পিনভ্যালির শেষবিন্দুতে গিয়ে নেমে পড়লাম। চারপাশ পিনড্রপ সাইলেন্স মাঝে দু’একটা পাখি উড়ে গেল। দূরে শ্বেতকায় প্রাচীরের অসম্ভব সুন্দর আর্কিটেকচারাল ভিউ দেখে পলক পড়ছে না। সেই পাহাড়ের মাথায় কিছু ইরেস্পন্সিবল মেঘের আনাগোনা কোথা থেকে মেঘদূত কাব্য বয়ে আনল!
বেসুরো খ্যাঁচাখ্যাঁচ শব্দে সব ছবি তুলছে আনাড়ি পাবলিক একটু হল্লা করে দূষিত করছে মনে হল। সবার মাঝে একলাটি আমি পিনভ্যালি জাতীয় উদ্যানের শেষ বিন্দুর দিকে এগিয়ে গেলাম। স্নো লেপার্ডের চারণভূমি। হঠাৎ করে যদি একটির সাথে দেখা হয়ে যায়! কিন্তু তা কি হবার? প্রকৃতি ঠিক মেপে দেন আমাকেও দিলেন।
দেখলাম শরৎ কালের একটা শীত শীত সাদা মেঘ একরাশ প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে থমকে আছে; আগাপাশতলা শহুরে আমায় দেখে। চোখের সামনে দেখলাম ওই বর্তুলাকার মেঘের মধ্যিখানটা গোল ফাঁকা হয়ে গেল আর আমার দেখা পাহাড়ের সব উৎসারিত আলো যেন ঝরনা হয়ে ঝরে পড়তে শুরু করল আশীর্বাদের মতো।
হঠাৎই অনেক দূর থেকে গাড়ির একটানা হর্নের শব্দ সবেগে এসে ঝাপটা মারল কানে। এইবার তাহলে আসি পাহাড়।
পরের দিন খুব সকালে রওনা দিলাম পৃথিবীর সুউচ্চ গ্রাম দেখতে, যেখানে মানুষ স্থায়ী ভাবে বসবাস করে সংসার ধর্ম করে। সমান্তরাল দৃষ্টি পথে কেবলই ন্যাড়া পাহাড় সারিবদ্ধ। ১৪,৭০০ ফিট উচ্চতায় কিব্বের গ্রাম দেখে বলে ফেললাম ওমা এতো পুরো ঝুলনের মতো। ডাইভার অবাক চোখে আমায় দেখে কী মানে বুঝল ভগা জানে! চোখের সামনে দেখছি মাটির প্রলেপে প্রলেপিত একই গঠনশৈলীর ঘরবাড়ি। ব্যাকড্রপে নিষ্কলুষ উজ্জ্বল সমুদ্র নীল আকাশ যেন চাঁদোয়া। এই কিব্বের গ্রাম স্কুল, পোস্ট অফিস, এসটিডি বুথ নিয়ে স্বয়ং সম্পূর্ণ। কিব্বেরের উত্তরে রয়েছে তিব্বত আর পশ্চিমে রয়েছে লাদাখ। এই কিব্বের গ্রামকে বেসক্যাম্প করে সারা পৃথিবী থেকে ফোটোগ্রাফাররা স্নো লেপার্ডের ছবি তুলতে আসে।
পরবর্তী ডেসটিনেশন লোসার। এই দীর্ঘ যাত্রাপথটি অসাধারণ বৈচিত্র্যময়। ধূসর কঠিন বালির স্তূপের মতন সাজানো ভাস্কর্য সমস্ত রাস্তা জুড়েই। চলন্ত গাড়ি থেকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বাদ পড়ছে না তো? আসলে এই সফরের শেষ দিনক’টি-তে রাস্তার দু-পাশের সবকিছু সাইট সিইং, মাঝেমধ্যে এক আধটা গুম্ফার স্টপেজ। বেলা তিনটে নাগাদ গাড়ি একটা বিশাল অববাহিকায় দাঁড়াল ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে, পাহাড়ও গেল সরে। আমারা রাস্তার ধারে সরঞ্জাম নামিয়ে মুড়িমাখা খাওয়ার একটা ব্রেক নিলাম। একদম পশ্চিমপ্রান্ত তাই সূর্য পাটে যাওয়ার আগে দিনানুদিনের হিসেব রেখে যায় প্রকৃতিতে।
সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম লোসার। ১৩, ৪০০ ফিট হাইটে প্রথম রাত্রিবাস। সাদা রঙের উত্তুঙ্গ শিখর চতুর্দিক থেকে ঘিরে রেখেছে লোসার-কে। দু’চারটে বাড়িঘর নিয়ে লোসার গ্রাম। আসন্ন শীতের রসদ বলতে সবাই চেরাই কাঠ বোঝাই করেছে। রাত্রিবাস করব দোতলা একটা মাটির বাড়িতে।। ঘরে একটু উঁচুর দিকে ঘুলঘুলি টাইপের জানলা— যা কাচ ও প্লাস্টিক দিয়ে আটকানো। ঘরটিতে বাইরের অক্সিজেন আসার সম্ভাবনা খুব কম। মানুষ এখনও এই ভাবে থাকে সত্যিই? বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটালেও মেনে নিতে বাধ্য হই এটাই এদের প্রাণের জায়গা। এইভাবে জীবন যাপনেই এরা অভ্যস্ত। যারা পাহাড়কে ভালোবাসেন না তাদের এই সফর বাকেট লিস্টে না রাখাই ভালো।
(ক্রমশ…)