নাকোর পরেই খরাক্লান্ত ঊষর হিমালয়ের মরুভূমির গহ্বরে আমরা এগিয়ে গেলাম। কখনও নীলাভ, কখনও পীতবর্ণের বা তামাটে রঙের সাজে সদা ব্যস্ত হিমালয়। নাম না জানা স্থপতির ছোঁয়ায় অপূর্ব ভাস্কর্য। শিল্প বৈচিত্রের মদিরায় আমরা নির্বাক। বৃক্ষ, পল্লবহীন সম্পূর্ণ ন্যাড়া প্রকৃতি যে এমন বর্ণময় ও বিরামহীন ভাস্কর্যমণ্ডিত হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় এই সৃষ্ট সম্ভার একই সঙ্গে এত রুক্ষ ও সুললিত কবিতা শোনায়নি আগে।
এরপর রাস্তা ক্রমশ চওড়া সমান্তরাল হওয়ায় আমরা দিনের আলোতেই টাবো পৌঁছে গেলাম। টাবোর প্রধান আকর্ষণ টাবো মনাস্ট্রি এবং হিমালয়ান অজন্তার জন্য। ৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত টাবো মনাস্ট্রি প্রাচীনত্ব ও গুরুত্বের বিচারে তিব্বতের থোলিং মনাস্ট্রির পর দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। টাবো কিন্তু মাটির সঙ্গে একাত্ম। কিছুটা মধ্য এশিয়, কিছুটা উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা এবং কিছুটা মেক্সিকোর মরু অঞ্চলের স্থাপত্যশৈলী টাবোর আনাচকানাচ ভরিয়ে রেখেছে। এটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
ঘুরতে ঘুরতে মনে হচ্ছিল এ যেন অন্য দেশ, অন্য মাত্রা পেরিয়ে অন্য এক সময়কে ধরে রেখেছে। আমরা যারা মানব সভ্যতার এঁটোকাঁটা ঘেটে বিশ্বায়নের বুলি আঁকড়ে খ্যাতির শিরোনামে আকচাআকচি করছি, টাবো তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন যেন গ্রামীণ মৃৎশিল্পীর এক শীতল স্পর্শ। পরের দিন টাবো মিউজিয়াম এবং সমস্ত দর্শনীয় স্থান দেখে আমরা রওনা দিলাম ঢাঙ্কার বা ধনকর মনাস্ট্রির উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে কাজা সদর শহরে ঢুকব।
যাবার রাস্তা অত্যন্ত বিপদসংকুল, ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার চান্স আছে তাই ড্রাইভার মাঝে মাঝে উইন্ডস্ক্রিনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তদন্ত করছে। পৌঁছে গেলাম ঢাঙ্কার মনাস্ট্রিতে। ঢাঙ্কার মনাস্ট্রিকে দূর থেকে দেখে মনে হল একটা প্রকাণ্ড উইঢিপি গায়ে আটকে আছে। অতি অদ্ভুত তার গঠনশৈলী। প্রবেশ পথের সম্মুখ দ্বারে মুখে গ্র্যান্ডক্যানিয়নের ভাঁজ নিয়ে অশীতিপর এক বৃদ্ধ বসে আছেন। কী এক অনুষ্ঠানের জন্য বেশ একটু ভিড়, রঙিন পতাকা চারিদিকে লাগানো। কাছে গিয়ে দেখি গুম্ফা কিন্তু বড়োই রাজকীয়, কিছুটা উদাসীন গুরুগম্ভীর অবয়বে শান্ত। ভেতরে ঢুকি সমীহ নিয়ে। ঢাঙ্কার গুম্ফা ভেতরে বাইরে দারুণ রূপময়। ভেতরে রহস্যময় গভীর হাতছানি। ঢাঙ্কার একসময় স্পিতির রাজধানী ছিল এবং গুম্ফার অবস্থানটিও অবিস্মরণীয়। স্ট্যালোনের ক্লিফ হ্যাঙ্গার ছবির দৃশ্যায়নের মতো তার ভৌগোলিক দেখনদারি। নীচের উপত্যকার শত্রুদের নজরদারির জন্য এমন গঠনশৈলী। প্রাচীনকালের স্পিতির শাসনকর্তা নেনে রাজবংশের রাজপ্রাসাদ ছিল এটি।