দেখতে পেলাম অনেকগুলো চিংড়ি মাছ। বুঝতে অসুবিধা হল না এগুলো মাছের চার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কতক্ষণ হল আছেন এখানে?’ উত্তর পেলাম, “তা হবে চার-পাঁচ ঘন্টা।’ পাশেই দেখলাম আরেকজন ভদ্রলোক বঁড়শিটা জলে দিয়ে নিজে বসে বসে গল্পের বই পড়ছে।

এখানে অনেকেই শখে মাছ ধরতে যায়। সরকার থেকে তার জন্য টাকা দিয়ে লাইসেন্স কিনতে হয়। তারপর সারাদিন চেয়ার নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে বসে মাছ ধরে, কারও ভাগ্যে জোটে আবার কারও ভাগ্যে হয়তো জোটেও না। আর সব থেকে মজার ব্যাপার হল যাদের ভাগ্যে দু-একটা মাছ জুটে যায়, তারাও সেই মাছ আবার জলে ছেড়ে দেয়। বাড়িতে নিয়ে যায় না।

ফেরার পথে নিজের অজান্তেই কেন যেন মনে হল, লাইসেন্সের খরচ, চিংড়ি মাছের খরচ, সারাদিন কাজ না করে জলের ধারে বসে থাকা আর পড়ন্ত বিকেলে শূন্য হাতে বাড়ি ফেরা— প্রথম বিশ্বের মানুষদেরই এরকম বিলাসিতা সাজে!

আজ বছরের শেষ দিন। ২0২২-কে বিদায় জানাবে সারা পৃথিবীর মানুষ। কেউ একটু আগে, আবার কেউ আন্তর্জাতিক সময় রেখার জন্য একটু পরে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে আতশবাজি পুড়িয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। প্রতি বছর সিডনির বর্ষবরণের উৎসবে যোগ দিই। এবার একটু অন্যরকম ভাবে নিউ ইয়ারস ইভ কাটানোর পরিকল্পনা আগে থেকেই করে এসেছি। এই সময় টুরিস্ট এত বেশি থাকে যে আগে থেকে বুকিং না করে রাখলে কিছুই পাওয়া যায় না। তাই আমি আগে থেকেই স্পেশাল নিউ ইয়ার্স ইভ ডিনার ক্রুজের বুকিং করে এসেছিলাম। সমুদ্রের বুকে নৌকায় চেপে এক গেলাস শ্যামপেনের সাথে পুরোনো বছরের সব গ্লানি ধুয়ে ফেলে নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সন্ধ্যার সময় তৈরি হয়ে নেলসন বে জেটিতে পৌঁছোলাম। বাঙালির সময় জ্ঞান তো! নৌকার কাছে পৌঁছে দেখি আমাদের জন্যই সবাই অপেক্ষা করে আছে। একটু লজ্জিত ভাবে ‘সরি’ বলে নৌকায় উঠলাম।

ভেতরে ঢুকতেই একজন সেবিকা এসে আমাদের নিয়ে গেল একটা সুন্দর করে সাজানো টেবিলের কাছে। প্রথমেই নজর পড়ল আমাদের নাম লেখা দুটো কার্ড টেবিলের উপর রাখা। সাথে ফুলদানিতে নানা রঙের ফুল। আমাদের বসতে বলে মেয়েটি চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল খাবার আর ড্রিংক্স নিয়ে। এভাবেই একের পর এক খাবার আসতে লাগল। সাথে এল ড্রিংক্স। আর আমার জন্য স্পেশাল গ্রিন টি। পাশাপাশি চলছে লাইভ মিউজিক। খাবারের মাঝে মাঝেই অনেকে উঠে ড্যান্স ফ্লোরে গিয়ে ড্যান্স করছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে মিউজিক আরও জোরে হচ্ছে, আর সবার অ্যালকোহলের নেশাও হয়তো বাড়ছে।

আমি উঠে নৌকার ডেক-এ গেলাম কিছুটা ফ্রেশ এয়ার পাওয়ার আশায়। বাইরে থেকে রাতের সমুদ্র যেন আরও সুন্দর। সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলোর আলো সমুদ্রের জলে এসে পড়ে যেন এক মায়াবী আলো-আঁধারি পরিবেশ তৈরি করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য কাউন্টডাউন শুরু হবে। আস্তে আস্তে অনেকেই আমার মতো বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল। ডেক থেকেই সমুদ্র সৈকতের আতশবাজি সব থেকে ভালো দেখা যাবে। সবাই উত্তেজনার সাথে উদ্‌গ্রীব ভাবে অপেক্ষা করছে। ঠিক তখনই কাউন্টডাউন শুরু হল ১০… ৯… ৮… ৭…। আর দেখতে না দেখতেই নেলসন বে-র আকাশ রঙের খেলায় মেতে উঠল।

প্রায় দশ মিনিট ধরে চলল আতশবাজি পোড়ানো। সবার হাতে মোবাইল ফোন। কেউ ফটো তুলছে, আবার কেউ ভিডিও রেকর্ডিং করছে। খুব কম লোকই দেখলাম যারা হাতে ফোন না নিয়ে শুধুমাত্র সেই মুহূর্তটুকুকেই নিজের চোখ দিয়ে, মন দিয়ে উপভোগ করল। টেকনোলজি আমাদের সর্বতো ভাবে পালটে দিয়েছে।

আতশবাজি পোড়ানো শেষ হবার পর আমাদের প্রমোদতরণী আবার সবাইকে নিয়ে নেলসন বে জেটির দিকে যাত্রা শুরু করল। ফেরার পথে সবাইকে ডেজার্ট পরিবেশন কর হল। এতকিছু খাওয়ার পর ডেজার্ট খাওয়াটা একটু কষ্টকর হলেও এত সুন্দর করে বানানো কেকগুলোকে প্রত্যাখ্যানও করা যায় না। তাই নিউ ইয়ার্স রেসলিউশন হিসেবে মনে মনে ওজন কমানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে কেকটা খেয়েই ফেললাম। নেলসন বে পৌঁছোতে আরও কিছুক্ষণ লাগল। নৌকো থেকে নামার আগে সবাইকে বিদায় জানিয়ে, হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম।

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...