তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে ফুলমণি আকাশের দিকে চোখ রেখে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকে। এই দিকটাতে আলো নেই, চারদিকের অন্ধকার মেঘের জন্যে আরও গুমোট, তাঁবুর ভিতরেও হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। পাশে মেয়েদের তাঁবুটাতেও রান্না চেপেছে, কারওর মোবাইলে গান বাজছে। ছেলেদের তাঁবুতে এই সময় এক-দু’জন বাদে কেউ থাকে না, ওরা রান্না করে না, মেয়েদের তাঁবুতেই রান্না করা হয় — সবাই তো বউ-বর বা মা-ছেলে।

মেয়েদের একটা তাঁবু, আর ছেলেদের আলাদা একটা। শুধু ফুলমণিরাই আলাদা থাকে। তাঁবুটা ওদের টাকাতেই তৈরি করা। ফুলমণি দেখে একটু দূরের চায়ের দোকানটা এখনও খোলা আছে। বেশ কয়েকবার ওই দোকানে পাউরুটি কিনতে গেছে। ঘরের মানুষটার মতিগতি সব সময় ভালো থাকে না। মাঝে মাঝে ফুলমণির মনে হয় সকাল আর রাতে দু’জন আলাদা লোকের সাথে ঘর করে! পেটে জল পড়লেই হয়ে গেল, কতদিন ভাতের হাঁড়ি উলটে দিয়েছে, তখনই দোকানে খাবার কিনতে যেতে হয়।

চায়ের দোকানটাতে গিয়ে অনেকবার কথাও বলেছে। দেখে খুব মায়া হয়! লোকটার বয়স হয়েছে, ছেলে মেয়ে কেউ দ্যাখে না। বউটাও অসুস্থ। দোকানের পিছনেই একটা ছোটো জায়গায় ওরা দু’জন থাকে। বউটা ওখানেই শুয়ে থাকে। ফুলমণি একবার দোকানের লোকটাকে, ‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করেছিল।

লোকটা কেমন ভাবে বলে উঠেছিল, ‘আর কী হয়েছে! বেঁচে আছে এই…’

বউটা চোখ ঘুরিয়ে ফুলমণিকে দেখেছিল। তারপর থেকে ফুলমণি দোকানে গেলেই বউটাকে দেখে। বুঝতে পারে ভালো ঘরের মেয়ে, রোগে ভুগলেও গায়ের রং এখনও বেশ চকচকে। কয়েকদিন আগে দোকানিটা অন্য আরেকজন খদ্দেরকে বলছিল, “আর ক’দিন থাকতে দেবে কে জানে? শুনলাম সেন গুমটির কাছে সব দোকান ভেঙে দিয়েছে, আমাদের এদিকটাও ভাঙবে।” ফুলমণি কথাগুলো শুনে নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দোকান ভেঙে দেবে, কেন?’

লোকটা ফুলমণির মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘এই যে তোমরা রাস্তা তৈরি করছ।’

মনটা খারাপ হয়ে যায়, কথাগুলো কাউকে বলতে পারে না! হারুকে বললেই এক্ষুনি খেঁকিয়ে উঠবে। সে নিজে এই কয়েক বছরে অনেক জায়গায় রাস্তা তৈরি করতে গেছে। দেখেওছে কীভাবে রাস্তা তৈরি করবার আগে কত জায়গার দু’দিকের ঘরবাড়ি দোকানঘর ভেঙে দেয়। এখানেও প্রথম দিকে কয়েকটা দোকানঘর ভেঙেছিল।

ফুলমণির এসব দেখে কষ্ট হয়, একবার ঝড়ে ওদের নিজেদের গোয়ালঘর ভেঙে গেছিল। দু’টো গরু সারাটা রাত ভিজেছিল। এদিকেও রাস্তা একদিকে তৈরি হয়, আরেক দিকে গাড়ি চলে। রাস্তা হয়ে গেলে এখন আবার পাথর বসায়, একটা কী যেন নাম আছে। ফুলমণিদের অবশ্য তখন ডাকে না।

একটু আগেই ও পুকুরে স্নান করে এসেছে। পুকুরটা একটু দূরে, তাও সন্ধেবেলাতেও সবাই মিলে স্নান করতে গেলে খুব একটা অসুবিধা হয় না। প্রতিদিন দু’বার করে স্নান করবার জন্যে প্রথম দিকে ঠান্ডা লাগত। এখন সবকিছু কেমন যেন সয়ে গেছে।

—কি রে ফুলু, আজ কী করবি, আটা খাবি, নাকি ভাত চাপাবি?

—আটা খেতে লারি, গলা দিয়ে নামতেই খুঁজে না, গেল হপ্তাতে কয়েকদিন আটা খেয়িছিলম, হাগা আর বাগাতে লারি, ক’টা ভাতই ভালো, তুমি কী করছ?

—আমার তো একার কথাতে কিছু হবেক নাই, সবাই রুটি সেঁকছে। ভাত কালকের লগে, পান্তা করবেক।

কথাগুলো বলে লোকটি এগিয়ে গেলেও পিছন থেকে ফুলমণি ডাকে, ‘ও, খুড়ো, বড়োবাবুর কী খবর, এখনও টাকা দিলেক নাই।’ খুড়ো একটা শ্বাস ছাড়ে। হাওয়ার শব্দ ফুলমণির কান দিয়ে মাথার ভেতরে পৌঁছে যায়।

—সেই তো, গেল হপ্তা থেকে পাঁয়তারা কষছে। হারু কই?

—সাঁঝের ব্যালা কুথাকে থাকে?

খুড়ো আর কথা না বলে একপা একপা করে নিজের তাঁবুর দিকে যায়। খুড়োর বয়স হয়েছে, এখন একটু বেশি কাজ করলেই হাঁপায়। কয়েকদিন আগেও মাটি কুপাত, মাথায় করে গরম পিচ মেশাত, পাথর ফেলত। এখন শুধু রোলার গাড়িটার সামনে ভিজে বস্তা ধরে আর বাকি টুকটাক কিছু কাজ করে।

ফুলমণি খুড়োর সাথে কথা শেষ করেই নিজের তাঁবুতে ঢোকে। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। এইবেলা ভাতটা করে নিলে অনেকটাই ফের কাটে। ফুলমণিরা আগে একটা তাঁবুতেই থাকত, তখন এই ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে ছিল না। মরদগুলো সারাটা দিন জানোয়ারের মতো খাটত। কাজ শেষ হলে কয়েকজন পিচ গলানোর কাজ করলেও বাকিরা চলে যেত। রাত বাড়লে টলতে টলতে তাঁবুতে ফিরত। যারা পিচ গলাত তারাও যে গিলত না সেটা নয়, তাও ওদের সব কিছু বাঁচিয়ে করতে হতো।

এই দলে কম বয়সি মেয়েছেলেগুলোও মদ মারে। না হলে ওদের শরীর কেমন যেন ম্যাদামারা হয়ে যায়, তারা কেউ বাইরে যায় না। ফুলমণি প্রথম প্রথম অবাক হয়ে দেখত। টানা পাঁচদিন কাজের পর একদিন ছুটি থাকত, সেদিনের জন্যে তারা টাকা না পেলেও সবাই সন্ধেবেলা তাঁবুর ভেতরে বসে যেত, সামনের কোনও দোকানে ঝাল ঝাল করে চপ বা অন্যকিছু ভাজাত তারপর…

ফুলমণির লোকটার অবশ্য এইসব পোষাত না। দোকানে না গেলে তার নেশা জমত না। ফুলমণিরও খুব সাধ হতো, ছুটির বেলায় সবার সাথে বসে একটু মজা করবে। কিন্তু সেই সময় পেটে শত্রু চলে আসত। এটাই ফুলমণির সব থেকে অসুবিধার। শত্রু আসত, কয়েকটা মাস পেটেই বড়ো হতো, তারপর পেটের ভেতরেই মরে যেত। ফুলমণির সেই সময় খুব রক্তপাত হতো। কয়েকদিন তাঁবুর ভেতরেই শুয়ে থাকতে হতো। কাজ করতে পারত না। এটাই ঝামেলার, শত্রু এলে আর ভালো কাজ হয় না।

ক্রমশ…

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...