সন্তোষবাবু উত্তেজিত স্বরে বলেন— তোমার স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটা কী ছিল আমি সেটাই বিশেষ ভাবে জানতে চাই। ওটার উপরেই নির্ভর করছে সবকিছু।

অর্পণ প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞাসা করে- — কেন আপনি গল্প লিখবেন নাকি? শুনেছি গল্পকারেরা কোনও ঘটনার পরিণতির কথা ভেবেই গল্প রচনা করেন। আপনিও কি তাই ভাবছেন নাকি?

—কী যে বলো এই সত্তর বছর বয়সে আমি লিখব গল্প? এই বয়সে ভীমরতি হয় তা স্বীকার করি কিন্তু নতুন করে গল্প লেখক কবি বা সাহিত্যিক হওয়া যায় না। যারা হতে চান তাঁরা বামন হয়ে সুদূরের চাঁদ ধরার বৃথা আশা করেন। তাঁদের কপালে ব্যর্থতা ছাড়া অন্য কিছু জোটে না এটুকু বলতে পারি। লেখার অভ্যাস একটা বদ অভ্যাস। আমি বাপু কোনও অভ্যাসের দাস নই। তবে তুমি যাই বলো গল্প লেখার মতোই প্লট বটে। তুমি তো এখনও গল্প লেখো। তুমি একদিন নিজের মুখেই বলেছিলে গল্প লেখার অভ্যাসটা তোমার ছেলেবেলার। তোমার লেখা গল্প আমি মাঝেমধ্যে লিটিল ম্যাগাজিনে দেখি। তুমি লিখছ না কেন?

—কী যে বলেন কাকাবাবু আমি লিখব নিজের গল্প? অর্পণের সংক্ষিপ্ত জবাব।

—কেন ক্ষতি কী? শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের কথাই লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি ছাড়াও এরকম আরও অনেকেই করেছেন।

—আপনি উপহাস করছেন না তো? উনি হলেন বাংলার মনীষী। যা উনি পেরেছেন তা কি অন্য সকলের দ্বারা সম্ভব? অন্তত আমার দ্বারা অসম্ভব। তার চেয়ে আমার কথা অন্য কেউ লিখলে বেশি উপভোগ্য হবে লেখাটা।

—একদিক থেকে তুমি ঠিকই বলেছ। এই কারণেই গল্পকারেরা নিজের অভিজ্ঞতার কথা এবং অন্তর্নিহিত ভাবগুলো সব অন্যের মুখ দিয়ে ব্যক্ত করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন বেশি। নিজেকে আড়াল করে রাখার মধ্যেই তাঁরা বেশি তৃপ্তি ও আনন্দ পান।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সন্তোষবাবু বলেন— আর দেরি কেন? চলো, খাবারটা খেয়ে নেওয়া যাক। ন’টা বেজে গিয়েছে।

দু’জনেই এগিয়ে যান খাবার রাখা টেবিলের দিকে। প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’জনেই যখন রাতের আহার করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে একসময়ের স্কুলের সহপাঠী অনুপের সঙ্গে হঠাৎ দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায়।

সে কাছে এগিয়ে এসে অর্পণের প্লেটের উপর নজর দিতেই অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বলে ওঠে— সে কী রে! বিয়েবাড়িতে এসেও কৃচ্ছসাধন! বাঙালি হয়েছিস কিন্তু মানুষ হলি নে। বাঙালির পরিচয় ভোজনরসিক হিসেবে। সেই সম্মানটাকে তোর হাতে খুন হতে দেখে আমি খুবই দুঃখিত। অন্যদের দেখেও তো শেখা যায়। আর কোথাও না যাস অন্তত আমাকে অনুসরণ কর। দেখ তো আমার প্লেটখানা কি সুন্দর সাজানো!

এমন সময় অতিথিসেবায় ব্যস্ত স্বয়ং ছেলের বাবা এসে হাজির হলেন। অনুপের মুখনিঃসৃত উপদেশাবলী তিনি হয়তো শুনে ফেলেছিলেন। তাই ওর মুখের কথাটা শেষ হতেই তার সঙ্গে নিজের অভিমত যোগ করে বললেন— শেখার জন্যে আর কারও কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সম্মুখেই সশরীরে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং গুরুদেব বালুসাই মুখার্জী ওরফে শ্রী সন্তোষ মুখার্জী। এনার কীর্তিকলাপের কথা তোমাদের কারওরই জানা নেই। এনাকে আর কেউ চিনুক না চিনুক আমি চিনি। ইনি একজন মহান গুপ্তযোগী। এনাকে সকাল-সন্ধ্যায় প্রণাম করা উচিত। তারপর একটু কী ভেবে নিয়ে সন্তোষবাবুর অনুমতি ভিক্ষে করে জিজ্ঞাসা করলেন, সন্তোষবাবু পোল খুলব নাকি? এই প্রজন্মের অনেকেই আপনাকে চেনে না। আপনার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। তাতে কোনও আপত্তি আছে আপনার?

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...