বোধহয় লোডশেডিং! নীচের বার্থে শুয়ে আইরিন ঘুম-ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় এলাম?’

ওর কথায় আমার চিন্তার স্রোত থেমে গেল। বললাম, ‘বুঝতে পারছি না, বোধহয় কানপুর।’

—আপনি ঘুমাননি? ঘুমজড়িত গাঢ় মধ্যরাত্রির স্বরে জিজ্ঞেস করল আইরিন।

হেসে উত্তর দিলাম, ‘ট্রেনে ঠিক ঘুমোতে পারি না। তাছাড়া, ঘুমিয়ে দ্রুতগামী ট্রেনের রোমান্টিক মাদকতাও নষ্ট করতে চাই না।” আইরিন ঘুম জড়ানো গলায় বলল, ‘আমি কিন্তু গাড়িতে বসলেই ঘুমিয়ে পড়ি, আর গাড়ি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই ঘুম ভেঙে যায়। বোধ হয় গাড়ির দোলানি থেমে যায় বলে!”

—হ্যাঁ, তাইতো দেখলাম। স্মৃতি রোমন্থনের ‘Pause’ বোতাম চেপে বললাম আমি। একটা ধাক্কা দিয়ে গাড়িটা হঠাৎ চলতে শুরু করল।

—গ্রেট! বলে আইরিন কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল।

একটু পরেই গভীর নিশ্বাসের শব্দে জানিয়ে দিল, ও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মুচকি হেসে ফিরে গেলাম আমার স্মৃতি রোমন্থনের জগতে।

পিএইচডি’র কাজের সময়ই শুভ’র (আমি ওকে এই নামেই ডাকতাম) জীবনের পথ সঠিক মোড় নিতে শুরু করেছিল। এক বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে পরিচয় হল এক সেমিনারে। প্রফেসর স্যান্ডারসন শুভকে আহ্বান জানালেন আমেরিকার ভুবন-বিখ্যাত কারিগরি গবেষণাগার এমআইটি (MIT)-তে ওঁর সঙ্গে কাজ করতে। এক কথায় রাজি হয়ে গেল শুভ। এটাই ছিল ওর চরিত্রের স্বতঃসিদ্ধ। সুযোগ এলে ছাড়বে না। কেন না সেটা বারবার আসে না। পিছনের টানে সামনের হাতছানিকে অগ্রাহ্য করতে নেই। ও আমাকে সবসময় একথা বলত। আমি তা করতে পারিনি। বোধহয় জোরালো ইচ্ছা আর এত লম্বা ঝাঁপ দেবার মতো সাহসের অভাব ছিল।

এর মধ্যে শুভ আর জানকীর একটি ছেলে জন্মেছে। তারা মাধোপুরের বাড়িতে ওর বাবা-মা’র কাছেই থাকত। শুভই ছেলের নাম রেখেছিল, রাহুল। তারপর, শুভ একদিন আরব সাগর পেরিয়ে ইউরোপের সীমা ছাড়িয়ে আটলান্টিক অতিক্রম করে আমেরিকায় পৌঁছে গেল।

ওখানে পৌঁছে আমাকে লিখেছিল, শোভন, মনে হচ্ছে এতদিনে আমি আমার সঠিক স্থানে পৌঁছে গেছি। এখানে এত সুযোগ আর এত কাজ, মনে হয় একটা জীবন ভীষণ ছোটো পড়ে যাবে রে। অনেক কাজ বাকি থেকে যাবে! আচ্ছা, একটা দিনকে টেনে-হিঁচড়ে আরও বড়ো করা যায় না? চব্বিশ ঘণ্টা বড়ো কম ভাই। মনে হচ্ছে আরও আগে কেন এখানে এলাম না? জীবনের কতগুলো দামি বছর নষ্ট হয়ে গেল। তুইও চলে আয় শোভন, একসঙ্গে কাজ করা যাতে দিনরাত। দিনগুলোকে বড়ো করার এইতো একটা সহজ উপায়, শোভন!

আমি ওকে লিখেছিলাম— ‘শুভ, সবাই যদি অমৃতের সন্ধানে দৌড়োয় তাহলে এ পোড়া দেশটার কী হবে ভাই?’

উত্তরে আমাকে লিখেছিল, ‘তুই আইডিয়ালিস্টই রয়ে গেলি, তবে আমি অমৃত নিয়ে এখানে বসে থাকব না। দেশে ফিরে গিয়ে বাকি সবাইকে তার আস্বাদ দেব।”

ইতিমধ্যে হঠাৎ ওর বাবা হার্টফেল করে মারা গেলেন। শুভ এসে পারলৌকিক কাজকর্ম করে চলে গেল, জানিয়েছিল আমায়। মাঝে মাঝে দেশে এসে দু’একদিন বারাণসী ঘুরে আসত। আর মা, বউ-ছেলের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠাত।

নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল! শুভ, তুই কথা রাখিসনি কিন্তু। শেষ যোগাযোগ হয়েছিল প্রায় দশ বছর আগে। পর পর অনেকগুলো ই-মেইল-এর জবাব যখন এল না, তখন আমি বুঝলাম, আমাদের শুভ অনেক বড়ো হয়ে গেছে। আমার ছোটো-সীমিত জগতে আর ওকে ধরে রাখা যাবে না। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। শুধু ওর নতুন নতুন থিওরি আর আবিষ্কারের কথা জানতে পারলে খুশি হতাম। প্রথম প্রথম বিভিন্ন নামি বিজ্ঞান বিষয়ক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলির প্রিন্ট-কপি পাঠাত আমাকে। পরে, বুঝি ব্যস্ততার কারণে সেগুলি আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...