অবাক হচ্ছেন তাই তো?  আসলে ওর সংস্কার, চিন্তাভাবনা, ব্যবহার দেখে খুব জানতে ইচ্ছে করছিল কে সেই মহিলা যিনি তার সন্তানকে এভাবে গড়ে তুলেছেন। বিশ্বাস করুন আপনাকে দেখার লোভ সংবরণ করতে পারিনি। ঋতমকে দেখার পর তাই এভাবে ছুটে এসেছি। ওনার কথায় খানিক অপ্রস্তুতে পড়ে যান ঋতমের মা। ঠোঁটের কোণায় ঈষৎ হাসি খেলে যায় ছেলের প্রশংসা শুনে।

‘আপনি বোধহয় একটু বেশিই প্রশংসা করছেন।’ কিন্তু মন থেকে কিছুতেই নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না যে এটাই সঠিক। মহিলা বোধহয় আর একমিনিটও অপেক্ষা করতে চাননি। তাই না ইনিয়েবিনিয়ে সোজাসুজি ঋতমের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে বসেন।

কাকলিদেবীও ঠিক ছেলের মতোই সোজাসাপটা ভাবে জবাব দিলেন, ‘তিনি তো আমাদের সঙ্গে থাকেন না।’

‘এই পর্যন্ত তো আমি ঋতমের মুখে শুনেছি। আপনি এটা বলুন, তিনি কি জানতেন যে আপনি সেই সময় গর্ভবতী ছিলেন?”

অচেনা এক মহিলার আকস্মিক এই প্রশ্নে কেমন যেন খতিয়ে যান কাকলি। দ্বিধা কাটিয়ে জিগ্যেস করে ফেলেন, ‘আপনি কি কোনও সূত্রে আমাকে বা ঋতমের বাবাকে চেনেন?

‘চেনাটা কি খুব জরুরি বোন? দুটো অপরিচিত মানুষ কি বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না?’ সপ্রতিভ ভাবে জবাব দেন কাকলি ইন্ডাস্ট্রিজ-এর সর্বময় কর্ত্রী।

“জানি না কেন অপরিচিত জেনেও আপনাকে আজ সব বলতে ইচ্ছে করছে। কেন বলুন তো? কেন যেন মনে হচ্ছে যে আপনাকে সব বলা যায়। আপনি যে কী উদ্দেশ্যে এই সমস্ত প্রশ্ন করছেন আর আমিই বা আপনাকে অ্যালাও করছি কেন… কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আজ আপনাকে বলব।’ একটা চাপা নিশ্বাস ছাড়েন কাকলিদেবী। তারপর মাথা নীচু করে জবাব দেন, ‘না, ও জানত না আমি মা হতে চলেছি।’

একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মহিলা। বোধকরি বুকের ওপর থেকে পাথরটা সরে গেছে। মনে মনে খানিক আশ্বস্ত বোধ করেন তিনি। উনি যে কেন চাপা পড়া পুরোনো ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছিলেন কাকলিদেবীর কাছেও সেটাও পরিষ্কার ছিল না।

“আচ্ছা ঋতমের বাবা মানে নীহারেন্দুবাবুর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণটা কী ছিল?’ আবার ঋতমের মা-র দিকে প্রশ্ন ছোড়েন কাকলি ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালকিন।

প্রশ্নের খোঁচাতে সমস্ত অতীতের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাকলিদেবীর। অবলীলায় বলে ফেলেন ‘এই প্রশ্নের উত্তর আজও আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। জানেন সাতবছরের ভালোবাসা ছিল আমাদের। আমাকে চোখে হারাত। বিয়ের আগে একবার হঠাৎ করে মাসির অসুস্থতার কথা শুনে দেওঘর চলে গেছি। ওকে জানানো হয়নি। তখন তো অ্যাতো ফোনের চল ছিল না। আমারও মনটা খারাপ। ইস্ তাড়াহুড়োতে ওকে জানাতে পারলাম না। জানালার ধারে বসে আছি। হঠাৎ দেখি কে যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। জানতে পারলাম, আমাদের কাজের লোক দাসুদার থেকে ঠিকানা নিয়ে ওখানে হাজির হয়ে গেছে। তারপর সে যে কী অবস্থা, আপনাকে কী বলব। বাড়িতে জানাজানি। হইহুল্লোড়। তারপরেই তো বিয়ের ঠিক হয়ে গেল। থাক সে-সব ছাড়ুন। সেসব এখন গল্পকথা।’ থেমে যান কাকলিদেবী।

“না না থাকবে কেন? বলুন না।’ তখনও কাকলি ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালকিনের চোখেমুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ।

‘জানেন সেই দিনটা ছিল রবিবারের এক বিকেল। তার দিন দুয়েক পরেই আমার জন্মদিন। নীহার সেই শুক্রবার দেখা করেছে আমার সঙ্গে, তারপরে দুদিন একেবারে বেপাত্তা। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যে-ছেলে আমাকে একবেলা না দেখে থাকতে পারে না, সে হঠাৎ গেল কোথায়? জ্বর-টর বাধিয়ে বসেনি তো? মনটা কিছুতেই কাজে বসাতে পারছিলাম না। আমার বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি মিনিট কুড়ি। সকাল থেকেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। না থাকতে পেরে বিকেলবেলা একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওর বাড়িতে গিয়ে তো অবাক। জানেন ও ভীষণ ভালো ছবি আঁকত। দেখি একটা বিশাল পোর্ট্রেট এঁকেছে আমার। জানতে পারলাম ওটা নাকি আমার জন্মদিনের গিফ্‌ট।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...