প্রশ্ন করে ওঠেন,
‘তোমার নাম?’
‘ঋতম রায়।’
‘বাবার নাম?’
‘নীহারেন্দু রায়।
ঋতম মনে মনে অবাক হয়ে যায়। এর আগেও তো সে বারকয়েক ইন্টারভিউ দিয়েছে, কোথাও তো তার নিজের নাম ছাড়া… আরও অবাক হয়ে যায় পরের প্রশ্নটা শুনে, মা-র নাম?’
“কাকলি’ নামটা বলে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে সেই মহিলার দিকে। মহিলার চোখেমুখে এক অদ্ভুত দীপ্তি লক্ষ্য করে ঋতম। কী যেন উৎসাহ ওনার। যেন আরও কিছু জানতে চান। ভাবে ইন্টারভিউ রুমের ভিতর তো আরও জনাপাঁচেক ম্যানেজমেন্টের লোক রয়েছে— তারা তো কেউ…! অবশ্য এর মাঝে এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উনি থামিয়ে দেন। মহিলা তার মায়েরই বয়সি হবে। এখনও বেশ সুন্দরী। চেহারায় রয়েছে আভিজাত্যের ছোঁয়া।
‘তোমার বাবা কী করেন?’ সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে চমকে ওঠে সে। কোনওমতে একটা বেপরোয়া জবাব দেয়, ‘আমার জন্মের আগেই বাবা, মা-কে ছেড়ে চলে গেছেন। তার পর আর ফেরেননি। মা বলেন বাবার সঙ্গে নাকি ওনার বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বাবা-মা একে-অপরকে অনেকদিন ধরে ভালোবাসতেন। কিন্তু বিয়ের দিনকয়েক আগে থেকেই ওনার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।’ মুখস্তের মতো কথাগুলো বলে থেমে যায় ঋতম। বেশ আরাম লাগছে। অযথা এই সম্পর্কের চাপ বয়ে বেড়াতে আর ভালো লাগে না। কিন্তু সে নিরুপায়।
‘এই যে কথাগুলো বললে, এতে তোমার মনে হয় না কী, এর কারণে তুমি চাকরিটা না-ও পেতে পারো? নাকি সিমপ্যাথি ড্র করতে চাইছ?’
মহিলার প্রশ্ন শুনে বেশ রুক্ষভাবেই জবাব দেয় ঋতম, “চাইলে আপনারা চাকরিটা না-ই দিতে পারেন, সেটা আপনাদের অভিরুচি। তবে এটা আমার নেগেটিভিটি বলে আমি মনে করি না। এর জন্য তো সত্যিটা বদলে যাবে না। আর সিমপ্যাথি ড্র করার কথা বলছেন, ছোটো থেকে যেভাবে ঠোক্কর খেয়ে মানুষ হয়েছি তাতে এই সমস্ত ইমোশন-টিমোশন আর আমার আসে না। ধন্যবাদ,’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে ঋতম।
“উঠে দাঁড়ালে যে বড়ো? তোমাকে তো চলে যেতে বলা হয়নি।’
‘না, আপনি যেভাবে…’ কথা শেষ না করেই থেমে যায় সে।
‘আরে বোসো বোসো। এই বয়সে এত অ্যারোগ্যান্ট হওয়া ভালো নয়। তোমার চিন্তাভাবনা তো বেশ ভালো। এর আগে চাকরি করেছ কোথাও?’
“না। এই বছরেই বিকম পাশ করেছি। এখন কয়েকটা টিউশন করি।’
(ক্রমশ…)